মল্লিক বাড়ির গুপ্তধন
-প্রলয় কুমার নাথ
(১)
কলকাতা শহরের বেশ কিছু রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করে পুলিশ মহলে বেশ নাম করে ফেলেছে গোয়েন্দা গৈরিক সেন, এবং তার একমাত্র সহকারী তথা খুড়তুতো বোন, ঐন্দ্রিলা সেন ওরফে টুসু। সেদিন এক পরিচিত আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলো গৈরিক আর টুসু। ফিরতি পথে, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটে এসে হঠাৎ নিজের বাইক থামলো গৈরিক। পেছনে বসে থাকা টুসু জিজ্ঞাসা করলো,
– কি গো গেরোদা, থামালে কেন? কি হল?
গৈরিক নিজের হেলমেটটা মাথা থেকে খুলতে খুলতে বলে উঠলো,
– আমার পাশের ওই ব্যাংকটাতে একটু কাজ আছে। তুই এখানে একটু অপেক্ষা কর, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি…
গৈরিক চলে গেলে, টুসু সময় কাটানোর জন্য নিজের মোবাইল ফোনটা বার করে ডেটা অন করার সাথে সাথেই তার বন্ধুদের হাজারো হোয়াটসআপ মেসেজ এসে ভিড় করল তার ফোনে। সে মেসেজগুলো এক এক করে পড়ে দরকার মত প্রত্যুত্তর দিতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর গৈরিক বেরিয়ে এলো সেই ব্যাংকের গেট থেকে, তবে তার সাথে ওই ছেলেটা আর মেয়েটা কে? টুসু একটু ভালো করে ওদেরকে দেখেই চিনতে পারলো! গৈরিকের আগের একটি কেস চলাকালীন টুসুর পরিচিতি হয়েছিলো এই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির সাথে। ছেলেটির নাম শৈবাল এবং মেয়েটির নাম লিলি।
গৈরিক বলে উঠলো,
– বুঝলি টুসু, শৈবালেরও এই ব্যাংকেই একাউন্ট আছে আমার মত, তাই আজ ওদের সাথে ব্যাংকে দেখা হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শৈবাল হঠাৎ মৃদু হেসে বলে উঠলো,
– তবে গৈরিকদা, আপনারা যে এখানে শুধু ব্যাংকের কাজেই এসেছেন আর গোয়েন্দাগিরির জন্য নয়, এই কথাটা কিন্তু খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না…
টুসু এই কথা শুনে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
– ঠিক বুঝলাম না তো কথাটার মানে! এখানে আবার গোয়েন্দাগিরি করার আছেটাই বা কি?
লিলি অবাক হয়ে বললো,
– সে কি! নিশ্চয় কিছুদিন ধরে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখনি, ঐন্দ্রিলা..তাই বোধহয় জানো না, যে এই তো, কাছেই একটা বেশ পুরোনো বনেদী বাড়ি আছে, মল্লিক বাড়ি…সেখানে নাকি বেশ কিছুদিন ধরে কোন এক ভূতের আনাগোনা শুরু হয়েছে!
টুসু কপালে চোখ তুলে বললো,
– সে কি!
এবার শৈবাল বলে উঠলো,
– শুধু কি ভূত! সকলে বলছে যে ওই বাড়িতে নাকি গুপ্তধনও লুকনো আছে!
টুসু বিস্ময়ে আর কথা বলতে পারলো না।
লিলি আবার বলে উঠল,
– কে জানে ওখানে কি আছে বাবা! আমার তো এই সব পুরোনো দিনের বাড়িগুলো দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে!
ওরা আর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই চলে গেল। টুসুর খুব ইচ্ছা করছিলো, যে একবার সেই মল্লিক বাড়ি গিয়ে এই ভূত আর গুপ্তধনের ব্যাপারে আরো বেশি করে খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু বিধি বাম, সেই বাড়ির থেকে কেউ তো আর তাদের ডেকে পাঠায়নি, তাহলে তারা সেখানে যাবেই বা কি করে! অগত্যা, টুসু আবার গৈরিকের বাইকের পেছনে চেপে বসল, নিজের বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। গৈরিক বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল টুসুর মনোবাসনা, এবং সেটা জেনে, সে হেলমেটের ভেতরে মুচকি মুচকি হাসছিল।
(২)
তবে ঈশ্বর যেন টুসুর মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন। কারণ সেদিন বিকালেই, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গৈরিকের জরুরি তলব এলো টুসুর কাছে। টুসু তখন সবে দুপুরের ভাত ঘুম দিয়ে উঠেছিলো, ঠিক তখনই গৈরিক ওকে ফোন করে বললো, “তাড়াতাড়ি একবার আমার অফিসে চলে আয়, বাকি কথা এখানেই হবে…” এই বলে সে ফোনটা দিল কেটে।
উফ, কোন মানে হয়? ভাবল টুসু, গেরোদাটা সত্যিই মানুষকে এত সাসপেন্স-এ রেখে যে কি সুখ পায়, তা কে জানে! অগত্যা হুটোপাটি করে কোন ভাবে টুসু তখনই পৌঁছে গিয়েছিল রাসবিহারী মোড়ে অবস্থিত তার গেরোদার “সেন’স আই” নামক গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে। গৈরিক তাকে দেখেই বলে উঠলো,
– আসুন ম্যাডাম, আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম…
টুসু রাগী গলায় বলে উঠল,
– ন্যাকামি না করে, বলো তো কিসের জন্য ডেকে পাঠালে আমায়…
গৈরিক বেশ প্রফুল্লতার সাথে বলে উঠলো,
– এখনই তোর মনের ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে রে, টুসু! আমাদের একবার মল্লিক বাড়িতে যেতে হবে!
আনন্দে উত্তেজনায় টুসুর মুখটা লাল হয়ে উঠলো। সে অধৈর্য গলায় উৎসাহের সুরে বলে উঠলো,
– কেন, সেখান থেকে কেউ বুঝি ডেকে পাঠিয়েছে আমাদের? ওই ভূত আর গুপ্তধনের রহস্যভেদ করার জন্য?
গৈরিকের মুখটা কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে গেল সেই কথা শুনে, তারপর সে বললো,
– শুধু ভূত বা গুপ্তধনই নয় রে, টুসু…একটা মৃত্যুর রহস্যও আমাদের ভেদ করতে হবে!
টুসু এই কথা শুনে চরম উত্তেজনায় যেন আর কথা বলতে পারলো না।
তাই, গৈরিকই বলে চললো,
– হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস তুই, ওদের বাড়ি থেকে শ্যামাপ্রসাদ মল্লিক নামক এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আগেই ফোন করেছিলেন আমাকে। তিনি আমাদের তাড়াতাড়ি ওই বাড়িতে একবার যেতে বললেন। ওখানে নাকি সুজয় বলে একটি ছেলের মৃত্যু হয়েছে আজই সকালে, সেটা যে খুন কি না, তা তারাও ঠিক জানেন না! তবে ওখানে গেলে, বেশ কিছু কথা তিনি আমাদের বলতে চান, যা কিনা ফোনে বলা সম্ভব নয়!
