উপহার
-রাখী চক্রবর্তী
“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”
-রোজ তোমার এই এক গান
কেন মা বিদেশের মাটি কি দোষ করল। তুমি কি এখানে ভালো নেই?
তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে বলো আমাদের।
-আমাকে একবার আমার জন্মভূমিতে নিয়ে চল।আমি ভারতের বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাই।
-না মা। এটাই আমাদের কাছে স্বর্গ। কি দিয়েছে আমাদের জন্মভূমি। প্রতারণা, লাঞ্ছনা। এখানকার মতো সুখ দেশের বাড়িতে কোনদিন তুমি পেয়েছো।
বাবা কৃষক ছিল। আমাদের জমিতে কত ফসল ফলতো। তুমি সারাদিন পরিশ্রম করে আমাদের দু’ভাইকে পড়াতে বসতে। গায়ের মোড়ল কৃষ্ণপদ দে অন্যায় ভাবে আমাদের জমি দখল নিল। বাবার সেই করুণ মুখ আজও ভুলিনি মা। আমাদের জন্ম ভিটে হাতছাড়া হয়ে গেল। পথে পথে ঘুরেছি বাবার সাথে আমরা।
কেন মা তুমি ফিরে যেতে চাইছো তোমার জন্মভৃমিতে?
-আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এখনও কি ছোট্ট বাচ্চাকে ঘুম পারানি গান গেয়ে ঘুম পারায় ওর মা? এখনও কি নবান্ন উৎসব পালন হয়? এখনও কি সন্ধ্যা বেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালায় গৃহবধূরা? খুব দেখতে ইচ্ছে করতে আমার গ্রামকে।তোদের ইচ্ছে করে না তোর বাবার সম্পত্তি ফিরে পেতে? একবার দেশে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে না তোদের? আমার তো করে!
মালতীদেবীর দুই ছেলে আজ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। দেশের প্রতি ওদের কোন টান নেই। ওরা পুরনো কথা মনে রাখতে চায়না।দুই ছেলে স্বামীকে নিয়ে মালতীদেবী কষ্টে জীবন কাটালেও ভালো ছিলেন। কৃষক পরিবারে তিল তিল করে মানুষ করছিলেন তার দুই ছেলেকে।গ্রামের মোড়ল কৃষ্ণ পদ দে যখন তাদের ভিটে মাটিটুকু কেড়ে নিলেন, তখনও তিনি ভেঙে পড়েন নি। বরং সাহস জুগিয়েছেন স্বামীকে। দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছেন তবুও জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাননি মালতী দেবী।
এক ঝড় বৃষ্টির রাতে মাথায় বাজ পড়ে মারা যান ওনার স্বামী । সেই রাতটা ছিল ওনাদের কাছে সবচেয়ে গভীর রাত।মালতীদেবী তার স্বামীকে দাহ করে দুই ছেলেকে নিয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্য রওনা দিলেন, তখনই ঘটনা চক্রে স্বামী যোগেন্দ্রনাথ মহাশয়ের সাথে ওনার যোগাযোগ হয়। তারপর থেকে ওদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আজ কত বছর হয়ে গেল, জন্মভূমির স্বাদ মালতীদেবী পাননি।
এই ভাবেই দিন মাস বছর কাটে মালতীদেবীর। হঠাৎ একদিন সুজয় মানে মালতীদেবীর বড় ছেলে বলল,মা আমরা এবার যাব আমাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে আনতে আমাদের গ্রামে। মালতীদেবীর মুখ চিকচিক করে উঠল এক অজানা আনন্দে। সত্যি ছেলেদের তিনি মানুষ করতে পেরেছেন। তা না হলে মার সুখের কথা ভাবছে কেন ছেলেরা।।।
দীর্ঘ কুড়ি বছর পর গ্রামের মাটিতে পা রাখলেন মালতীদেবী ও তার সন্তানরা। সেই রোদ ঝলমলে দিন। উদাসী বাউলের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান, পুকুরে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ঝাঁপানো, মুরগীর লড়াই যা দেখে সুজয় বিজয় খুব ভয় পেত। ধানের গোলায় উপচে পড়া ধান, মালতীদেবী দু’চোখ ভরে দেখছেন ।
কিছু শঙ্কাও ওনার মনের মধ্যে আছে সেটা হল ওনার শ্বশুরের ভিটে কি আজও একই রকম আছে। সেই তুলসী মঞ্চ, রাধাকৃষ্ণের মন্দির। মাটির প্রলেপ দেওয়া দাওয়া। ঘরের চালের ওপর পুঁই লাউয়ের লতানো ডাল,না, কিছু তো পাল্টায় নি। সব তো আগের মতোই আছে।
-বিজয় এটা তো আমাদের বাড়ি একই রকম আছে ,তবে কি মোড়ল সব ফেরত দিয়ে দিল?
-না মা মোড়ল কিছু ই ফেরত দেয়নি। আমরা মোড়লের সাথে কোর্টে লড়ে জিতেছি। তোমাকে কিছু জানাইনি। অনেক বছর ধরে লড়াই করে শেষে সত্যের জয় হল মা। তাই তো তোমাকে তোমার জন্মভূমিতে নিয়ে এলাম। তোমার হাসিমুখ দেখব বলে তোমাকে এত বছর কাঁদিয়েছি মা। তোমার জন্মভূমি যেমন তোমার কাছে প্রিয় আমাদের ও কাছে আমাদের জন্মভূমি প্রিয়। এবার থেকে আমরা এখানেই থাকব মা। তোমাকে এই উপহার দেব বলে অনেক অনেক দিন ধরে দিন গুনেছি মা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল মা, ঐ দেখ পাখিরা বাসায় ফিরছে।
সন্ধ্যা বেলায়
তুলসী তলায়
প্রদীপ জ্বালায়
আমার মা।
এসো মা
তোমার সেই প্রিয় গানটা একসঙ্গে করি
“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”