Site icon আলাপী মন

মৃত্যুঞ্জয়ী

মৃত্যুঞ্জয়ী
-সুজাতা দাস

 

হঠাৎ করে পায়ের পাতাটা ভিজে ডুবে যাচ্ছে বলে একটু অবাক হলো মৈত্রেয়ী -জল! জল কোথা থেকে আসছে! অবাক হতে থাকলো।
এদিকে জল একটু একটু করে, পায়ের পাতা ছাড়িয়ে উপর দিকে উঠছে- এতো জল কোথা থেকে আসছে! ভাবতে ভাবতেই কোমর ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠতে থাকলো।
এবার আর অবাক নয়, একটু একটু করে ভয় গ্রাস করতে শুরু করেছে মৈত্রেয়ীকে। আরও উপরে উঠছে জলস্তর, ডুবতে শুরু করলো মৈত্রেয়ী। বাঁচার জন্য হাত পা ছুঁড়ছে কিন্তু কিছুতেই বেরতে পারছে না। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকলো শরীর। হু হু করে জল ঢুকছে নাক মুখ দিয়ে, শেষের শেষ শক্তি দিয়ে যখন প্রাণপণ শক্তিতে ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করতে চাইলো মৈত্রেয়ী! ঠিক সেই সময় একটা হাত মৈত্রেয়ীকে টেনে ধরলো। আর মৈত্রেয়ীও চোখ বন্ধ করলো শেষ বারের মতো।
তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ যেন একটা ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেল মৈত্রেয়ী
– কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে-মিতু উউউউ..
হঠাৎ ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠে বসলো মৈত্রেয়ী। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এখনও নাকে মুখে জল ঢুকে যাবার কষ্টটা অনুভবে রয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট লাগছে। একটা কষ্ট আর ধাক্কার বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে সময় নিল কিছুক্ষণ।আগাগোড়া মনে করার চেষ্টা করলো ঘটনাটা।
আবার ডাকে; সম্বিত ফিরল মৈত্রেয়ীর। অবাক হয়ে দেখলো বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দৈপায়ণ। মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, অবেলাতে ঘুমোচ্ছিস কেন মিতু?

-জানি নাতো কেমন যেন জ্বর জ্বর লাগছিল শরীরটা। তুমি কোথা থেকে?

– খবর দাওনি! বার বার কেন জ্বর আসছে মিতু? কাশিটাও তো এক রকমই রয়েছে। একটুও কমেনি!
একটা আলতো হাসি ছড়িয়ে পরলো মৈত্রেয়ীর মুখে- আজ রিপোর্টগুলো পেলে বোঝা যাবে, বলল মৈত্রেয়ী। 

আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি দীপু, বললো মৈত্রেয়ী।
দৈপায়ণ মনে মনে অনেক কিছু ভাবলেও মুখে বললো, তোমার জন্য..
ছোট থেকেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা কেমন করে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছিল আজও জানেনা দু’জনেই। বাড়িরও অমত নেই দু’জনেরই। সবে মাত্র তিন মাস চাকরিতে জয়েন করেছে দৈপায়ণ। দুই বাড়িতে কথাবার্তা যাওয়া আসা সব সারা খালি বিয়ের দিনটাই ঠিক হতে বাকি। হঠাৎ করে এরমধ্যে মৈত্রেয়ীর শরীর খারাপ শুরু হলো।
বাড়ির সকলের সাথে সাথে, দৈপায়ণদের বাড়ির সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
রাতে ডঃ অরূপরতন ব্যানার্জীর কথা শুনে দৈপায়ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুটেই বললো, এ হতে পারে না। কেমন করে এতো বড় একটা অসুখ এতদিন চাপা পড়ে রইলো। একদিনের জন্যও তো বোঝা যায় নি!
প্রথমে বোঝা গেলে হয়তো কিছু করা যেত, বললেন ডাক্তার ব্যানার্জী। তবুও চেষ্টা করতে তো অসুবিধা নেই, তারপর ভগবান..
খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত ব্যবস্থা করে ভর্তি করা হলো মৈত্রেয়ীকে টাটা সেন্টারে। চিকিৎসা শুরু হলো কেমোথেরাপি। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে একদিন মৈত্রেয়ী দৈপায়ণকে বললো সেই মাঝে মাঝে দেখা স্বপ্নটার কথা, অনেক কষ্ট করে।
অবাক হয়ে শুনেছিল দৈপায়ণ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল; ঐ হাত ধরেই তোকে টেনে তুলবো আমি। ছেড়ে যেতে দেবনা কিছুতেই তোকে মিতু।
মুখে বলেছিল শক্ত করে ধরে থাকিস আমাকে। হাতটা ছাড়িস না আমার মিতু। আমি তোকে ডুবতে দেব না কিছুতেই তুই দেখিস!
আজ এক বছর বাদ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বিয়ের সাজে দাঁড়িয়ে আছে মৈত্রেয়ী দৈপায়ণের অপেক্ষায়। সেই শক্ত করে ধরে থাকা হাতটা ডুবতে দেয়নি। একটা লাং ক্যানসারের রোগীকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করেছে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে। বিয়ের পিঁড়িতে বসে একটা আলতো হাতের ছোঁয়া বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল মৈত্রেয়ীকে; ভালোবাসা অনেক শক্তিশালী।
যা জুড়ে রাখে দু’টি মানুষকে।
সমাপ্ত——

Exit mobile version