টুসুর যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছিল না গৈরিকের কথাগুলো, সে তখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল তার গেরোদার দিকে চেয়ে। এবার গৈরিক বেশ অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
– নে নে, আর দাঁড়িয়ে থাকিস না…তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আমাদের…এখান থেকে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট কিন্তু বেশ কিছুক্ষণের পথ!
(৩)
আজ বিকালে কলকাতার রাস্তা-ঘাটে যেন একটু বেশিই যানজট। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে এসে, ট্রাফিক পুলিশের গ্রীন সিগন্যালের আশায় গেরোদার দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের পেছনে বসে থাকতে টুসুর যে কি বিরক্তি বোধ হচ্ছিল, তা কি বলবো। সত্যিই, তার গেরোদার বলা “বেশ কিছুক্ষণ লাগবে” কথাটা যে আদপে প্রায় দুই ঘন্টায় পরিণত হবে, এই কথা যেন টুসু আগে কখনো ভেবেই দেখেনি। বিকাল পাঁচটায় গৈরিকের রাসবিহারীর অফিস থেকে বেরিয়ে যখন ওরা সন্ধ্যা সাতটার সময় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের সেই মল্লিক বাড়ির কাছে পৌঁছলো, তখন টুসু গোয়েন্দাগিরি শুরু করার পক্ষে যথেষ্টই ক্লান্ত।
তবে সেই মল্লিক বাড়ির প্রথম দর্শনেই যেন টুসুর সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এমন চেহারার জমিদার বাড়ি টুসু গৈরিকের আগের কেসগুলিতে অনেক দেখেছে। কলকাতার মত এত জন-প্রাচুর্যে ভরা শহরেও, এই পাঁচ মহলা দোতলা পুরনো আমলের তৈরি বাড়িটি যেন অন্য আশে-পাশের সকল বাড়ি ঘর থেকে একটু বেশিই দূরত্বে অবস্থিত। বিশাল বড় সিংহ-দ্বার আর বড় বড় থামওয়ালা এই বাড়িটার চারিদিকে বেশ বড় আমবাগান। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি মার্বেলের তৈরি জলের ফোয়ারা, কিন্তু এখন আর সেটা সচল অবস্থায় নেই। ভেতরের উঠোনের এক ধারে দুর্গা-দালান, তার চারিপাশে একটানা দোতলা বাড়িটার সারি সারি ঘর। এখনো অবধি পুরোনো কলকাতার সেই ল্যাম্প পোস্টগুলোও আছে তার চারি পাশে। তবে বাড়িটা অবশ্য যে দেখাশোনা বা মেরামতির অন্তরালে আছে, তা কিন্তু নয়। এমন বাড়ি দেখলেই কেমন যেন একটা “রহস্য রহস্য” ভাব জাগে মনে।
বাড়িতে ঢোকার পর বাড়ির চাকর ওদের এনে বসালো নিচের বৈঠকখানায় একটি ঘরে। পরমুহূর্তেই সেই ঘরে প্রবেশ করলেন লম্বা, সুপুরুষ এবং আভিজাত্যে পরিপূর্ণ চেহারার অধিকারী এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক, পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। সেই ভদ্রলোক গৈরিক আর টুসুকে নমস্কার জানিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
– নমস্কার মিস্টার সেন, নমস্কার ঐন্দ্রিলা! আমি হলাম শ্যামাপ্রসাদ মল্লিক, আপনাদের রহস্য-ভেদের অনেক গল্পই আমি পড়েছি খবরের কাগজের পাতায়, সেই জন্যই আজ আমি আপনাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি!
ওরাও প্রতিনমস্কার জানিয়ে বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দিকে। না জানি, কোন রহস্যের সূত্রপাত ঘটাতে চলেছেন তিনি!
ঠিক সেই সময় সকলের জন্য কফি, চানাচুর এবং বিস্কুটের ট্রে হাতে হাজির হল বাড়ির চাকর।
ওদের সবার কফির ধূমায়িত মাগ হাতে নেওয়া হয় গেলে, শ্যামাপ্রসাদ বাবু বলতে শুরু করলেন,
– বুঝতেই পারছেন মিস্টার সেন, আমাদের এই পরিবার এই অঞ্চলের মধ্যে বেশ পুরনো। এখানেই আমাদের সাত পুরুষের বাস।
টুসু অবাক হয়ে বলে উঠলো,
– আপনারা নিশ্চয় এখানকার জমিদার ছিলেন, তাই না?
