গল্প

কিছু পলাশের নেশা

কিছু পলাশের নেশা
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

দোলা আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার গ্রীলটা ধরে। কাল রাতে তিতিরকে রঞ্জন নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভীষণ একলা লাগছে নিজেকে।
আজ চারদিকে শুধু রঙের খেলা। ওইতো সামনের বাড়ীর ছাদটায় সামিয়ানা টাঙিয়ে দোল খেলার কি বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। পাড়ার অনেকের সাথে তারও নিমন্ত্রণ ছিল কিন্তু সে যায়নি। যার জীবনের ক্যানভাসটাই বেরঙা হয়ে গেছে সে আর রঙ খেলে কি করবে। সামনের বাড়ী থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, “রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস —
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে।।
ফাগুন লেগেছে বনে বনে”–।
দোলার মনে পড়ছে বিয়ের পর রঞ্জন তাকে এসে বার বার রঙিন আবীরে ভরিয়ে দিচ্ছিল। তাই দেখে ওর ছোট ননদ বলেছিল তুই কি আজ শুধু দোলাকেই রঙ মাখাবি? আমদের কি ভুলেই গেলি?
রঞ্জন ছিল তার বন্ধু বহ্নির দাদা। সেই সুত্রে তাদের আলাপ আর প্রেম তারপর বিয়ে তারপর তিতিরের আগমন তাদের দিনগুলোকে আরও সোনলী আর রঙিন করে দিয়েছিল। প্রতি বছর রঞ্জনদের বাড়ীতে বেশ বড় করে রাধাকৃষ্ণের পুজো হয় তারপর দোল খেলা হত ওদের বাগানে। অনেক আত্মীয় বন্ধুর সমাগম হত। রঞ্জনের অনুরোধে প্রতিবার তাকে গান গাইত হত। ফাগুন লেগেছে বনে বনে এই গানটা যে সে কতবার মনে পড়েনা আর। একবার দোলাকে কাছে নিয়ে তাকে রঙ মাখাতে মাখাতে রঞ্জন গেয়েছিল, “একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনে।” সবাই কি হাসাহাসি তাই নিয়ে, রঞ্জন একটুও লজ্জা না পেয়ে উত্তর দিয়েছিল, আজ প্রেমের দিন নিজের বউয়ের সাথে প্রেম করবো না একটু? দোলা লজ্জায় লাল হয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল।
আজ সেই সব স্মৃতি হয়ে শুধু বেঁচে আছে দোলার গোপন অন্তরে। কাল অবশ্য ওকে রঞ্জন বলেছিল অনেকবার চলোনা তুমিও, মা অনেকবার করে বলে দিয়েছেন তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য–।
– দোলা প্রশ্ন করেছিল কোন অধিকারে যাবো?
– তিতিরের মায়ের অধিকারে, আর তাছাড়া আমিই না হয় খারাপ, অন্যায় যা হয়েছিল আমার দিক থেকে কিন্তু আমার বাড়ীর লোকেরা তো সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসে। মা মাঝে মাঝেই তোমার কথা বলেন আর চোখের জল ফেলে বলেন আমার অমন লক্ষ্মী বউমাকে তোর জন্যেই বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হল। চলো না এবার প্লিজ-
বলে ওর হাত ধরতে গিয়েছিল-
– দোলা ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া গলায় বলেছিল- আমি তোমার হাতের খেলনা নই রঞ্জন, যে তোমার ইচ্ছে হলেই বাড়ী থেকে বার করে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে নেবে। আবার ইচ্ছে হলেই হাত ধরতে আসবে
তাহলে তিতিরও না হয় থাক তুমি তো একদম একা থাকবে?
– না তিতির ওর দাদু ঠাম্মা পিসি বাবার সাথে আনন্দ করুক আমার জন্য ওর শৈশবটা বেরঙা করবো কেন?
তারপরও রঞ্জন বলছিল, “আমার ভালোবাসায় ভরা রঙিন দিনগুলোকে কি একেবারেই ভুলে গেছ?” শুধু আমার অসভ্যতাটাই মনে করে রেখেছ?
