প্রত্যাবর্তন
-শানজানা আলাম
শুভমিতা যখন রায়চৌধুরী বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন দুপুরের রোদের তেজ কমেছে। বাড়িটা জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছে একেবারেই। শুভমিতার পূর্বপুরুষদের বাড়ি, শুভমিতার বুকের মধ্যে একটা কাঁপন লাগে, কোথাও যেন একটা চিনচিনে ব্যাথা নাড়া দেয়। বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড লাগানো ‘বাহাউদ্দীন ম্যানশন’। পাথরে খোদাই করা ‘রায়চৌধুরী বাড়ি’ এর উপর জোর করে বসানো হয়েছে যেন। বাড়ির সামনের গেটটা একেবারে ভেঙে গেছে। রডের গেট লাগানো হয়েছে এখন। তাতে শ্রীবৃদ্ধি হয়নি মোটেও। গেট দিয়ে ঢুকতেই ঘুঁটে আর খড়কুটোর মিশ্র গন্ধ নাকে লাগে। গেটের পড়েই হাতালঘরের মতো, হোগলা দিয়ে বেড়া দেয়া। দু’টো গরুর জন্য খড়কুটো দেয়া। গরু দু’টো আধভাঙা শুয়ে জাবর কাটছে। তারপরেই শানের ঘাট বাঁধানো পুকুর। এ পুকুর উন্মুক্ত সবার চানের জন্য। ঘাটের অবস্থাও জরাজীর্ণ। কেউ সিমেন্ট দিয়ে সারাই করেছে মনে হয়। হাতালঘর, পুকুর পেরিয়ে বাড়ির মেইন কম্পাউন্ড। বেশ বড়োসড়ো একটা মাঠ৷ মাঠের কোণায় রায়চৌধুরী বাড়ি। মেইন বাড়ির পাশেই মন্দির। বাড়ি আর মন্দিরের মাঝামাঝিতে একটা কুল বরই গাছ। ছোটবেলায় ছাদ থেকে হাত দিয়ে বরই পারতো শুভমিতা। কত লোকজন কোলাহল, এখন এত চুপচাপ, শুনশান লাগছে চারপাশ। হয়তো নস্টালজিয়ায় কানে শব্দ ঢুকছে না। এখন যে অনুভূতি হচ্ছে, সেটা শুভমিতার অচেনা। এখানে ফেরার কোন ইচ্ছে বা টান তার ছিল না। কলকাতার সল্টলেকের বিশাল ফ্লাটবাড়ি বা বন্ধুবান্ধব, হইচই নিয়ে শুভ ভালোই ছিল। বাদ সাধলো ঠাম্মু। তিনি শুভমিতাকে পাঠালেন পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখে আসতে। শুভর চোখে তিনি দেখবেন। সাতাত্তর বছরে আর কলকাতা থেকে বাগেরহাটের এতদূর এসে ভিটেমাটি দেখার সামর্থ তার শরীরে নেই। তাই শুভকে পাঠালেন একটু দেখে আসতে। মা অবশ্য বারণ করেছিল। তবে বাবা কিছু বলেননি। তিনি শুভকে বড় করেছন শক্ত করে। যে মেয়ে দিল্লি কলকাতা মুম্বাই অনায়সে যাতায়াত করে, সে দু’দশ দিন বাংলাদেশ ঘুরে যেতেই পারে।তাছাড়া স্থানীয় কলেজের শিক্ষক, তার ছোটবেলার বন্ধু যাদব বাবুর বাড়ি রয়েছে, সেখানে শুভ যত্নেই থাকবে। যেমনটি তারা যত্ন করেছন ওরা কলকাতায় এলে। শুভমিতার বাবা শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর ধারণা নির্ভুল ছিল। আসার পর থেকে মৌলি কাকীমা যার পর নাই যত্ন করছেন।
শুভমিতা সামনের দিকে এগুলো। মাঠে ছোট ছোট বাচ্চারা খালি গায়ে খেলছে। দু’ তিনটা ছাগল চড়ে বেরাচ্ছে। মাঠের কোনায় রক্তজবার ঝাড়টা আছে এখনো। আগের মতোই। পাশেই তুলসীমঞ্চ। মা ঠাম্মু এই রক্তজবা সকাল সন্ধ্যায় ঠাকুরের পায়ে দিতেন।
বাড়ির নিচতলায় কয়েকজন মহিলা বসে গল্প করছে। এরা কি এবাড়ির কেউ! হয়তো দুপুরের খাওয়া শেষে বসেছে একসাথে। নিচতলায় ছিল ছয় সাতটা বড় বড় ঘর। দোতলায় চারটা। ছাদের সিড়ির পাশে ছোট ছোট ঘর ছিল দু’ তিনটে। ছাদের ঘরে তখন কেউ থাকতো না। সুপুরি, নারকেল, ধান, শষ্য রাখা হতো। দোতলায় থাকা মা, বাবা, ঠাম্মু, ছোটকা, শুভমিতা আর সার্থক, শুভর ছোট ভাই। নিচতলায় ছিল পাক ঘর, ডাইনিং, বাবার চেম্বার আর এমনি দু’টো রুম। জ্ঞাতি আত্মীয় স্বজন এলে থাকতো। চাকর বাকর, আর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী, বাবার বন্ধু, মক্কেল সবাই ছিল আসা যাওয়ার উপর। বাবা এডভোকেট ছিলেন এখানে। শুভর দাদুও ছিলেন ডাকসাইটে উকিল। বাবা আর ছোটকা কলকাতায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