শ্যামাপ্রসাদ বাবু একটি ম্লান হেসে বললেন,
– হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো, ঐন্দ্রিলা…আমাদের এক পূর্বপুরুষের ছিল বিশাল বড় আমদানি রপ্তানির ব্যবসা, যার মুনাফা থেকেই তিনি এই অঞ্চলের জমিদারি কিনেছিলেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে…যাই হোক, সে সব অনেক প্রাচীন কথা, এখন শুধু এই বাড়িটাই যা পড়ে আছে, জমিদারির আর কিছুই নেই। এখন আপাততঃ এই এতবড় বাড়িতে থাকি শুধু আমি আর আমার দাদা নিত্যপ্রসাদ মল্লিকের পরিবার পরিজনেরা। বাকি সকলেই যে যার মত কেটে পড়েছে অন্যত্র। তবে, দাদা এই মুহূর্তে খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, তাই আমার সাথে তিনি এখন এখানে থাকতে পারছেন না।
গৈরিক বলে উঠলো,
– হুম, বুঝলাম, তবে শুনেছি নাকি এই বাড়িটা ঘিরে কোন ভূত আর গুপ্তধনের গল্প আছে স্থানীয় মানুষদের মনে…
শ্যামাপ্রসাদ বাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
– বলবো, আপনাদের সেই সব কথা বলার জন্যই তো একটু কষ্ট দিয়ে ডেকে পাঠালাম। কারণ ফোনে এতকিছু বলা যেত না…
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, যেন ভেবে নিলেন কোথা থেকে বলা শুরু করবেন, তারপর আবার মুখ খুললেন,
– আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের ঘটনা। সেই সময়, আন্দাজ ১৯১৬ সালে, আমাদের এক পূর্বপুরুষ, রমণীমোহন মল্লিক ছিলেন এখানকার ডাকসাইটে জমিদার। যেমন ছিল তার রূপ, তেমনই ছিল তার অর্থবল। শুনেছিলাম যে, রাজস্থানের কিষানগড়ের সেই সময়কার রাজা, মহারাজ ভানুপ্রতাপ সিংহ ছিলেন এই রমণীমোহনের বিশিষ্ঠ বন্ধু। যে সময় ভানুপ্রতাপ সিংহ কিষানগড়ের সিংহাসনে বসেন, সেই সময় তার রাজ্য খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল একটি খড়ার প্রভাবে। তখন রমণীমোহন তাকে অনেক আর্থিক সাহায্য করেন, তার কিষানগড়কে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। এরপর, একবার নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভানুপ্রতাপ সিংহ কিষানগড়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাঠান রমণীমোহন মল্লিককে, আর রমণীমোহনও খুব খুশি মনে রওনা হন রাজস্থানের উদ্দেশ্যে, তার বন্ধুর এই বিশেষ দিনে তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য।
এইটুকু বলে কিছুক্ষণ থেমে একবার দম নিয়ে, আবার বলতে শুরু করলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু,
– ভানুপ্রতাপ সিংহের জন্মদিনের খুশিতে তার রাজ দরবারে নাচ দেখানোর জন্য ডাকা হয় সেই সময়কার কিষানগড়ের সবচেয়ে সুন্দরী বাইজি, রূপমতীকে। এই রূপমতী ছিল ভানুপ্রতাপ সিংহের বাঁধা মেয়ে মানুষ, কিন্তু তারই প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলেন রমণীমোহন, আর রূপমতীও যেন একটু বেশিই সহৃদয় ছিল এই সুদর্শন বাঙালি জমিদারের প্রতি! তারপর এক দিন রাত্রে, রূপমতীকে নিয়ে এই কলকাতায় পালিয়ে এলেন রমণীমোহন…লোকের মুখে শোনা কথা, রূপমতী নাকি তার সাথে কোন এক মহা মূল্যবান বস্তু নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে! এবং সেটিকে সে রেখে দিয়েছিল এই বাড়ির নিচের তলার একেবারে উত্তর কোণে অবস্থিত তার ঘরে, তবে সেটা যে কি, তা আমরা এখনো কেউ জানি না। সেদিন থেকেই রটে গেল যে এই বাড়িতে নাকি গুপ্তধন আছে!…কিন্তু, এর কিছুদিনের মধ্যেই রূপমতী বোঝে, যে তার জন্য রমণীমোহনের মনে কোন ভালোবাসা নেই, আছে শুধু তাকে ভোগ করার বাসনা! সে কোনদিনই রূপমতীকে তার স্ত্রীর মর্যাদা দেবে না, তাকে দেওয়া রমণীমোহনের সকল কথাই ছিল মিথ্যা! তাই, একদিন ক্ষোভে দুঃখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে রূপমতী!…এর কিছুদিনের মধ্যেই ডাইরিয়া আর রক্তবমি হয়ে হঠাৎ মৃত্যু হয় রমণীমোহনের। আর এর পর থেকে, এই বাড়ির সম্বন্ধে, গুপ্তধনের কথার সাথে সাথেই রটে যায় রূপমতীর প্রেতাত্মার গল্প! অনেক পুজো আর্চা করে রূপমতীর ঘরের দরজা সারাজীবনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গৈরিক হঠাৎ বলে উঠলো,
– রূপমতীর ঘরে রাখা সেই গুপ্তধন খোঁজার চেষ্টা কি কেউ করেছিল আগে?
শ্যামাপ্রসাদ বাবু বললেন,
– না, সেরকম চেষ্টা কেউই করে নি, কারণ সত্যি কথা বলতে ওই ঘরে ভূতের ভয়ে এই বাড়ির কেউ কখনো যেতেই চায়নি… আর তাছাড়া, এই গুপ্তধনের সুত্র হিসাবে রমনীমোহনের মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া একটা ধাঁধা আছে… তিনি বলে গিয়েছিলেন, যে এই পরিবারের যে সদস্য বুদ্ধি করে এই ধাঁধার অর্থ বুঝতে পারবে, সেই হবে সেই গুপ্তধনের মালিক! কিন্তু, আমাদের বাড়ির তেমন কেউই সেই ধাঁধার কোন মানে বার করতে পারেনি!
টুসু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– কোথায় লেখা আছে সেই ধাঁধাটা…একবার দেখান…
শ্যামাপ্রসাদ বাবু মৃদু হেসে বললেন,
– উনি লিখে তো গিয়েছিলেন উনার এক পুরনো ডাইরির পাতায়, কিন্তু সেটা নিয়ে আসার কোন দরকার নেই, কারণ এতদিন শুনে শুনে আমার সেটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। শোনো, বলছি…
“পূর্ণতারার বেশে বানি,
কলানিধির রঙে জানি,
বুঝিতে যাহার পারিবে মন,
তাহারই হইবে সকল ধন।”
(৪)
টুসু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলো সেই ধাঁধাটার সম্বন্ধে। শেষের দু’টো লাইন তো যে কেউ পড়ে বুঝতে পারবে, যে সেই জমিদার বলতে চেয়েছেন যে আগের দুটো লাইনের অন্তর্নিহিত অর্থ যে বুঝতে পারবে, সেই হবে এই গুপ্তধনের মালিক। কিন্তু মুশকিল তো এই আগের দু’টো লাইন “পূর্ণতারার বেশে বানি / কলানিধির রঙে জানি” নিয়ে। এই দু’টি বাক্যের মানে যে টুসুর একটুও বোধগম্য হচ্ছে না! ঠিক এমন সময়, গৈরিক প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো,
– ধাঁধার কথা না হয় বুঝলাম, শ্যামাপ্রসাদ বাবু। তবে আপনি এই কথাও বলেছিলেন, যে এই বাড়ির কোন ছেলে নাকি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে…
শ্যামাপ্রসাদ বাবুর সুন্দর ফর্সা মুখটা যেন বেদনায় ভরে উঠলো, তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন,
– হ্যাঁ গৈরিক বাবু, সেটাই তো সবচেয়ে দুঃখ জনক ঘটনা এই বাড়ির। আসলে, বেশ কয়েক মাস ধরে এই বাড়ির একটা ঘরে সুজয় বোস নামক একটি ছেলে ভাড়া থাকছিলো। সে ছিল আমার দাদার ছেলে বসন্তের বন্ধু। সুজয় আর বসন্ত একসাথেই পদার্থবিদ্যা নিয়ে এম.এস.সি. করেছে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। তারপর দু’জনেই এই কলকাতার একটি বেশ বড় রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে পি.এইচ.ডি. করবার সুযোগ পায়। সুজয়ের পৈতৃক বাড়ি ছিল মেদিনীপুরের একটি মফস্বল গ্রামে, তাই সে আমাদের বাড়িতে ভাড়া থেকে নিজের রিসার্চের কাজ করতো। কিন্তু…
এবার যেন কিছু বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু। গৈরিক বলে উঠলো,
– কি হল? থামলেন কেন, বলুন…
অস্ফুট স্বরে শ্যামাপ্রসাদ বাবু বলে উঠলেন,
– ছেলেটা খুব ভালো ছিল জানেন মিস্টার সেন, আমাকে “কাকাবাবু, কাকাবাবু” বলে খুব সন্মান করতো, তাছাড়া পড়াশোনায়ও খুব ভালো ছিল। অতবড় একটা রিচার্স প্রতিষ্ঠানে পি.এইচ.ডি. করার সুযোগ পাওয়া যে মুখের কথা নয়, এ নিশ্চয় আপনি বুঝতেই পারছেন। কিন্তু তার একটা দোষ ছিল…ছেলেটা ছিল ভীষণ জেদি। সে যবে থেকে শুনেছিলো ওই রূপমতীর ঘরের ভূতের গল্পের কথা, তবে থেকেই সে সমানে আমার কাছে আব্দার করে চলেছিলো, তাকে সেই ঘরের চাবি দেওয়ার জন্য। সে সায়েন্সের ছাত্র, ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না, তাই তার খুব ইচ্ছা একবার ওই ঘরে ঢুকে প্রমাণ করে দেওয়ার, যে ওখানে কিচ্ছু নেই!…তাই, কয়েকদিন আগে, একরকম বাধ্য হয়েই আমি রূপমতীর ঘরের চাবিটা ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম…আর সেটাই ওর জীবনের কাল হয়ে গেল!
