দেখছি নাথবতী অনাথবৎ
-সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী
অধোবদনে কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম পিতামহ,
নির্লজ্জ স্তব্ধতায় আচার্য্যগণ,
দিগ্বিদিক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য উদ্ধত গান্ধারী পুত্রগণ!
একি লাঞ্ছনা, একি অপমান,
প্রতিহত করার ব্যক্তিত্ব অনুপস্থিত,
নিদারুণ করুণ নিগীর্ণ ঘৃণ্য এক দৃশ্যের সাক্ষী মহাভারত,
সমগ্র মহাভারতের ভারতবাসী নিগড়িত নারীনিগ্রহ বীক্ষণে!
কুরুরাজদ্বারে নীরব প্রার্থনায় পঞ্চপান্ডবপ্রিয়া
দ্রুপদনন্দিনী ,
যিনি নন খর্বা, নন যিনি কৃশা,
যিনি অতীব সুন্দরী, নন যিনি যোণিসম্ভূতা,
পিতৃবীজে নন যিনি উৎপন্না মাতৃজঠর যজ্ঞে,
যিনি হোমাগ্নি উদ্ভূতা, তিনি কৃষ্ণা যাজ্ঞসেনী,
গরিয়সী আপন গরিমায়,
তাঁর নারীত্বের অবমাননায়,
অপমানিত মানবেতিহাসের এক অধ্যায়।
একবস্ত্রা ঋতুমতী কৃষ্ণসখী রজঃস্নানের পূর্বাহ্নেই
বিক্ষত অন্তরে উষ্ণ শোণিতধারায়।
প্রথম পান্ডব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির পাশাপণে পরাজিত
বিজিগীষায়।
কী চূড়ান্ত নির্লজ্জ স্বামীত্বের প্রকাশে,
দানে হারেন স্ত্রী সম্পদরূপিণী দ্রৌপদীকে
নিরাবরণ অমিত্র বিতংসে।
যাঁকে লাভ করেছিলেন মাতৃআজ্ঞা দানে,
তৃতীয় পান্ডবই একমাত্র ছিলেন
যাঁর দয়িত হবার দাবিদার স্থানে।
স্বেচ্ছায় বহুগামিনী পৃথার আদেশে বরি পঞ্চপতি
পাঞ্চালির শিরোভাগে তকমা ‘বহুগমনে অসতী’।
ধিক অন্তঃপুরবাসিনী মাতাকুন্তী,
ধিক কৌন্তেয়গণ শূর বীর অতি।
বাহুবলী পবননন্দনের কৃচ্ছ্র সীমাবদ্ধতা
কেবল দন্তসারির নিষ্ফল নিষ্পেষণে ।
বৃহন্নলা রূপধারণের পূর্বেই
গান্ডীবধারী পার্থ রূপান্তরিত নির্বীর্য নপুংসকে।
মাদ্রী আত্মজেরা কি যথেষ্ট পৌরুষলাভে অপারগ
জন্মকালে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের অপর্যাপ্ত বীর্যে?
যত রথী মহারথী প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ সভাস্থলে পারিষদ দল
নীরব দর্শক মাত্র!
এক নাথবতীর অনাথবৎ হওয়ার দুঃসহ দৃশ্যায়নে
লোলুপ অঙ্গরাজ মার্তন্ডেয় কর্ণসহ কুরু ভ্রাতাগণে
ধর্ষকামে উল্লসিত!
বিকট অপচিকীর্ষার প্রদর্শনে!
আরক্ত আনত পাঞ্চালির প্রতি অপচার,
অনাথা নাথবতীর নিঃশব্দ ক্রন্দন হাহাকার,
ব্যথিত, লজ্জিত ব্যতিক্রমী বিকর্ণ অসহায় সোচ্চার দর্শনে পিতা ধৃতরাষ্ট্র ও মাতা গান্ধারীর
ভিতর ও বাহিরের অন্ধত্বের বিকার।
তথাপি বিরত নহে কেহ নিষ্ঠুর অভীপ্স সাধনে,
আজও নাথবতীরা অনাথবৎ হয়,
মহাভারতের মহাদৃশ্যকাব্য অবতারণে।
তবু একজন ছিলেন হস্তিনাপুরে……সখা কৃষ্ণ,
কৃষ্ণার লজ্জা নিবারণে।
যুগে যুগে কালে কালে দিকে দিকে পুনরাবৃত্তি
ঘটে আজও এ অনিষ্ট পদে পদে,
নাথবতীরা অনাথবৎ হয়ে আকূল আহ্বানে খোঁজে
ত্রাতারূপী কৃষ্ণসখারে বিষম বিপদে।।