– না ভুলব কেন? সেই স্মৃতিটুকু নিয়েই তো পথ চলছি। কিন্তু নিজের কপালের ওপর একটা কাটা দাগ দেখিয়ে বলল, এই অপমানটাও ভুলতে পারিনি। ওপরের আঘাতটা শুকিয়ে গেলেও ভেতরের ঘা-টা বড় দগদগে। ওটা কোনদিন শুকোবে বলে মনে হয়না।
এরপর আর রঞ্জন কোন কথা বলেনি মুখ নীচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল। বেরোবার আগে তার কপালের দাগটার দিকে একবার করুণ চোখে তাকিয়ে দেখেছিল, দোলা লক্ষ্য করল ওর গভীর চোখদু’টোতে টলটল করছে জল।
ওরা চলে যাবার পর দোলা উপুর হয়ে বিছানায় শুয়ে পরেছিল কখন যে চোখে ঘুৃম নেমে এসেছিল টেরই পায়নি। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘুম জড়ানো গলায় ফোনটা ধরে বলল, হ্যালো-
ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো রঞ্জনের,
দোলা?
– হ্যাঁ বল?
– ঘুমিয়ে পরেছিলে?
-হ্যাঁ
-এই তিতির তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়…
-দাও ওকে…
-মাম্মা আমার তোমার জন্য খুব মন খারাপ করছে। এখানে সবাই আছে শুধু তুমি নেই-
দোলা বুঝল এগুলো শেখানো কথা তা নইলে তিতির এতো গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা।
দোলা তাও নিজেকে সংযত করে বলল- তুমি ঘুমিয়ে পড়ো সোনা অনেক রাত হয়ে গেছে।
– তুমি না থাকলে আমার ঘুম আসেনা মাম্মা…
-এখানে সবাই বাপি মাম্মা দু’জনের সাথে এসেছে আমি শুধু তোমায় ছাড়া…
– এইতো আর দু’ এক দিন পরেই তো আমার কাছে আসবে আবার…
– কিন্তু তখন তো বাপি আমাদের সাথে থাকবেনা?
– তুমি বাপির কাছে থাকতে চাও?
-আমি দু’জনের সাথেই থাকতে চাই…
– আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়ো…
– ঘুমলে আমরা একসাথে থাকব তো?
– না সোনা তা আর হয়না…
– কেন হয়না মাম্মা?
– সে তুমি বুঝবেনা এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
আবার রঞ্জনের গলা —
– মেয়ের স্বার্থেও কি আমরা আর একবার এক হতে পারিনা…
– আমি খুব ক্লান্ত রঞ্জন আমায় একটু ঘুমতে দাও। বলে দোলা ফোনটা কেটে দিল।
সারা রাত আর ঘুমতে পারেনি কিছু খাওয়াও হয়নি।
আজ সারারাত ভেবেছে কখনও রঞ্জনের গভীর ভালোবাসার কথা কখনও বা তার নির্মম ব্যাবহারের কথা। তিতির যখন সবে দু’ বছরের তখন রঞ্জনের জীবনের আসে রনিতা। রনিতা রঞ্জনের অফিসেই কাজ করত কিন্তু রঞ্জনের চেয়ে অনেকটাই জুনিয়র ছিল। তার খোলামেলা পোশাক উচ্ছলতা অনেক পুরুষকেই আকর্ষণ করত। অফিস পার্টিতে মদ খেয়ে নাচ করতে সে বেশ অভ্যস্ত ছিল। রঞ্জনও একদিন বিরক্ত হয়ে এসে দোলাকে বলেছিল, কোথা থেকে যে এসব চিপ মেয়েগুলোকে আমদানি করে কে জানে?