টুসু অধীর আগ্রহে বলে উঠল,
– কি হয়েছিল তারপর? সুজয় কি ওই ভূতের ঘরে গিয়েছিলো?
শ্যামাপ্রসাদ বাবু আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
– হ্যাঁ ঐন্দ্রিলা, সে গিয়েছিলো, তারপর আবার অক্ষত শরীরে হাসিমুখে বেরিয়েও এসেছিলো সেই ঘর থেকে। কিন্তু সেই ভূতের প্রকোপ শুরু হল তার পর দিন থেকেই! সুজয়েরও জমিদার রমনীমোহন মল্লিকের মত ডাইরিয়া আর রক্তবমি হওয়া শুরু হল…আমরা ওকে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় একটা হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম, কিন্তু কোন ফল হল না! এত অল্প সময়ের মধ্যে ডাক্তাররা ওর অসুস্থতার সেরকম কোন কারণই বার করতে পারলেন না, এবং আজ সকালেই খবর এল, যে সেই তরতাজা ছেলেটা আর আমাদের মধ্যে নেই!
একবার নিজের সুদৃশ্য সোনালী ফ্রেমের চশমাটা খুলে, নিজের দুই চোখ মুছলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, তারপর কান্না ভেজা গলায় বললেন,
– ছেলেটা এই কটা দিনে যেন এই বাড়ির ছেলেই হয়ে উঠেছিল, গৈরিক বাবু…কেনই বা ওই ঘরে যাওয়ার ভূত চাপল ওর মাথায়, আর এ কি হয়ে গেল!
টুসু যদিও বা ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না, তবুও ওর কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগলো এই কথা শুনে। সত্যিই তো, একটা জোয়ান ছেলের এই নিদারুণ পরিণতির কি কারণ হতে পারে? তাও আবার তার মৃত্যুটাও হয়েছে সেই লম্পট জমিদারের মতই!
গৈরিক আবার প্রসঙ্গ পাল্টে, শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো,
– সুজয়কে হত্যা করা বাদ দিয়ে, রূপমতীর প্রেতাত্মার এই বাড়িতে উপস্থিতির আর কোন প্রমাণ কি পেয়েছিলেন আপনারা?
এবার যেন আরো ভয় পেয়ে গেলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু, আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে তিনি বললেন,
– দাঁড়ান গৈরিক বাবু, আপনি সেই সব কথা একবার এই বাড়ির লোকেদের মুখ থেকেই শুনে নিন…
এই বলে তিনি সেই বাড়ির চাকরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন,
– যাও, একবার অপর্ণা দিদিমণি আর শ্রীতমা দেবীকে ডেকে নিয়ে আসো তো…এই বাবুরা ওদের সাথে কিছু কথা বলতে চান…
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরে প্রবেশ করলো দুইজন নারী। একজন হল বছর পঁচিশের এক সুন্দরী তরুণী, এবং অন্য জন হল এক সাধারণ চেহারার মাঝ বয়সী মহিলা। সেই অল্প বয়সী তরুণী এবার শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে বলে উঠলো,
– কি গো বাপি, ডাকছিলে আমাকে…
আর সেই মাঝ বয়সী মহিলাও বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শ্যামাপ্রসাদ বাবুর দিকে।
শ্যামাপ্রসাদ বাবু এবার ওদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠলেন,
– আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ও হল আমার একমাত্র মেয়ে অপর্ণা। আর আপনাকে তো বলেই ছিলাম গৈরিক বাবু, যে আমার দাদা এখন মুমূর্ষ এবং শয্যাশায়ী, তার স্ত্রী গত হয়েছে প্রায় দুই বছর হল। তাই তার সারা দিনের দেখাশোনার জন্য আছেন ওই শ্রীতমা দেবী…উনি এই বাড়ির আয়া।
তারপর তিনি অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবীকেও গৈরিক আর টুসুর পরিচয় দিয়ে বললেন,
– ওনাদেরকে একবার বলো, যে এই বাড়িতে তোমরা কি কি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছো…
সবার প্রথমে মুখ খুললো অপর্ণা, সে বেশ আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
– আমার ঘরও এই বাড়ির নিচের তলায়…ওই ভূতের ঘরের কয়েকটা ঘর পরে…ওই ঘরে কোন অশরীরি শক্তির উপস্থিতির কথা সব থেকে বেশি আমিই উপলব্ধি করেছি, গৈরিক বাবু!
গৈরিক বেশ কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলো,
– বেশ, কি কি উপলব্ধি করেছেন তা একটু শুনি, অপর্ণাদেবী।
অপর্ণা ভয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে উঠলো,
– প্রায় রাতে ওই ঘরে কারোর চলা ফেরার আওয়াজ শুনতে পাই আমি…আর মাঝে মাঝে তো হালকা হালকা নুপুরের ধ্বনিও ভেসে আসে ওই ঘর থেকে!