যে মহিলারা বসে গল্প করছিলেন তারা শুভর পোশাক আশাক দেখে একে অপরকে খোঁচাতে লাগলেন। সত্যি, এখানে এখনো মানুষ পোশাক নিয়ে কথা বলে। সামান্য টপস আর জিন্স সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না। শুভমিতা জানালো, আমি পূজা, এ বাড়িটা একসময় আমদের ছিল। এবার কৌতুহল মিটল। এদের একজন নিচতলার একটা রুমে ভাড়া থাকে। বাকিরা আসপাশের। নিচতলার রুমগুলো ভাড়া দেয়া!! তিন চার ফ্যামিলির কাছে!!! শুভমিতা প্রমোদ গুনল। এ বাড়ির বর্তমান ভাড়াটে তাকে দোতলায় নিয়ে গেল। আসবাবপত্র আগের মতো কিছুই নেই। শুধু বাবার চেম্বারের বড় টেবিলটা দোতলায় দেখতে পেল। দোতলায় ও দু’টো পরিবার থাকে। বাহাউদ্দীন বেপারী আর বউ বাচ্চা নিয়ে থাকেন এক পাশে। শুভ নিজের পরিচয় দিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাইল। বাহাউদ্দীন তেমন খুশী মনে না হলেও দেখতে দিলেন৷ তখন বেশ সস্তায় কিনেছিলেন পুরো বাড়ি,জমি। ২০০১ সালে সরকারের পরিবর্তনের সময় হিন্দুরা কিছুটা চাপে ছিল এলাকায়। গ্রাম এলাকায় আজ এর মেয়েকে, কাল ওর মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এখানে তেমন সমস্যা না হলেও শশাঙ্ক বাবু আর থাকতে চাইলেন না। এ সম্পত্তি কেনার মতো লোক কম ছিল না, কিন্তু জানাজানি হলে অন্য সমস্যা। তাই গোপনে গোপনে সব দলিল, চুক্তিপত্র হয়ে গেল। তারপর একদিন সপরিবারে ভারতে চলে গেলেন শশাঙ্ক রায়চৌধুরী। আর ফিরলেন না। তার কয়েকদিন পরে কাগজপত্র প্রমাণ সমেত নিয়ে বাহাউদ্দীন দখল নিলো সমস্ত বাড়িটা।
শুভমিতা ঘরগুলো দেখছিলো। এই যে এখানে একটা আলমারি ছিল, মায়ের একটা বড় আয়না ছিল। ঠাম্মির খাটটা ছিল অনেক উঁচু। কিছুই নেই। লোকাল রড, স্টিলের শোকেস, মেহগনি কাঠের রঙ করা খাট, এ বাড়ির সাথে কিছুই মানায় না। একটা জরীর তাজমহল টানানো, ওয়ালমেট, একেবারেই বেমানান। শুভমিতা ছাদে চলে এলো। এখানে ঠাম্মু বরই আর চালতা শুকাতো। আর এখানে কুমড়োর বরি। শুভ ওই কোনায় খেলত। ভাই তখনো হয়নি। ওরা যখন চলে যায়, ভাইয়ের তখন ৮মাস বয়স, শুভর ৯বছর। এইখানে হাত দিয়ে কুল বরই পাওয়া যেত, সরস্বতী পুজোর আগে মা বরই খেতে দিতো না। ছাদের পাশে দাঁড়ালো শুভমিতা। বরই গাছের ডালগুলো কাটা।
মন্দির
টা দেখা যাচ্ছে। দুর্গাপুজোয় যে কি ধুমধাম হতো। মা, ঠাম্মু চওড়া লালপেরে শাড়ি পরে অঞ্জলি দিতেন। কপালে জ্বলজ্বল করতো টকটকে লাল সিঁদুর টিপ, পায়ে আলতা।
আর কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় ভোগ রান্না হতো বিশাল বড়ো হাড়িতে, খিচুড়ি আর সবজি।
পাঁচ রকমের নাড়ু বানানো হতো। জ্ঞাতি আত্মীয় স্বজন সবাই আসতো।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। শুভ নিচে নামলো। কিছু ছবি তুলে নিল আস্তে আস্তে।
মন্দিরে এখনো পুজো হয়। শুভমিতা ঠাকুরকে প্রণাম করে বের হয়ে গেল।
পিছনে রইলো তার ফেলে আসা শৈশব স্মৃতি।
এখনকার অবস্থা ঠাম্মুকে না বললেও হবে। ঠাম্মু, তুমি যেমন রেখে গিয়েছো, সব কিছু তেমনি আছে। কিচ্ছু পালটায়নি।
শুধু সময় এগিয়েছে।
কিছু মিথ্যে যদি বুড়ো মানুষটাকে একটু শান্তি দেয়, দিক না।