মাই বেস্ট সেল্ফি
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
‘এখন আমি ভাবি যে সত্যই আমি খুব বোকা ছিলাম এক সময়। আমাকে স্মার্ট করলো আমার ছেলে।’ চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে নীহাররঞ্জন বাবু বললেন।
প্রতিদিন সকালে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে চা পান করা তাঁর অভ্যাস। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী চা বানিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু তাতে মন ভরে না তাঁর। নিজের ছোট বেলার বন্ধু দ্বারিকা প্রসাদ গাঙ্গুলীর সাথে চায়ের চুমুক ও রাজনীতির আলোচনা না হলে সারা দিনটা কেমন ঝিমিয়ে থাকে তাঁর। না, আজ চায়ের চুমুকের সাথে রাজনীতি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। দু’দিন আগে নীহাররঞ্জন বাবুর ছেলে তাঁকে কিনে দিয়েছে একটা স্মার্ট ফোন। সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে নিহাররঞ্জন বাবু আবার বললেন – ‘বহু দিন আগে টি ভি তে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম দ্বারিকা, “কার লো দুনিয়া মুট্ঠী মে।” সত্যি, পুরো দুনিয়াটা মুঠোতেই চলে এলো। এই চায়ের দোকানে বসে যে আমি বিদেশ যাত্রাও করতে পারি, সেটা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমি।’
নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে নতুন স্মার্ট ফোনটা বের করে তিনি নিজের বাল্যবন্ধু দ্বারিকা বাবুকে দেখালেন। স্মার্ট ফোনটা ভালো করে দেখে নীহাররঞ্জন বাবুকে সেটা ফেরত দিয়ে দ্বারিকা বাবু জিজ্ঞেস করলেন – ‘হ্যান্ডেল করতে পারিস তো?’
‘আর বলিস না। গত দু’দিন ধরে ছেলের কাছে সেটাই তো শিখছি। তুই জানিস তো আমার নিজের ফটো তোলাবার কতো শখ ছিল ছোট থেকেই। নিজের ফটো তোলাবার জন্য এবার কাউকে খোশামোদ করতে হবে না আমায়। নিজের ফটো এবার নিজেই তুলতে পারবো আমি।’
কথা শেষ করেই মোবাইলের সামনের ক্যামেরা দিয়ে নিজের একটা ছবি তুলে দ্বারিকা বাবুকে দেখালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন – ‘তুই জানিস দ্বারিকা, এটা কে কী বলে?’
‘না, জানি না।’ বললেন দ্বারিকা বাবু।
‘এটা কে বলে সেল্ফি। তুই একটু কাছে আয় আমার। আমরা দু’জনে এক সাথে একটা সেল্ফি তুলি।’
দারূণ লাগছে, খুব সুন্দর, অপূর্ব, অনবদ্য ইত্যাদি – ইত্যাদি মন্তব্যে মনটা খুশিতে ভরে যায় নীহাররঞ্জন ভৌমিকের। নীহাররঞ্জন বাবু ব্যাবসাদার। কোলকাতার হাতিবাগান এলাকায় মস্ত বড় এক শাড়ির দোকানের মালিক তিনি। আধুনিক প্রযুক্তি থেকে এতো দিন ছিলেন বহু দূর। কিন্তু এই কিছু দিনে ছেলের দৌলতে আধুনিক প্রযুক্তিকে অনেকটাই রপ্ত করতে পেরেছেন তিনি। এখন মনে হয়, জীবনের সত্তরটা বছর যেন অন্ধকারেই কেটে গেল।