ওর কথা শেষ না হতেই শ্রীতমা দেবী আরো আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
– আমি তো চব্বিশ ঘন্টা এই বাড়িতেই থাকি গৈরিক বাবু, কি বলব বলুন, নেহাত পেটের দায়ে এই কাজ করা, নাহলে কি থাকতাম এই ভুতুড়ে বাড়িতে! হ্যাঁ, তো যা বলছিলাম, এই কিছুদিন আগে রাত্রে একদিন ঘুম আসছিলো না, তাই বাড়ির নিচের তলার বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। বুঝতেই পারিনি, যে মনের ভুলে কখন ওই অভিশপ্ত ঘরটার কাছে চলে এসেছি! তবে বুঝতে পারলাম তখন, যখন কানে সেই নুপুরের শব্দর সাথে সাথে, কি যেন একটা ভাষায় একটা হালকা গানের আওয়াজও ভেসে এল! আমি সাহসে বুক বেঁধে একবার ওই ঘরের বন্ধ দরজার দুই পাল্লার ফাঁকে চোখ রাখলাম…অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম…স্পষ্ট দেখলাম যে, ওই ঘরের ভেতর একটা ছায়ামূর্তি এই দিক থেকে সেই দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে!…আমি তো কোন মতে রাম নাম করতে করতে দে ছুট!…পরে জেনেছিলাম, যে ওই গানের ভাষা ছিল রাজস্থানী! মানে, যে ভাষায় গান গেয়ে ওই বাইজি রাজ দরবারে নাচ দেখাত, আর কি!
টুসু আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইল, এদিকে অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবী যেন দু’জনেই এক সাথে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো,
– এই বাড়িতে কিছু আছে, গৈরিক বাবু…আমাদের সকলের উপলব্ধি কখনো ভুল হবে না…কিছু তো একটা আছেই এই বাড়িতে!
ঠিক এমন সময় সকলের চিন্তার ঘোর কাটিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো শ্যামাপ্রসাদ বাবুর মোবাইল ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে কেমন যেন বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো তার ভ্রু। ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ কানে রেখে হঠাৎ স্থান কাল পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি,
– আপনাকে তো বলেই দিয়েছি, যে আমি বা দাদা এই বাড়ি বিক্রি করতে রাজি নই, তাহলে কেন বার বার ফোন করে বিরক্ত করেন আপনি…না অত লাখ টাকা দিলেও নয়…কি বলছেন, আপনি কি আমায় থ্রেট করছেন নাকি মশাই…ঠিক আছে, আমার বাড়িতে ভূত আছে কি পেত্নী আছে, তা আমি বুঝে নেব, আপনার কি?
এই রকম কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কাটলো কিছুক্ষণ, তারপর তিনি ফোনটা নামিয়ে রেখে, ঘরের বাকি সবাই-এর দিকে চেয়ে লজ্জিত গলায় বললেন,
– কিছু মনে করবেন না, মিস্টার সেন…আসলে এই প্রমোটার-টার ফোন আসলেই মাথাটা গরম হয়ে যায়!
গৈরিক জিজ্ঞাসা করলো,
– যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে জানতে চাই, যে কে এই প্রমোটার আর কি চাইছে সে?
শ্যামাপ্রসাদ বাবু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন,
– এই বদমাশটার নাম হল ঘনশ্যাম তিওয়ারী। ওর নজর আছে আমাদের বাড়িটার ওপর। দিনরাত শুধু আমাকে বলে বাড়িটা বিক্রি করার কথা, বলে নাকি ভালো দাম দেবে সে আমায়। তারপর এখানে একটা বহুতলী ফ্ল্যাট বানাবে…কি আস্পর্ধা দেখুন, বলছে যে ওই ভূতের বাড়িতে আপনারা আর ক’দিনই বা থাকতে পারবেন!…আমি তো স্পষ্ট ওকে মানা করে দিয়েছি…
টুসু দেখল, যে গৈরিকের মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল এই কথা শুনে। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
– ঠিক আছে, শ্যামাপ্রসাদ বাবু, বুঝলাম আপনাদের সব কথা। তবে এই কেসটাকে নিতে গেলে কিন্তু এই বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে।
শ্যামাপ্রসাদ বাবু মিষ্টি হেসে বললেন,
– সে আর বলতে, গৈরিক বাবু, এই বাড়িতেই আপনাদের থাকার সমস্ত বন্দোবস্ত আমি আগে থেকেই করে রেখেছি!
(৫)
মল্লিক বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিকের একেবারে কোণে যে বড় ঘরটা রয়েছে, সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে গৈরিক আর টুসুর। টুসুর একটু ভয় ভয়ই লাগছিল এই বাড়িতে তার প্রথম রাত কাটাতে। তবে যখন পাশের বিছানাতেই তার গেরোদা রয়েছে, আর যাই হোক, ভূত এই ঘরে ঢুকে তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই টুসু দেখল, যে তার গেরোদার বিছানা শূন্য, সে মনে মনে ভাবলো, যাহ বাবা, এত সকাল সকাল গেরোদা গেল কোথায়!…কিন্তু একটু পরেই ফিরে এলো গৈরিক, সে বেশ গম্ভীর মুখে সেই ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই টুসু জিজ্ঞাসা করলো,
– কি গো, এত সকালে কোথায় গিয়েছিলে?
গৈরিক সংক্ষেপে বলে উঠলো,
– এই বাড়িটার আশে পাশের চারদিকটা একটু ঘুরে দেখে এলাম…
টুসু বেশ অভিমানী স্বরে বলে উঠলো,
– ও আচ্ছা, তা যাওয়ার আগে বুঝি আমাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যেতে নেই?
গৈরিক মুচকি হেসে, গলায় কৃত্রিম উত্তেজনার ভাব এনে বলে উঠলো,
– আজ সকালে তো সেরকম কিছুই হয় নি, কিন্তু কাল রাতে তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি যা দেখলাম…ওরে বাপ রে!
টুসু উত্তেজনায় চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো,
– ও মা, সে কি! কি দেখেছ তুমি কাল রাতে? বলো না…
এবার গৈরিক আর ঠাট্টা ইয়ার্কি না করে, বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
– অপর্ণা আর শ্রীতমা দেবী কাল যা বললো, তা কিন্তু ভুল কথা নয় রে টুসু…ওই কারোর চলা ফেরা করার শব্দ, নুপুরের আওয়াজ, রাজস্থানী গান…এই সব কাল আমিও শুনেছি ওই ভূতের ঘরের দরজার বাইরে থেকে! এই কথা ঠিক, যে কিছু না কিছু অদ্ভুত জিনিস কিন্তু ঘটছে ওই ঘরের ভেতর!
এবার টুসু প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো,
– আর সেই ছায়ামূর্তি? তাকে দেখতে পেয়েছ তুমি?
