অতৃপ্ত বাসনা
-শচীদুলাল পাল
স্টেশন লছমনপুর। বীরভূম ঝাড়খন্ড সীমান্ত। একটাই ট্রেন। সকালে যায় রাতে ফেরে। ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম লোকজন বিশেষ নেই। লছমনপুর গ্রামে যেতে হবে ক্যানসার আক্রান্ত বন্ধুকে দেখতে। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুর সাথে একবারই এসেছিলাম।
নিশুতি রাত। মেঘে ঢাকা আকাশ। গা ছমছম। চাঁদ ওঠেনি। সরু মেঠো পথ। নিস্তব্ধ নিঝুম। শাল পিয়ালের বন। রাস্তা ভুলে গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালাম। ভুল পথে এসেছি। হঠাৎ একটা খসখস শব্দ।শুকনো পাতার উপর চললে যেমন হয়।স্পষ্ট দেখলাম একজোড়া নারী পুরুষ এগিয়ে আসছে। যুবক যুবতী। এগিয়ে এসে মেয়েটি বলল “আপনি কোথায় যাবেন?” আমি বললাম “লছমনপুর গ্রাম।” মেয়েটি বলল “আপনি ভুল করেছেন। এটা গ্রামে যাবার পথ নয়। আমাদের সাথে আসুন আমরা আপনাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। আমরা ঐ গ্রামেরই। আমি ওদের অনুসরণ করলাম। ওরা দু’জনে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। মেঘের ফাঁকে একফালি চাঁদ। মাঝে মাঝে ওদেরকে দেখছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম “তোমরা কে?” মেয়েটি বলল “আমি পিয়ালি আর ওর নাম পলাশ।” আমরা দু’জনে দু’জনকে ভালবাসি। পথ চলতে চলতে আমরা একটা গ্রামের সামনে এসে পড়লাম। পিয়ালি বলল “কার বাড়ি যাবেন?” আমি আমার বন্ধুর নাম করতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তারপর বলল “আসুন”। বাড়ীটির কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না কোন দিকে গেলো। বাহির দরজায় টোকা দিতে বন্ধুর স্ত্রী দরজা খুলে দিল। বিশাল অট্টালিকা। অসুস্থ বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। রাতের খাবার খাইয়ে বন্ধুর স্ত্রী একটা ঘর খুলে বলল “এখানে আপনি ঘুমাবেন।”
দক্ষিণ খোলা। আলো বাতাস পূর্ণ দোতলার ঘরটি বেশ মনোরম। কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে ওরা চলে গেলো। আমি দরজায় খিল এঁটে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। পথশ্রান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ একটা বীভৎস চিৎকারে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম। আলো জ্বেলে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। আলো নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার একটা অস্বাভাবিক শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর। স্বর্নলংকারে ভূষিতা একটা মেয়ে আমার পাশে বসে আছে। একফালি চাঁদের আলো ওর মুখের উপর পড়লো। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম “কে তুমি?”
মেয়েটি বেশ জোর গলায় বলল “আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি পিয়ালি”। ভয়ে উত্তেজনায় হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো।নিজের হাতে দরজা বন্ধ করেছি কোথা থেকে সে এল? হঠাৎ পিয়ালির চোখ দু’টি বড়ো হয়ে গেল। আগুন ঠিকরে বেরতে লাগলো। ভয়ংকর বীভৎস মূর্তি। ঘরের আলো একবার জ্বলছে নিভছে। আকাশ বাতাস চিরে অট্টহাসি। আমার খাটটা দুলতে লাগল। একবার আলো একবার অন্ধকার। পিয়ালি কখনো খাটের উপর কখনো নীচে। কখনো এপ্রান্তে কখনো ওপ্রান্তে। সর্বত্র দেখছি পিয়ালি। হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি। কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। সামনে পলাশ। পিয়ালি পলাশ একসাথে আমাকে গ্রাস করতে আসছে। আমি চীৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালাম। সম্বিত ফিরে পেলাম কে বা কারা যেন বাইরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম বাইরে বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী । তারা ঘরে এসে বসল।জিজ্ঞেস করল “এত জোরে চেঁচাচ্ছিলে কেনো?” আমি বললাম “পিয়ালি পলাশ এসেছিলো, পিয়ালি কে?” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুটি বলল “পিয়ালি আমার বোন”।
বন্ধু পত্নী যা বলল তা শুনতে শুনতে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল। “বহুকাল আগে পিয়ালি পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল। পলাশ ওকে জল থেকে তুলে বাঁচিয়েছিল। সেই থেকে ওরা একে অপরকে ভালবাসত।আমরা পিয়ালিকে ঘরে বন্দী করে রাখতাম। একদিন পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে পলাশকে বিয়ে করেছিল। পলাশ ছিল জাতে বাউরি।গরীব। আমরা মেনে নিইনি। একদিন ওরা আবার পালিয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে একটা পিয়াল গাছে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। সকালবেলা গ্রামের লোক বাড়ীতে খবর দেয়”। বলতে বলতে বন্ধু পত্নী অঝোরে কাঁদতে লাগলো।