“ঋতু রাজ বসন্ত”

“ঋতু রাজ বসন্ত”
-রাখী চক্রবর্তী

 

আজ ছয় ফাল্গুন ,
আমের মুকুলে সামনের আম গাছটা ভরে গেছে। কৃষ্ণচুড়া গাছটা কি সুন্দর লাল রঙ-এ সেজেছে। কথা তো সেরকমই হয়ে ছিল যে আজকের দিনে আমাদের বাড়ি ঝলমল আলোতে সুসজ্জিত হবে। অতিথি সমাগমে বাড়ি গমগম করবে। বসন্ত আসবে আমার ঘরে আজ। পলাশ, শিমুল, রজনীগন্ধারা একে অপরকে জড়িয়ে মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করবে।
নববধুর সাজে আমি সাজব আজ।বসন্তের অপেক্ষা চিরতরে শেষ হবে। আর কিছুটা সময়। ব্যাস তারপর বসন্তের আঙিনায় আমি বাস করবো। বসন্তের সুবাস গায়ে মাখব।

——হোল রে তোর ব্যাগ গোছানো? ঋতু মা দরজা খোল মা। এই ট্রেনটা না পেলে বিপদে পড়ে যাব মা।

-হ্যাঁ মা,চলো। আমি রেডি। 

-এ, কেমন সাজ তোর। আমি সহ্য করতে পারছি না। ঋতু মা আমার, কথা শোন মা, চুরিদারটা পড়ে নে মা।

-কেন মা আজ তো আমি নববধূর সাজেই সাজব। এ কথাই তো হয়ে ছিল। ঐ দ্যাখো মা পলাশ গাছটা কি সুন্দর সেজেছে ফুলে ফুলে। আমার সাজতে দোষ কিসের, বলো মা।

আমার নাম ঋতুপর্ণা দে। মার মুখে শুনেছি,আমার পাঁচ ভাইবোন মারা যাবার পর, আমি মার কোল আলো করে এসেছিলাম। ঋতু নামটা আমার মার খুব প্রিয়।

এখন ট্রেনে উঠেছি।গন্তব্য– ভেলোর। নিজের জন্য কষ্ট হয় না। বাবা মার জন্য বুকটা ফেটে যায়। সন্তান সুখ কি তাদের ভাগ্যে নেই! কলকাতার ডাক্তাররা বলেছেন আমার হাতে দু’ মাস সময় আছে। আমার ব্রেন টিউমার এখন শেষ পর্যায়।

সত্যি বলছি আমি কিচ্ছুটি বুঝতে পারিনি। কলেজে গেছি। বন্ধুদের সাথে কত মজা করেছি। আমার জীবনে বসন্ত এল যখন মানে বসন্তের ছোঁয়া পেলাম, তখন শান্তিনিকেতনে ছিলাম। বাবার পোস্টিং হয়ে ছিল ওখানে। দোল উৎসবে পুরো শান্তিনিকেতন মেতে উঠেছে। আমরা প্রথম বার দোল উৎসব দেখলাম শান্তিনিকেতনে। হ্যাঁ, দোলের দিনই বসন্তর সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। গোলাপী আবিরে পুরো মুখটা ঢাকা ছিল ওর। মাথা ভর্তি সবুজ আর লাল আবির। বাবার পায়ে আবির দিতে এসেছিল। আমরা নতুন প্রতিবেশী কিনা,
তারপর থেকেই আমাদের একসাথে পথচলা শুরু। কতো প্রতিশ্রুতি, কতো অঙ্গীকার, মন দেওয়া নেওয়া, এখন সব স্মৃতি ।

“বসন্ত নাকি ঋতু ছাড়া অর্থহীন” তাই দু’ বাড়ির সম্মতে আমাদের বিয়ের দিন ঠিক হল। ছয় ফাল্গুন। 
“ঋতু আর বসন্ত এদের বিয়ে, ফাগুন ছাড়া অসম্ভব।” বসন্ত বলেছিল এই কথাটা।

বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আমার জ্বর হয়ে ছিল, কমছিল না। অনেক ডাক্তার দেখালাম। টেস্ট হল সব। ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। সব শুনে বসন্ত বিদায় নিল আমার জীবন থেকে। আমার জীবন স্তব্ধ হয়ে গেল।
তা না হলে আজ তো আমি..

নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে আমি আমার স্বপ্নগুলোকে এখন তাড়াচ্ছি।
-আমার খুব শান্তিনিকেতন যেতে ইচ্ছে করছে মা, একবার নিয়ে যাবে?

ডক্টর রাজকুমার রায়ের ট্রিটমেন্টে আমি এখন আছি। উনি খুব মজার মানুষ
আমার কথা শুনে ডক্টর রাজকুমার বললেন, “চলো আমরা তবে এই বছরের দোল উৎসবটা শান্তিনিকেতনেই পালন করি।”
আমি যেন আমার স্বপ্নগুলোকে অনুভব করতে পারছি নতুন করে। বাঁচা মরার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি মা বাবার মুখের হাসিটা একবার দেখতে চাই।
মার বড় প্রিয় জায়গা শান্তিনিকেতন। মরার আগে একবার সুখের সাগরে ভেসে যাই মা বাবার সাথে।
আর দশ দিন পর বসন্ত উৎসব পালন হবে শান্তিনিকেতনে। আমার অপারেশন হল।এখনও বেঁচে আছি। কতদিন? সেটা জানিনা।

নার্সিংহোম থেকে সোজা শান্তিনিকেতন গেলাম। আমার বসন্ত নীরব। কোকিলের কুহুতান আজ আমার কান স্পর্শ করেনা। মৌমাছির গুঞ্জনে অতিষ্ঠ হয়ে যাই।

“আজ ফাগুন এল সবার ঘরে
আমার ঘর ছাড়া…
বিষাদ তাই মন জুড়ে
ঘড়ির কাটা মাপে মূহুর্তেরা”

আজ লাল হলুদ গোলাপি আবিরে আকাশ ছেয়েছে। আমার জীবন শুধু থমকে গেছে। ভালোবাসার মিছরি ছুড়ি যে আঘাত দিয়েছে তা মনে দগদগ হয়ে এখনও আছে। স্মৃতিতে তাই রক্তক্ষরণ হচ্ছে চলবে তা আজীবন।

আমাদের প্রতিবেশীরা সবাই বসন্ত উৎসবে মেতেছে। আমি আমাদের লনে বসে দেখছি , হঠাৎ দেখি গোলাপি আবিরে মুখ ঢাকা।মাথা ভর্তি সবুজ লাল আবির। যেন বসন্তের প্রতিছবি দেখছি, ইনি তো ডক্টর রাজকুমার হ্যাঁ, আমার দিকেই তো আসছেন উনি। শুভ দোলযাত্রার শুভেচ্ছা বলে আমার কপাল মুখ লাল আবিরে রাঙিয়ে দিলেন।

আমি কিছু না বলেই ঘরে ঢুকে গেলাম।আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।আমার সিঁথি লাল রঙে জ্বল জ্বল করছে ।স্কার্ফটা মাথা থেকে খুলতেই নিজের বীভৎস চেহারাটা জানান দিল, কয়েক দিনের অতিথি মাত্র আমি।

-কি রে ঋতু দরজা খোল। বাইরে আয়।

আমি দরজা খুলে ঘরের বাইরে আসতেই ডক্টর রাজকুমার বললেন আমাকে, “এই ফাগুনেই আমি তোমাকে বিয়ে করব। তোমার বাড়ি ঝলমল আলোতে সুসজ্জিত হবে। অতিথি সমাগমে বাড়ি গমগম করবে।বসন্ত আসবে তোমার মনে। পলাশ শিমুল রজনীগন্ধারা একে অপরকে জড়িয়ে মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করবে।নববধুর সাজ সেজে তুমি অপেক্ষা করবে আমার জন্য। বসন্তের অপেক্ষা চিরতরে শেষ হবে তোমার।”
আমি ভাষাহীন হয়ে গেলাম। সত্যি কি বসন্ত এসে গেছে। আমি আজ দিশেহারা। নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে আমার। মনে হচ্ছে আমার চারপাশে সেই পার্থিব ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে “যদিদং হৃদয়ংমম তদিদং হৃদয়ং তব”।

Loading

Leave A Comment