গৈরিক কোন উত্তর দিল না সেই কথার, কি যেন ভেবে চলল সে নিজের মনে।
ঠিক সেই সময়, ওদের ঘরে এল ফর্সা, রোগা, মাঝারি উচ্চতার, বছর ছাব্বিস সাতাশের এক যুবক। সে হাসিমুখে ওদেরকে বলে উঠলো,
– গুড মর্নিং গৈরিক বাবু আর ঐন্দ্রিলা, আপনাদের জুটির প্রশংসা তো আমি অনেকের কাছ থেকেই শুনেছি। ও বাই দা ওয়ে, আমি বসন্ত মল্লিক…আমাকে কাকাবাবু আপনাদের ডেকে পাঠাতে বললেন ব্রেক ফাস্ট-এর জন্য…
ওর কথা শেষ না হতেই গৈরিক ওকে বলে উঠলো,
– গুড মর্নিং বসন্ত বাবু, একটা কথা বলুন, এই সুজয় বলে ছেলেটা তো আপনার খুব ভালো বন্ধু ছিল, আপনারা এক সাথেই রিসার্চের কাজ করতেন…ওর মৃত্যুর পেছনে কি আপনার কারোর ওপর কোন সন্দেহ হয়?
বসন্ত সকাল সকাল এই প্রশ্ন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, তাও সে একবার ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
– কেন, আপনাদের কাকাবাবু বলেন নি, যে ওই বাইজির ঘর থেকে কি সব ভৌতিক আওয়াজ পাওয়া যায়…ওটা একটা অভিশপ্ত ঘর…আমাদের সকলের বারণ সত্ত্বেও সুজয় ওই ঘরে ঢুকেছিল, তাই হয়তো ওকে এই ভাবে মরতে হল!
গৈরিক এবার দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,
– সেই ভূতের আওয়াজ আমি গতকাল রাতে পেয়েছি, আর আজকে রাতেও একবার পেতে চাই, বসন্ত বাবু…কিন্তু তার আগে, আপনি একবার আপনার কাকাবাবুকে গিয়ে বলুন, যে সুজয়ের মতই, আমরাও একবার ওই রূপমতী বাইজির ঘরে ঢুকতে চাই, তাই সেই ঘরের চাবিটা যেন আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়!
বসন্তের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল এই কথা শুনে, সে আর কোন কথা না বাড়িয়ে চম্পট দিল সেখান থেকে। কিছুক্ষম পর, সেই বাড়ির চাকর এসে কাঁপা কাঁপা হাতে গৈরিককে দিয়ে গেল সেই অভিশপ্ত ঘরের চাবি!
অনেক দিনের পুরোনো মরচে পড়ে যাওয়া তালাটা খুলে, একটা বিকট শব্দ করে যখন গৈরিক সেই বাইজির ঘরের দরজার পাল্লা দু’টো খুলে ফেলল, তখন টুসুর হৃদ স্পন্দন একটু হলেও দ্রুত হয়ে উঠেছিলো! ঘরটা মাঝারি আকারের। তার ভেতরে ঘুলোর আস্তরণ আর মাকড়সার জাল দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো, যে এই ঘরে কত দিন কেউ পা মাড়ায়নি। ঘরের ভেতরে ছোট খাটো আসবাসপত্রের মধ্যে চোখে পড়ে একটা অবহেলিত সুবৃহৎ সেগুন কাঠের খাট। ধুলো ভর্তি ছেঁড়া তোষক আর চাদর এখনো রয়েছে তার ওপর। এর ওপরই বোধহয় রূপমতীর মৃতদেহটা পড়ে ছিল কোন এক কালে!…ভয়ার্ত চিত্তে ভাবল টুসু…আর তাছাড়া একটু দূরেই রাখা রয়েছে একটি তালা লাগানো লোহার সিন্দুক…এর মধ্যেই নিশ্চয় সে নিজের গহনা-গাটি রেখে দিতো, আবার ভাবল টুসু! কিন্তু সেই ঘরে সব চেয়ে দেখার মত বস্তু হল রূপমতীর একটা তৈলচিত্র, এত বছর পর, এত ধুলো বালি জমে গিয়েও, তার সৌন্দর্যে যেন একটুও ভাটা পড়ে নি! কে জানে, কে এঁকে ছিল এই ছবিটা, কিন্ত এই কথা ঠিক, যে অপূর্ব সুন্দরী ছিলো এই বাইজি! টুসু এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিল রূপমতীর রূপ দেখে, যে সে বুঝতেও পারলো না, যে গৈরিক সেই খাটের নিচ থেকে কি যেন একটা রূপোর মত জিনিস তুলে নিয়ে, গম্ভীর মুখে, সেটাকে নিজের পকেটে চালান করলো! কিছুক্ষণ পর ওরা দু’জনেই সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
সেদিন সন্ধ্যে বেলায় টুসু মল্লিক বাড়ির দোতলায় বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে উদাস মনে রূপমতীর কথা ভেবে চলেছিলো, এমন সময় তার কাছে এলেন শ্রীতমা দেবী। তিনি ফিস ফিস করে টুসুকে বলতে লাগলেন,
– শোনো ঐন্দ্রিলা, তোমাকে একটা কথা বলি…তুমি যেন আবার পাঁচ কান করো নাকো…
টুসু অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– কি কথা বলুন তো?
শ্রীতমা দেবী একবার দুই পাশটা দেখে নিয়ে, আবার ফিস ফিস করে বলে উঠলেন,
– এই সুজয় ছেলেটা কিন্তু খুব একটা চরিত্রবান ছিল না…শ্যামাপ্রসাদ বাবু ওর সম্বন্ধে কিছুই জানেন না…জানো, কয়েকদিন আগে আমি গোপনে দেখেছিলাম, যে এই সুজয় আর বসন্তের মধ্যে সে কি ঝগড়া!
টুসু বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো,
– কেন? কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ওদের মধ্যে?
শ্রীতমা দেবী বলে উঠলেন,
– আরে, বসন্ত নাকি কোন ফাঁকে দেখে ফেলেছিল, যে সুজয় নাকি অপর্ণার সঙ্গে…
কিন্তু সেই সময় হঠাৎ পেছন থেকে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে চুপ করে গেলেন শ্রীতমা দেবী। সেই পদ-ধ্বনি আর কারোর নয়, স্বয়ং গৈরিকের। গৌরিক বেশ খোস মেজাজেই শ্রীতমা দেবীকে বলে উঠলো,
– সুজয় আর বসন্তের ঝামেলার কথা না হয় বুঝলাম, শ্রীতমা দেবী…কিন্ত আপনি এবার আমাকে একটা কথা বলুন, আজ দুপুরে আপনি বাড়ি যাওয়ার নাম করে ঠিক কোথায় গিয়েছিলেন এই বাড়ি ছেড়ে?
শ্রীতমা দেবী ভয়ার্ত মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অগত্যা, গৈরিকই বলে উঠলো,
– ঠিক আছে আমিই বলে দিই…বুঝলি টুসু, আমি আজ দুপুরে আবার সেই ব্যাংকে গিয়েছিলাম একটা কাজে…বেরনোর সময় দেখলাম, যে গুটি গুটি পায়ে শ্রীতমা দেবী বেরিয়ে এলেন পাশেই অবস্থিত প্রমোটার ঘনশ্যাম তিওয়ারীর অফিস থেকে! তা আপনার সেখানে যাওয়ার হেতু কি, শ্রীতমা দেবী?
