মানবতা…
-রুদ্র প্রসাদ
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ মানুষ, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘হোমো সেপিয়েন্স’, জীবকূলের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, সে তো মানুষ-জাতিই, তার আবার জাতিভেদ কিসের! তার একমাত্র পরিচয় সে মানুষ। সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত অভিযোজিত হতে হতে, সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজের মাথায় শ্রেষ্ঠত্বের উষ্ণীষ স্বমহিমায় প্রতিভাসিত করে এসেছে মানুষ।
কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় সীমারেখার গণ্ডীতে, বা ভৌগোলিক যুক্তিতে, কিংবা নিছক গাত্রবর্ণ বিচারে তার নাম-নামান্তর হলেও মূলতঃ সে মানুষ। সে বিশ্ব-বিধাতার সন্তান, এক অননুকরনীয় সৃষ্টি, যে সৃষ্টিতে নেই কোনো ভেদ-বৈষম্যের পার্থক্যরেখা। কিন্তু মানুষ নিজেই রচনা করেছে কৃত্রিম জাতি, সৃষ্টি করেছে ঘৃণ্য বৈষম্য।
ভেদবুদ্ধি-প্রণোদিত স্বার্থান্বেষী মানুষ নিছকই লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষে-মানুষে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছে। জাগতিক যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যত কলঙ্কিত অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়, যত হানাহানি আর রক্তপাত, সবের মূলেই রয়েছে এই অবাঞ্ছিত অন্তর।
বিবর্তনের হাত ধরে ধূলার এই ধরণীতে যখন মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন ‘স্বজাতি-বিদ্বেষ’ বলে কোনো অনুভূতির অস্তিত্ব ছিল না বলেই জাতিভেদের মতো নীচতা কখনোই স্থান পায়নি মানুষের আচারে বা ব্যবহারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিবর্তনশীলতার পথে মানুষ যতই অগ্রসর হয়েছে, ততই তার মনে সঞ্চারিত হয়েছে পরস্পর-বিদ্বেষী ভাব, যার দহন জ্বালায় জর্জরিত পৃথিবী শোণিত-স্নাত হয়ে খিন্নকণ্ঠে বারেবারে আর্তনাদ করে উঠেছে। বিভেদের বিষক্রিয়ায় মানুষ সহজাত প্রবৃত্তি হারিয়ে অন্ধ হয়েছে, ছিন্নমস্তার মতো আপন রূধির-পানে হয়ে উঠেছে উন্মত্ত। সেই চক্ষুলজ্জাহীন জাতিভেদ, বর্ণবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বকে সঙ্কটের মুখে ফেলেছে বারবার, যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে পৃথিবী বারেবারে উঠেছে শিউরে।
পৃথিবীতে মানুষে-মানুষে সংঘাত ও রক্তপাতের শুরু অতি প্রাচীনকাল থেকেই। ভৌগোলিক পরিসীমার বেষ্টনীতে আবদ্ধ মানবগোষ্ঠী সময়ের সাথে সাথে স্থানান্তরের গোষ্ঠীকে আলাদা ভাবতে শিখেছে, যার ফলে ক্রমাগতভাবে নিজেকে অন্যের থেকে পৃথক করার প্রবণতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক সীমা-বেষ্টনীর মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে কৃত্রিম একাত্মতার ঘোরে গঠন করেছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, যারা ক্রমশঃ রূপান্তরিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে। আর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে চলেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নামে সর্বগ্রাসী ধ্বংসলীলা।
সময়ের সাথে সাথে ক্ষীণ হতে থাকলেও বৈষম্য প্রদর্শন আজও কদর্যভাবে বর্তমান। প্রাচীনকাল থেকে শ্বেতাঙ্গ জাতি অশ্বেতাঙ্গদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করে এসেছে, ক্রীতদাসপ্রথা যার এক কলঙ্কিত ইতিহাস। ‘সুসভ্য’ শ্বেতনখরে ‘অসভ্য’ কৃষ্ণকায়দের কম রক্ত ঝরেনি। একবিংশ শতকে যখন সারা পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা শান্তি ও সাম্যের কথা চিন্তা করছেন, তখনও বিস্ময়ে বাকরোধ হয় দেখে যে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বর্ণবৈষম্যের এই দূরপনেয় কলঙ্ক আজও মুক্ত হয়নি!
পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, এই পৃথিবী সাক্ষী থেকেছে মানুষের চরম বর্বরতার, মানবতার দুঃসহ লাঞ্ছনার। দৈহিক বর্ণের জন্য কখনোই কোনো মানুষ দায়ী হতে পারে না। জলবায়ুর পার্থক্যই মূলতঃ মানবদেহের বর্ণের বিভিন্নতার জন্য দায়ী। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায়ও ‘কালো আর ধলো, বাহিরে কেবল, ভেতরে সবারি সমান রাঙা।’ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আর্থ-সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক, সব বিচারে প্রাগ্রসর শ্বেতাঙ্গরাই বরাবর বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে আদিম বর্বরতার কাছে আত্মবিক্রয় করেছে, কৃষ্ণকায়দের অর্ধ-মানব বা ‘হাফ-ম্যান’ মনে করে তাদের ওপর করে এসেছে নৃশংস অত্যাচার। বর্ণাভিমান ও জাত্যাভিমানের নির্লজ্জ প্রকাশ যে মানুষকে কত মূঢ়, নিষ্ঠুর পশুতে পরিণত করতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যাণ্ড তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। দক্ষিণ রোডেশিয়ায়ও হয়েছে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আমেরিকায়ও সমানাধিকারের দাবির স্বার্থে প্রাণ দিয়েছেন নিগ্রোনেতা মার্টিন লুথার কিং, প্রেসিডেণ্ট কেনেডি এবং রবার্ট কেনেডি।
প্রাচীন ভারতবর্ষ এই মহান সত্য উপলব্ধি করেছিল যে ‘মানুষ এক, মানুষে-মানুষে কোনো বিভেদ নেই, সকল মানুষের অন্তরেই শ্রীভগবানের বাস’। কিন্তু বৈদিক যুগের অবসানে মনুষ্যত্বের সেই গরিমা হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। জীবিকা ও গুণের বিচারে সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চার ভাগে বিভক্ত হলেও পরবর্তীকালে আত্মপ্রকাশ করে ঘৃণ্য জাতিভেদ-প্রথা, শুরু হয় মানবতার নির্লজ্জ অপমানের এক কালো অধ্যায়। সমগ্র সমাজ বৈষম্যের অসংখ্য প্রাকার তুলে আত্মহননের পথে অগ্রসর হয়েছে। যে ভারতবর্ষ মানুষের অন্তরে ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেছিল, সেই ভারতবর্ষই তার এক বিশাল জনসম্প্রদায়কে ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য, অপাঙ্ক্তেয় ও পতিত করে রেখেছিল দীর্ঘকাল। পরে যদিও অপমানের শরশয্যা থেকে পীড়িত মানবতাকে তুলে এনে তার যথাবিহিত পূজার আয়োজন করা হয়েছে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দ যার প্রধান কাণ্ডারী, তবু আজও যখন ক্রোধ ও বিদ্বেষের লেলিহান অগ্নিশিখায় হরিজন বালককে পুড়িয়ে মারা হয়, বা জাতপাতের নামে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন ভারতবাসী হিসেবে লজ্জায় অবনত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পৃথিবী থেকে ভেদাভেদের রক্তপাতের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্যই এসেছিল ধর্ম আর সব ধর্মের মূলকথাই ছিল সংঘবদ্ধভাবে কিছু রীতিনীতি সহযোগে পরস্পরের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান তথা সাম্য ও সহিষ্ণুতার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বুদ্ধ, যীশু, মহম্মদ, চৈতন্য- সবাই মানুষকে শান্তির পথ দেখানোর জন্যই বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু চিরকালই মানুষের হাতে সেই ধর্ম কলুষিত হয়েছে। ধর্মের ছুরিকাঘাতে পৃথিবী হয়েছে রক্তাক্ত, ধর্মোন্মত্ত পাষণ্ডদের হুঙ্কারে মানব সভ্যতার উঠেছে নাভিশ্বাস। ধর্মের নামে পৃথিবীতে যত রক্তপাত ঘটেছে, এমন আর কোনো কিছুতেই কখনো হয়নি। যুগে যুগে ধর্ম ডেকে এনেছে ঘৃণ্য পরধর্মবিদ্বেষ, তাতে রূধিরোৎসবে আত্মঘাতী হয়েছে মানুষ, অবলীলায় যুপকাষ্ঠে বলী হয়েছে মানবতা। আজ বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী থেকে ধর্মের সেই ভ্রান্তিবিলাস ধীরে ধীরে অপসারিত হচ্ছে। অহিফেনবৎ ধর্মের বটিকা পরিত্যাগ করে আজ জাগছে অন্তরের মানুষ, মনুষ্যত্ব উজ্জীবিত হয়ে মানবতাবোধের হচ্ছে আনয়ন। শম্বুকগতিতে পরিবর্তন আজ অতি সামান্য কতিপয়ের মধ্যে হলেও এই জাগরণ এক আশাপ্রদ আগামীর বার্তাবাহী।
ভিন্ন ভিন্ন গাত্রবর্ণের মানুষেরা সবার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে এবং পাবে কিনা, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানে থাকবে কিনা, এইসব প্রশ্নের উত্তর সময়ের গর্ভে। কিন্তু মহাকাল মিলনবিলাসী। মানুষে-মানুষে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ মিলনই সবার কাম্য। সেই মিলন যদি সমানতা ও বিবর্তনের পথে না হয় তবে হয়তো বেজে উঠবে রুদ্রবীণা, মানবতার মহামিলনের পথে যে কৃত্রিম ‘বাধার বিন্ধ্যাচল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিকে দিকে, সব ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে এক লহমায়। হয়তো তার জন্য আরও এক বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সমগ্র মানবজাতিকে। কিন্তু যখন এই ঘৃণা-পঙ্কিল ও ভেদ-ক্লিষ্ট পৃথিবী সেই মহামিলনের পরমলগ্ন প্রত্যক্ষ করবে, তখন হিটলার বা ভেরউডের প্রেতাত্মা কি করবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও, বিধাতা যে সমগ্র মানবজাতিকে আশীর্বাদ করবেন, একথা বলাই বাহুল্য। সেদিন আবার সবার হৃদকমলে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত ও চিরবিরাজমান হবে ‘মানবতা’।।
খুব ভালো লাগলো
অশেষ ধন্যবাদ।
অপূর্ব প্রকাশ
অশেষ ধন্যবাদ।
খুব ভালো লিখেছ
ধন্য যোগে কৃতজ্ঞতা অশেষ…।