এই একটা মেয়ের জন্য অফিসের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই চিপ মেয়েটার ফাঁদে রঞ্জন নিজেই সবচেয়ে বেশী আটকে গেল। এমন ভাবে আটকালো যে স্ত্রী সন্তান পরিবারের সবাইকে একদিকে ফেলে রমিতাকে নিয়ে মত্ত হয়ে গেল। সেদিন দোলার প্রতিবাদ চোখের জল সবকিছুই তার কাছে মূল্যহীন হয়ে গেছিল। গোপনে রনিতার সাথে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টও করেছিল। সেখান থেকে রনিতা ইচ্ছামত টাকা তুলে তার শখ মেটাত। দোলাকে খুব সামান্য টাকা ধরে দিত। প্রতিবাদ করলে বলত যার নিজের রোজগারের মুরোদ নেই স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে ওইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বেশী প্রতিবাদে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করতো না। একদিন এরকম এক ঝগড়ার সময় চড়ের পর চড় মেরে দোলার মুখ চোখ ফুলে গেল। পরদিন দোলা ঘর থেকে বার হতেই পারছিল না লজ্জায়। পরদিন শাশুড়ি দেখে বললেন বউমা একি অবস্থা? দাঁড়াও আজ বাড়ী ফিরুক আজ একটা হেস্তনেস্ত করব। শ্বশুরমশাই দেখে বললেন বউমা আমি এখনও বেঁচে আছি ওই ইতরটাকে কি ভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমিও দেখছি। কিন্তু সেদিন রঞ্জন বাড়ি ফেরেনি। অফিস কলিগকে ফোন করে ওরা জানতে পারে রঞ্জন রমিতাকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গেছে।
তারপর দোলা চাকরি খোঁজায় মন দেয়। বাড়ির তাতে মত দেয় একটা কিছু নিয়ে তো তাকে বাঁচতে হবে। পেয়েও যায় এক গভর্নমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতার কাজ। সত্যি কথা শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা চিরকাল তার পাশে ছিল আজও আছে।
পুরী থেকে ফিরে এসে রঞ্জন ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায়। যে মদকে সে ঘৃণা করত সেই রোজ মাঝরাতে মদ খেয়ে বাড়ী ফিরত।
একদিন দোলা বলে ফেলেছিল, ভালোই হল তিতির বড় হয়ে দেখবে তার বাবা একটা মোদো মাতাল দুশ্চরিত্র লোক। মেয়ে রঞ্জনের বুকের পাঁজর ছিল। এইকথায় সে হঠাৎ মত্ত অবস্থায় উঠে দোলার চুলের মুঠি ধরে সজোরে খাটের বাজুতে মাথা ঠুকে যায়, দোলার কপাল ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে তখন। রক্ত দেখে তার নেশা ছুটে গেল তাড়াতাড়ি তখন ডেটল ব্যান্ডেজ খুঁজতে আরম্ভ করল। রঞ্জন বলেছিল স্যরি দোলা আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলামনা। দোলা রঞ্জনের হাত ছাড়িয়ে নিজের কপাল চেপে ধরে শ্বশুর শাশুরির দরজায় ঘা দেয়। তাঁরা তো ওর অবস্থা দেখে কেঁদেই অস্থির শাশুড়ি বললেন — এও ছিল আমার কপালে লেখা এমন ছেলে থাকার থেকে মরে যাওয়াও যে ভালো। শ্বশুরমশাই তাড়াতাড়ি ডেটল নিয়ে এসে জায়গাটা পরিস্কার করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই রক্ত বন্ধ হল না। রঞ্জন বরফ নিয়ে এলো শ্বশুর তাকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, খবরদার তুমি ওর কাছে যাবার চেষ্টা করবেনা তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা। উনি ছুটে নীচে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে তুলে নিয়ে গেলেন হসপিটালে। কি ভাগ্যিস আউটডোরে ডাক্তার পাওয়া গেল। দোলার কপালে তিনটে সেলাই পরলো। তার পরের দিন উকিল ডেকে এনে উনি ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করেন। রঞ্জন তখন কাকুতি মিনতি করতে থাকে তিতিরকে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারবনা। উকিল সাহেব প্রশ্ন করল কি আর একবার সুযোগ দেবে নাকি?