শ্রীতমা দেবী ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে, সেই মুহূর্তে সেখান থেকে কেটে পড়লেন!
(৬)
রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও, গৈরিক আর টুসু বেশ উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপমতীর ঘরের বাইরে, সেই ঘরের তালা বন্ধ দরজার কাছেই। সেই রাজস্থানী ভাষায় মেয়েলি কণ্ঠের গুঞ্জন আর নুপুর পায়ে কারোর নৃত্য করার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে! গৈরিক টুসুকে অবাক করে ছুটে গেল দরজার কাছে, তারপর ক্রমাগত দরজায় বারি মারতে মারতে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
– রূপমতী ম্যাডাম, আমাদের কাছে কিন্তু এই ঘরের চাবি আছে, আমরা এখনই এই ঘরের দরজা খুলে ভেতরে আসছি! এই বাড়িতে এলাম আর দেখে যাবো না, যে আপনার কত সুন্দর রূপ ছিল!
কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত আওয়াজ! টুসু ছুটে গিয়ে চাবিটা দিয়ে সেই ঘরের তালা খুলতে উদ্যত হলে, গৈরিক তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
– ওই ঘরের ভেতর এখন আর কাউকে পাবি না…তবে সত্যিই যদি ওই সুন্দরীকে দেখতে চাস তাহলে আমার সাথে আয়!
এই বলে গৈরিক ছুটতে লাগলো একতলার বারান্দা দিয়ে, যেতে যেতে মোবাইলে স্থানীয় থানার ওসির নাম্বারটা ডায়াল করে কানে রাখলো ফোনটা। তার পেছনে পেছনে ছুটে চললো টুসু! ওরা সোজা মল্লিক বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে একেবারে বাড়ির পেছনে, জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত একটি জায়গায় এসে, একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই, পেছনের একটা ভাঙা দেওয়ালের কাছ থেকে আসতে লাগল সেই নুপুরের আওয়াজ, তবে সেই গান কিন্তু এখন আর হচ্ছে না!…একটা ছায়ামূর্তি যেন সেই পোড়ো দেওয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে এই অন্ধকারে…সে একটু কাছে এলেই গৈরিক ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলো তাকে, এক টানে খুলে নিল তার মুখে জড়ানো চাদর…টুসু অবাক হয়ে দেখলো, যে সেই “রূপমতী” আর কেউ নয়, এই বাড়ির ছেলে বসন্ত!…এক হাতে সে ধরে আছে দু’টো রূপোর নুপুর, আর অন্য হাতে ধরা তার স্মার্টফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনে এখনো দেখা যাচ্ছে, যে মিউজিক প্লেয়ার-এ পস করা আছে একটি রাজস্থানী গানের টিউন!…এমনই সময় বাড়ির কাছেই শোনা গেল পুলিশের গাড়ির আওয়াজ।
পুরো টিম নিয়ে থানার ও.সি. এবং মল্লিক বাড়ির সকলেই সেখানে হাজির হলে, গৈরিক সকলকে নিয়ে গেল সেই ভাঙা দেওয়ালটির পেছনে। তারপর নিজের মোবাইলের ফ্লাশ লাইট অন করে, সেই দেওয়ালের নিচের দিকে, কয়েকটা আগাছাকে পা দিয়ে সরিয়ে দিতেই, সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! দেওয়ালের গোড়ার দিকে, ওই ঝোঁ
ঝোপের পেছনে, আছে একটি ছোট সুড়ঙ্গের মুখ, তার ভেতর দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে সারি সারি সিঁড়ি! এর পর গৈরিকের নির্দেশে ওরা সবাই তখনই ছুটে গেল বাড়ির ভেতরে, রূপমতীর ঘরে। তারপর গৈরিকের কথায়, চারজন পুলিশ কনস্টেবল সেই ঘরের সেগুন কাঠের খাটটিকে সরিয়ে ফেলতেই, সবাই আবার অবাক হয়ে গেল। যে জায়গায় খাটটা রাখা ছিল, ঠিক তার নিচে একটা বেশ বড় ফাটল, তারও নিচ দিয়েও নেমে গিয়েছে সিঁড়ি। কাছেই রাখা আছে একটি কাঠের চাকতি, যার রংটা পুরো ঘরের মেজের রং-এই! বোঝাই যাচ্ছে, যে সেই ফাটলের মুখের ওপর এই কাঠের চাকতিটি খাঁজে খাঁজে আটকে যাওয়ার পর, খুব একটা কেউ বুঝতেই পারবে না, যে এই ঘরের নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ আছে!
গৈরিক শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে বলে উঠলো,
– এই ঘরের নিচে থাকা সুড়ঙ্গের অপর মুখ বাড়ির বাইরে, ওই ভাঙা দেওয়ালটির পেছনে, যা আপনারা একটু আগেই দেখে এসেছেন…এই ব্যাপারে না আপনি জানতেন, না রূপমতী, না বাড়ির অন্য কেউ…শুধু জানতে পেরেছিল বসন্ত! আর এই পথ দিয়েই সে বাইরে থেকে তালা বন্ধ ঘরটির ভেতরে ঢুকতো প্রায় রাতে…আর ওই নুপুরের ধ্বনি আর রাজস্থানী গানের আওয়াজের মত সস্তা বাজার চলতি পন্থাগুলো দিয়ে, সে যে কিভাবে আপনাদের ভয় দেখাতো, তা আর নিশ্চয় বলে বোঝাতে হবে না!
বসন্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, শ্যামাপ্রসাদ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কিন্তু কেন করতো ও এই সব?