‘আমাদের সময় যদি এ সব হতো তাহলে তো আমি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতাম।’ এ কথা আজকাল প্রায় বলেন তিনি। নীহাররঞ্জন বাবু ব্যাবসাদার, তাই প্রচুর লোকের সাথে তাঁর পরিচয়। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতেই কিছু দিনের মধ্যেই বন্ধুর সংখ্যা হাজার ছড়িয়ে গেল। ফেসবুকে নীহাররঞ্জন বাবুর কাজ হলো রোজ নানা ভঙ্গিমায় সেল্ফি তুলে পোস্ট করা। চার শত – পাঁচ শতটা লাইক ও এক শতর ওপরে কমেন্ট দেখে তিনি লাফিয়ে ওঠেন।
‘তুইও একটা স্মার্ট ফোন কিনে নে দ্বারিকা। রিটায়ার করে গেছিস। সারা দিন কোনো কাজ তো নেই তোর। ফেসবুক করবি, খবর দেখবি, কতো কিছু করতে পারবি। খবর দেখার জন্য আর তোকে টি ভি খুলতে হবে না। তুই তো জানিস যে রোজ রাতে খবর দেখা আমার অভ্যাস। এই নিয়ে গিন্নির সাথে প্রায় রোজ ঝামেলা। গিন্নি সিরিয়াল দেখবে আর আমি খবর। স্মার্ট ফোন আসাতে সেই ঝামেলাটা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেল। এখন গিন্নি টি ভিতে সিরিয়াল দেখে আর আমি নিজের ঘরে বসে হাতে এই মোবাইলটা নিয়ে খবর দেখি।’
দ্বারিকা বাবু চুপ থাকেন। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না তাতে সন্দেহ আছে তাঁর।
দিনটা ছিল রবিবার। ঘুম থেকে ভোরে ওঠা নীহাররঞ্জন বাবুর চিরকালের অভ্যাস। সূর্যোদয়ের আগে উঠে ছাদে গিয়ে ব্যায়াম করেন তিনি। এখন ব্যায়াম করেতে যাওয়ার আগে একবার নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে চোখ বুলিয়ে নিতে ভোলেন না তিনি। ঘুম চোখেই নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট দেখতে গিয়ে একটা খবরে নজর গেল তাঁর। কাশ্মীরে জঙ্গীরা নাকি আর্মীর কোনো ক্যাম্পে মাঝ রাতে হামলা করেছে। প্রায় চল্লিশ জন জওয়ান শহীদ হয়েছে। সকালে উঠেই এহেন খবর পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। মন মরা হয় মোবাইলটা রাখতেই পাশের বাড়ি থেকে গলা ফাটানো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। নীহাররঞ্জন বাবু চমকে উঠলেন। কার বাড়ি থেকে আসছে এই বিকট কান্নার আওয়াজ? আর কেনই বা আসছে? হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো দ্বারিকা বাবুর একটি মাত্র ছেলেই তো আর্মীতে কাজ করে। সে আছেও এখন কাশ্মীরে। কথাটা ভেবেই হৃদয় স্পন্দন তীব্র হয়ে গেল তাঁর। বুক টা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাহলে কি কান্নার আওয়াজটা দ্বারিকার বাড়ি থেকেই আসছে? কোনো রকমে গায়ে একটা জামা গলিয়ে ছুটলেন দ্বারিকা প্রসাদ গাঙ্গুলীর বাড়ি। দ্বারিকা বাবুর বাড়ি নীহাররঞ্জন বাবুর বাড়ির পাশেই, দু’টো বাড়ি পেরিয়ে। যেতে বেশি সময় লাগলো না। বাড়ি তে ঢুকেই নীহাররঞ্জন বাবু দেখলেন, দ্বারিকা বাবুর স্ত্রী মাটিতে বসে বুক চাপড়ে আর্তনাদ করছেন এবং ঘরের এক কোণায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দ্বারিকা গাঙ্গুলী। নীহাররঞ্জন বাবু লঘু কদমে নিজের বাল্যবন্ধুর দিকে এগিয়ে গেলেন। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন – ‘কী হয়েছে দ্বারিকা?’