তার হয়ে তার শ্বশুরই উত্তর দিলেন তোমার মতন একটা পশুর কাছে কিছুতেই এই বাপ মা মরা মেয়েটাকে রাখতে পারবনা। রঞ্জন কান্নায় ভেঙে পরে বলেছিল কিন্তু এটুকু শুধু করুন ওদের সমস্ত ব্যয়ভার আমার, দোলা চাকরি করতে কোনদিন ভালোবাসতনা আজ আমার জন্য ওকে চাকরি করতে হচ্ছে…
শ্বশুর কঠিন কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল সে কথা এখন আর না ভাবলেও হবে তাছাড়া আমি এখনও বেঁচে আছি।
একমাসের মধ্যেই এই ফ্ল্যটটা তাকে কিনে মনের মতন করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। দোলা তার মেয়ের হাত ধরে এ বাড়ীতে এসে ওঠে।
কৃতজ্ঞতায় ছলছল চোখ নিয়ে দোলা বলেছিল তুমি এতো করে দিলে বাবা?
– আজ থেকে তুই আমার বউমা নয় আমার মেয়ে।
তারপরই রঞ্জন বুঝতে পারে তার ভুল সে কি হারালো? রঞ্জন দেখল তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট শূন্য সে নিজের নাম অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে নিল। আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলল যার নমিনি করল দোলাকে।এই নিয়ে রমিতার সাথে তার বিস্তর ঝগড়া হল। রঞ্জন নতুন চাকরি নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। তিতিরকে ও বাড়ীতে তার শ্বশুর মাঝে মাঝে এসে নিয়ে যেতেন। শাশুড়িও মাঝে মাঝে এসেই এ বাড়ীতে এসে দোলাকে দেখে যেতেন, ননদও আসত শুধু রঞ্জনের আসা একদম বারণ ছিল। আজ এই প্রথম রঞ্জন এসেছিল।
কাল রাত থেকে সে খায়নি দশটা বাজে এখনও পর্যন্ত এককাপ চা খেয়েও উঠতে পারেনি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এককাপ চা আর দু’টো বিস্কুট নিয়ে বসল। ভাবল একটু পরে যা হোক একটু আলুভাতে ভাত করে নেবে।
সে বিছানায় শুয়ে পড়লো, আবার ঘুম আসতে লাগল কাল রাত জাগরণের ফল।
এমন সময় মনে হল দরজার বাইরে যেন অনেক লোকের কোলাহল তারপরই দরজায় বেশ কয়েকবার বেলের আওয়াজ। সে থমকে গেল কে এলো তার কাছে তো আসার মতন এখন কেউ নেই। ডোর আই দিয়ে দেখল তার শাশুড়ি মায়ের মুখ তখন সে নির্ভয়ে দরজা খুলল। একসাথে হুড়মুড় করে ঢুকে পরল সবাই শ্বশুর শাশুড়ি ননদ নন্দাই তাদের ছেলে সোহম সবশেষে তিতিরের হাত ধরে রঞ্জন । শাশুড়ি এসেই হাসিমুখে বলল আজ আমি আমার ঘরের লক্ষীকে নতুন করে বরণ করে নিয়ে যেতে এসেছি।
দোলা অবাক চোখে তাকালো তার মনে হচ্ছিল সে কি স্বপ্ন দেখছে?
রঞ্জনের অনেক প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে মা। আমি জানি তোমার অভিমান ঘৃণা এতো সহজে যাবার নয়। তবু বলছি তিতিরের মুখ চেয়ে রঞ্জনকে আর একটা সুযোগ দাও। কাল দেখো নিজের কপালের কি অবস্থা করেছে।
দোলা জিজ্ঞেস করলো- “এ কি করে হল?” বললো- দোলার কপালের কাটা চিহ্নটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাই নিজের কপালটা ওইভাবে ঠুকে প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছিলাম।
দোলা এতক্ষণে তাকিয়ে দেখল কপালে একটা ব্যান্ডেজ আছে ঠিকই কিন্তু তা রক্তে লাল হয়ে ভিজে গেছে। দোলা বলল স্টিচ হয়েছে? এখনও তো রক্ত বন্ধ হয়নি? আজ কোনো ডাক্তার পাওয়া গেলনা। সেকি তা বলে সারাদিন ধরে এই রক্ত পরে যাবে? আমি দেখছি বলে ছুটে পাড়ার একজন ডাক্তারকে ফোন করে বললো, “একজনের কপাল ফেটে খুব রক্ত পড়ছে , মনে হচ্ছে সেলাই দিতে হবে আপনি একটা কিছু যা হোক ব্যাবস্থা করুন।
– ঠিক আছে মা তুমি ব্যস্ত হয়োনা আমি দেখছি কি করা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার একটি ছেলে নিয়ে এসে ক্ষত পরীক্ষা করে দেখে বললেন- এ হে হে কি করে এভাবে কেটে গেল বাবা? রঞ্জন তখন আর কথা বলতে পারছেনা শুয়ে পড়েছে দোলার খাটে। কম্পাউন্ডার সেলাই করতে করতে বলল- পাঁচটা সেলাই পড়ছে বাবু?