গৈরিক মৃদু হেসে বলে উঠল,
– বসন্ত আর সুজয় রিসার্চের কাজ করতো তেজস্ক্রিয় ধাতু পোলোনিয়াম নিয়ে…এই কথা আমি ওদের রিসার্চ প্রতিষ্ঠান থেকে খোঁজ নিয়েই জানতে পেরেছি। ওদের রিসার্চ গাইড আমাকে বলেন, যে বেশ কিছুদিন থেকে ল্যাবে আনা পোলোনিয়াম-এর অধিকাংশই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না…এবং এই পোলোনিয়াম-এরই একটি টুকরো যখন আমি আজ সকালে এই ঘর থেকে পেলাম, আর বাড়ির পেছনের ওই সুড়ঙ্গটাকেও আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠে বাড়ির চার পাশটা দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, তখন আর আমার বুঝতে বাকি রইল না, যে বসন্তই ল্যাব থেকে পোলোনিয়াম চুরি করে, এই সুড়ঙ্গের পথে এসে সেগুলোকে রূপমতীর ঘরে লুকিয়ে রাখতো, ভূতের ভয়ে যাতে এই কথা আর কেউ জানতে না পারে। আর সেই ভয়কে আমাদের মনে আরো জোরালো করতে, সে আজকের মতই, প্রায় রাতে ওই পথ দিয়েই এই ঘরে ঢুকে এই ভাবে “ঘুমার” নাচন দেখাত…হা হা হা…তবে আমি আসার পর হয়তো সে চুরি করা মালের পুরোটাই সরিয়ে ফেলেছে এই ঘর থেকে, শুধু ভুল বশতঃ ফেলে রেখেছিল সেই ধাতুর একটি ছোট টুকরো! এই ধাতুকে এখন বিভিন্ন দেশে স্মাগল করা হচ্ছে, মূলতঃ নিউক্লিয়ার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর নিউক্লিয়ার অস্ত্রে এর ব্যবহারের জন্য…তবে, বসন্ত ল্যাব থেকে চুরি করে এই ঘরে লুকিয়ে রাখা পোলোনিয়াম কাদেরকে বেচতো, সেই কথা তার মুখ থেকে বার করার দায়িত্ব কিন্তু পুলিশের…আমার নয়!
একটু থেমে, বসন্তের দিকে চেয়ে, আবার বলতে লাগলো গৈরিক,
পোলোনিয়াম এমনই একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু, যা থেকে আলফা রশ্মি নির্গত হয়। এই আলফা রশ্মি মানুষের চামড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে না। তাই খুব একটা সুরক্ষা ছাড়া খালি হাতে এই ধাতুকে ধরলে তেমন কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে এই ধাতুর জলে দ্রাব্য কিছু লবন যেমন পোলোনিয়াম সাইট্রেট বা পোলোনিয়াম নাইট্রেট যদি মানুষের খাবারের সাথে তার শরীরে প্রবেশ করে, তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত! আর সুজয়ের পোস্ট-মোর্টেমে সেই কথাই উঠে এসেছে, আমার বলে দেওয়া কিছু স্পেশাল টেস্ট করে!…সুজয়কে আপনি কেন খুন করলেন বসন্ত বাবু?
বসন্ত মাথা নিচু করে, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
– আমার অজান্তে, এই ঘরে ঢুকে ও দেখে ফেলেছিল এখানে রাখা ওই ধাতু…ওর আর কিছুই বুঝতে বাকি থাকে নি…ও আমার কাছ থেকে অনেক টাকা চাইছিলো মুখ বন্ধ রাখার জন্য। তাই সেদিন রাতেই আমি সবার চোখের আড়ালে ওর খাবারের মধ্যে পোলোনিয়াম সাইট্রেট মিশিয়ে দিই…
ওর কথা শেষ না হতেই, অপর্ণা চিৎকার করে ছুটে গিয়ে সটান এক থাপ্পড় কষালো বসন্তের গালে! সেদিনই এরেস্ট করা হল বসন্তকে। ঠিক তখনই শ্রীতমা দেবী বলে উঠলেন,
– আমার অসুস্থ স্বামীর অপারেশনের জন্য আমি দুই লাখ টাকা ধার করি ঘনশ্যাম তিওয়ারীর কাছ থেকে, সেই টাকা আমি তাকে মাসে মাসে শোধ করে যাচ্ছি….আজকে বিকালে সেই জন্যই গিয়েছিলাম তার অফিসে…আর অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য আমার যে ছিল না, তা এখন আপনার বুঝতেই পারছেন!
(৭)
এতক্ষন পর টুসু অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
– কিন্তু গেরোদা, সেই ধাঁধা আর সেই গুপ্তধন…
গৈরিক এবার একটু মৃদু হেসে বললো,
– এর জন্য আমাদের পদার্থবিদ্যা আর জীববিদ্যা থেকে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। রাজস্থানের কিষানগড়ে মহারাজা সাওন্ত সিংহ নামক এক রাজা ছিল। তার দরবারে গান গাওয়া এবং কবিতা আবৃতি করার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়া নামক এক সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে আসেন সেই রাজার সৎ মা। সাওন্ত সিংহ তার প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ অবধি করেন। ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৪-এর মধ্যে, সেই রাজ দরবারের বিখ্যাত চিত্রকর নিহাল চাঁদ, রাজা সাওন্ত সিংহ-কে শ্রীকৃষ্ণের রূপে আর বিষ্ণুপ্রিয়াকে শ্রীরাধিকার রূপে চিহ্নিত করে, তাদের অনেক ছবি আঁকেন। এই বিষ্ণুপ্রিয়াকে লোকে বলতো “বানি থানি”, রাজস্থানী ভাষায় যার অর্থ হল “প্রসাধনী আর অলঙ্কারাদিতে সুসজ্জিতা সুন্দরী নারী”।
একটু থেমে একবার দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো গৈরিক,
– এবার আসি ধাঁধায়… শ্রীরাধিকার এক হাজার নামের মধ্যে একটি হল “পূর্ণতারা”, “বানি” হল এখানে “বানি থানি” আর “কলানিধি” হল “চাঁদের” প্রতিশব্দ…তার মানে “পূর্ণতারার বেশে বানি / কলানিধির রঙে জানি” কথাটার অর্থ হল: নিহাল “চাঁদের” রঙে আঁকা “রাধার” বেশে “বানি থানি”-র ছবি। শুনুন সকলে, এই ঘরের দেওয়ালে আটকানো এই তৈলচিত্রটি কিন্তু রূপমতীর নয়, এটা বিখ্যাত চিত্রকর নিহাল চাঁদের আঁকা রাধার বেশে “বানি থানি”-র ছবি, যার আর্থিক মূল্যর থেকেও তার ঐতিহাসিক বা নান্দনিক মূল্য অনেক বেশি…ওটাই হল আপনাদের বাড়ির আসল গুপ্তধন যার কথা জমিদার রমণীমোহন মল্লিক এই ধাঁধার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন! আমার বিশ্বাস, যেহেতু “বানি থানি” বাইজি থেকে রাজার স্ত্রী হয়ে উঠেছিল, তাই সেই ছিল রূপমতীর অনুপ্রেরণা, আর তাই এই ছবিটাকে সে এখানে নিয়ে আসে সুদূর রাজস্থানের কিষানগড় থেকে। সে নিজেও চেয়েছিল বাইজি থেকে রমণীমোহনের স্ত্রী হয়ে উঠতে, কিন্তু সেটা বোধহয় তার ভাগ্যে ছিল না!
টুসুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল এই কথা শুনে, সে ভাবলো, যে সাধে কি আর লোকে বলে, “অতি বড় সুন্দরী না পায় বর!”
(সমাপ্ত)