সার্থকতার স্বাদে, আটের সাথে
-রীণা চ্যাটার্জী
আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে আজ বিশ্বব্যাপী। নারীদের সম্মান রক্ষা, নারীদের মহিমা, সমমর্মিতায় বেশ সরব আজকের সমস্ত সামাজিক মাধ্যম। লেখালেখি, শুভেচ্ছা বার্তা, নানান অঙ্গীকারের উন্মাদনা, বিভিন্ন ভঙ্গীমার ছবি চলবে হয়তো আগামী বেশ কয়েক দিন ধরে। নারীদের উদ্দেশ্য নিবেদিত একটি দিন।
এর সূচনা হয়েছিল দেড়শো বছরেরও বেশ কিছু বছর আগে। কর্মজীবী মহিলা শ্রমিকের সমমর্যাদার, সমমূল্যের পারিশ্রমিকের, মানবিক কর্মের পরিবেশের দাবিতে শুরু হয়েছিল একটি সংগঠিত প্রতিবাদী সংগ্ৰাম। ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস’ আদি নাম- উদ্দেশ্য খুব ভালোভাবেই বোঝা যায় নাম থেকেই। তারপর থেকে আরো দুইটি সম্মেলন হয়। তৃতীয় সম্মেলনের মঞ্চ থেকে প্রস্তাব রাখা হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালন করা হবে। ক্রমে ‘আন্তজার্তিক নারী দিবস’ নামে দিনটি বহুল পরিচিত ও প্রচলিত। ‘জাতিসংঘ’ বেশ কিছু মুখ্য বিষয় তুলে ধরে বিগত কয়েক বছরে রেখেছে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য। বিশ্বের বেশ কিছু দেশে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ একটি সরকারি ছুটির দিন। বিশেষ বিশেষ কোনো দেশে এই ছুটি শুধু মাত্র মহিলাদের জন্য নির্ধারিত। এই সব তো কিছু তথ্য নির্ভর ইতিহাস আর বর্তমানের কথা।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগে আজো কতোটা কার্যকর হয়েছে, ‘নারীর সম-অধিকার’? অধিকার শুধু কর্মের ভিত্তিতে হলে এটি তর্কের বিষয়- যোগ্যতা, দক্ষতা, বিচক্ষণতার বিচার হবে নাকি সংখ্যার গুণিতকে হবে। অতীতের থেকে আজকের নারীরা কর্মক্ষেত্রে কতোটা নিরপেক্ষতা, নিরাপত্তা পায় অথবা প্রশ্ন থাকে কিভাবে সে কর্মে যুক্ত হলো। পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট, পরিসংখ্যান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে, তবে এই কথা বোধহয় অনস্বীকার্য নারীরা তাদের যোগ্যতা সাফল্যের সাথে প্রমাণ করেছে সবক্ষেত্রে।
সম-অধিকার? প্রশ্নের তালিকায়-
সমমূল্যের পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নারীরা আজো শ্রমের সমমূল্য পায় না। কিন্তু তাদের ওপর থাকে বেশ কিছু অযাচিত, আরোপিত অন্যায় দাবীর চাপান-উতোর। বিনিময় মূল্যে নারীর বিনোদন ক্ষমতাও অবশ্য বিচারের বিষয় বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে! তাহলে সমমূল্যের পারিশ্রমিক ও মানবিক পরিবেশের দাবী কি আজো প্রশ্ন চিহ্ন নয়? অথচ পালিত হচ্ছে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” বেশ পরিপাটি করে।
‘কর্মজীবী নারী দিবস’ মানে, শ্রম বিনিময়ের মূল্য নির্ধারিত হয় যাদের সেই সব নারীদের জন্য সংগ্ৰাম। গৃহশ্রমিক নারীদের শ্রমের মূল্য? যা আবহমান কাল ধরে সমাজ, সংসারে ভীষণ প্রয়োজনীয়, আবশ্যকীয়– তার মূল্য নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই? প্রতীক চিহ্ন, সম্পর্কের সুতো চূড়ান্ত করে দেয় সংসারে নারীর শ্রমের অঙ্গীকার। অলিখিত নিয়মে এই শ্রম বলিপ্রদত্ত। সময়ের নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট নেই। কর্মের পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা, অসুবিধা নজরে রাখার দরকার নেই। ইচ্ছে-অনিচ্ছে সে তো আবার ভীষণ দায়- চোখ বুজে থাকলেই হলো। গৃহশ্রম শ্রমের তালিকায় আছে কি না, সেই বিষয়ে আজো সন্দেহ থেকে যায়। সুতরাং শ্রম দান হয়ে যাক (বিনা পয়সায় ভরণ পোষণ তো করছেই সংসার!) শুধু মাত্র অলিখিত চুক্তিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে। সুতরাং গৃহশ্রমিকের শ্রমের মূল্যায়নের কোনো প্রশ্নই আসে না। তাহলে কর্মজীবী নারীরা সম-অধিকারের দাবী নিয়ে প্রশ্ন রাখলে, তারা যখন গৃহশ্রমিক তাদের শ্রমের মূল্যায়ন? আবারো প্রশ্নের মুখোমুখি!
সম্মান জানাতে একটি বিশেষ দিন মনে হয় শুধুই প্রহসন। ওই দিনে কিছু ভালো কথা, একটি ফুলের তোড়া বা একটি গোলাপ ফুল, বহু কষ্টে মনে রেখে একটি চকলেট কিনে দেওয়া কিংবা একটি দামী উপহার “আন্তর্জাতিক নারী দিবসে”র চাহিদার তালিকায় ছিল না। ছিল ‘সম-মান’, ‘সম-অধিকার’ ‘কর্মের জন্য নিরাপত্তা-স্বাস্থ্যকর পরিবেশ’। অনুকম্পা, দয়া, দায়সারা ‘দিবস’ উদযাপন করে নয়। অন্তর থেকে ‘সম- অধিকারে’র স্বীকৃতি যেদিন স্বীকৃত হবে ‘সম-মান’ আপনা হতেই ধরা দেবে মিটিয়ে দেবে সব প্রশ্নের তালিকা। আশায় থাকা যাক আরো কিছু সময়। তাই সার্থকতার স্বাদ নিতে
‘ভরসা থাকুক আটের সাথে / ভরসা রাখি আটের হাতে’