দ্বারিকা বাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন নীহাররঞ্জন বাবুর দিতে। কাঁপা – কাঁপা গলায় বললেন – ‘কাল বিকেলেই দীপকের সাথে কথা হয়েছিল। কিছু দিন পর ছুটি পাচ্ছিল সে। কতো খুশি ছিল।’
কথা বলতে – বলতে থেমে গেলেন দ্বারিকা বাবু। কন্ঠরোধ হয়ে গেলো তাঁর। নীহাররঞ্জন বাবু দাঁড়িয়ে রইলেন ভাবলেশহীন হয়।
দু’ দিন পরের ঘটনা। শহরে দ্বারিকা প্রসাদ গাঙ্গুলীর একটি মাত্র পুত্র শহীদ দীপক গাঙ্গুলীর মৃত দেহ সম্মানের সাথে নিয়ে আনা হলো। কফিনের ভেতর দীপকের মৃত দেহ, যেটাকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করছে নিজের দেশের জন্য শহীদ হওয়া সেই বীর সৈনিকের শেষ দর্শনের। দ্বারিকা প্রসাদ সহ প্রত্যেকের চোখেই জল। নীহাররঞ্জন বাবু নিজের চোখেও দু’ ফোঁটা জল অনুভব করলেন। আর্মীর গাড়ি থেকে যখন কফিনে বন্দী দীপকের মৃত দেহকে নামানো হলো তখন দ্বারিকা বাবু নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ছুটে গেলেন সে দিকে। কফিনকে জড়িয়ে শুরু করলেন বিলাপ। আর্মীর লোকেরা ধরাধরি করে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে গেল। নীহাররঞ্জন বাবু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এ সব দৃশ্য দেখছিলেন। হঠাৎ কি একটা ভেবে এগিয়ে গেলেন কফিনের দিকে। তিনি প্রথম বার কোনো শহীদের কফিন দেখছেন। কফিনের ভেতর যার মৃত দেহ সে এখন তাঁর বাল্যবন্ধুর একটি মাত্র সন্তান নয়, সে এখন দেশের জন্য শহীদ হওয়া এক বীর সৈনিক। এ মুহূর্তে দেশের জন্য শহীদ হওয়া সৈনিকের মৃত দেহের সামনে দাঁড়ানোটা গর্বের বিষয় মনে করলেন তিনি। দু’ হাত দিয়ে কফিনে ঢাকা সেই দেহকে প্রণাম করলেন তিনি এবং নিজের প্যান্টের পকেট থেকে বের নিজের স্মার্ট ফোন।
‘লোকেরা অনেক সেল্ফি তোলে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, খেলোয়াড়ের সাথে, সিনেমার হিরো – হিরোইনের সাথে। কিন্তু ক’ জন শহীদের সাথে সেল্ফি তোলার সুযোগ পায়? আমার সৌভাগ্য যে আমি এই সুযোগ পেলাম। এই সুযোগকে হাতছাড়া করা চলবে না। অনেক সেল্ফি তুলেছি আমি, কিন্তু এটাই হবে আমার বেস্ট সেল্ফি।’
কথাটা ভাবা মাত্রই নিজের স্মার্ট ফোনের সামনের ক্যামেরাটা অন করলেন নীহাররঞ্জন বাবু। অসংখ্য লাইক – কমেন্টের আশার মাঝে একটা শব্দ শোনা গেল – ক্লিক।
সে দিনটাই ছিল নীহাররঞ্জন বাবুর smartস্মার্ট ফোন ব্যবহার করার শেষ দিন। এতো লাঞ্ছনা তাঁকে আগে কোনো দিন সহ্য করতে হয়নি। ছবিতে একটাও লাইক না পড়লেও কমেন্ট পড়েছে প্রচুর। এমন কমেন্ট যেগুলো পড়ে নীহাররঞ্জন বাবুর নিজের ওপরেই ঘৃণা হয়ে গেল। দ্বারিকা বাবুর বাড়ি তে সান্ত্বনা দিতে যাওয়া তো দূরের কথা, ওনার সামনে পর্যন্ত যেতে পারেননি তিনি। সেল্ফি তোলার নেশা তাঁকে আজ প্রায় গৃহ বন্দী করে রেখে দিয়েছে। নিজের মোবাইলের দিকে তিনি আজকাল তাকিয়ে থাকেন এবং ভাবেন – ‘এই স্মার্ট ফোনটা আমার জীবনে না আসলেই ভালো হতো। আমার বেস্ট সেল্ফি আমার ওয়ারস্ট সেল্ফি হয়ে গেল।’
সমাপ্ত।