– হ্যাঁ যা লাগে তাতো করতেই হবে। একটা টিটেনাসও দিতে হবে। তারপর ডাক্তার তার কাজ সেরে ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন, বলে গেলেন জ্বরও আসতে পারে কিন্তু।
রঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে পরল- দোলা দেখল রঞ্জনের দু’ চোখের কোল দিয়ে জল পড়ছে। দোলার মনে আছে রঞ্জনের ছুঁচ ফোটানোতে কত ভয় ছিল সে আজ নিঃশব্দে সব যন্ত্রণা সহ্য করল।
দোলা কাছে এসে ইতস্তত করছিল। ঘর থেকে ওদের একটু একলা থাকার সুযোগ দিয়ে সবাই বাইরে চলে এলো প্রসাদ ভাগ করার ব্যবস্থা করতে। যাবার আগে ওর ননদ কানে কানে বলে গেল তুই চলে আসার পর দাদা একবারও আবীর খেলায় অংশ নেয়নি। না কাউকে দিয়েছে না ওকে কাউকে দিতে দিয়েছে। জোর করলে বলতো আমার রঙ খেলার মানুষটা যদি কোনদিন ফিরে আসে তবেই আবার খেলবো। ওটা বোধহয় ও একটা ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিল। আমাকে ধরে যে অত মারতো সেটাও কি ট্র্যাপে পড়ে? জানিনা রে সত্যি জানিনা, তবে অনুতাপ অনুশোচনায় যে তিল তিল করে দগ্ধ হচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। মাঝখানে তার শুধু এমন হল যে ভালো করে খেতো না ঘুমোত না খালি কাঁদতো।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর দোলা দেখল ও কুঁচকে শুয়ে আছে মনে হল ওর শীত করছে দোলা ওর গায়ে চাপা দিতে গেল তখন রঞ্জন ওর হাতটা ধরে কাছে এনে বলল, “বলো দোলা আমার প্রায়শ্চিত্ত কি হয়েছে”? দোলার চোখেও তখন জল ভর্তি সে তবু অভিমানে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। রঞ্জন জোর করে ওর মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল-“একবার বলো”?
দোলার কণ্ঠস্বর নরম করে বলল, “এর কি কোন প্রয়োজন ছিলো?”
আমি জানিনা ছিল কি না? কিন্তু কাল তোমার কাটা দাগটা আমায় ভীষণ আঘাত দিলো মনে হলো নিজে করে দেখি সেদিন কতোটা কষ্ট ওকে দিয়েছিলাম? তাই করে ফেললাম…
দোলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল ওখানে চলো আসতে আসতে, সবাই অপেক্ষা করছে।
দোলার কাঁধে ভর দিয়ে রঞ্জন বেরোতেই তিতির আর সোহম ওদের দিকে আবীর ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হোলি হ্যায়— ওরা দু’জনেই হেসে ফেললো। আবার অনেক দিন পর ওরা রঙের আনন্দে মেতে উঠলো।
রঞ্জন দোলার দু’গালে কপালে গলায় আবীর মাখাতে মাখাতে গান ধরল-
একটুকু ছোঁওয়া লাগে একটুকু কথা শুনি…তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী…
দোলা লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। রঞ্জন কাছে এসে আবার ওর মুখটা আদর করে তুলে ধরলো, দোলা বাধ্য হল গান ধরতে- কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি।।
দোলা আর রঞ্জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওদের নন্দাই দু’টো পলাশের মালা দু’জনের হাতে দিয়ে বললো এবার তোমরা পরিয়ে দাও দু’জনের গলায়—–
সবাই আবার সমস্বরে বলে উঠল হোলি হ্যায়।।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page