Site icon আলাপী মন

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি

-নীলকান্ত

 

রাত তখন ঠিক আটটা । দরজায় শেষ বারের মতো টোকা পড়ল । বিনয় এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল । যা ভেবেছিল ঠিক তাই, রমেন এসেছে । ওকে ভিতরে আসতে বলল, তারপর আবার দরজাটা দিয়ে খিল আটকে দিল । বলল, “চল ভিতরে চল” । রমেন ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইল, “কিরে কি হয়েছে ? এভাবে ডেকে পাঠালি কেন” ? বিনয় শান্তভাবে বলল, “ভিতরে চল বলছি” । ওর গলাটা এতই শান্ত লাগল যেন প্রচন্ড ঝড়ের পর স্থির হয়ে থাকা পুকুরের জল, যেখানে রাতের তারার প্রতিবিম্ব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে । রমেন আর কথা বাড়াল না, লম্বা বারান্দা পেরিয়ে বিনয়ের পিছু পিছু ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকল । অবাক হয়ে দেখল রাজদীপ আর রঞ্জন আগেই এসে বসে আছে । কিন্তু ওরা এখানে কেন ?! ওদের দেখে বিনয়ের উদবিগ্নতা আরো বেড়ে গেল কি এমন হয়েছে ! ওদের মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে ওর কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয় শিরদাঁড়া দিয়ে নামতে শুরু করল । তার অনুভব বলল নিশ্চই ভীষণ কিছু একটা ঘটেছে । বিনয়ের নির্দেশ মতো গোলটেবিলের পাশে রাখা একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল । বিনয় একটা কাঠের আলমারির ভীতর থেকে একটা বড় হুইস্কির বোতল আর চারটে গেলাস বের করে টেবিলের উপর রাখল । তারপর আগের মতই শান্ত স্বরে বলল, “ওদের আগেই বলেছি, তুই পরে এসেছিস তাই আবার বলছি” । বোতলের ছিপি আলগা করে গেলাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলল, “শুচি, মানে শুচিস্মিতা, আজ আর আমাদের মধ্যে নেই” । রমেন লাফিয়ে উঠে বলল, “হোয়াট ?! নেই মানে ? আর ওর কথা এতদিন পরে ……” । ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই বিনয় বলল, “কাল রাতে ও সুইসাইড করেছে । এখন ওর বডিটা মর্গের ঠান্ডা কফিনে শায়িত । আইনত ও এখনো আমার স্ত্রী, তবে মৃত” । সকলের দিকে গেলাসগুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “চিয়ার্স ! এটা ওরই সৌজন্যে । মারা যাবার আগে ও একটা চিঠি লিখে গেছে যেখানে আমাদের চারজনকেই ও দোষী সবস্ত করে গেছে, তবে কোন বিচার ও চায়নি । শুধু অনুরোধ করেছে ওর মৃত্যুর পর আমাদের বিষয়টা খতিয়ে দেখতে । যদি আমাদের মনে হয় ওই ঠিক তবেই ওর আত্মা শান্তি পাবে” । রমেন বলল, “এর জন্য তুই এভাবে আমাদের ডেকে আনলি ? ওর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই । আমি চললাম” । বিনয় আরো শান্ত অথচ কঠিন গলায় বলল, “ধীরে বন্ধু ধীরে । আমি তো বললাম যে আইনত আমিই এখনো ওর স্বামী । তাই ওর শেষ ইচ্ছা পুরনের দায়িত্বও আমার । তুই চাইলে চলে যেতেই পারিস তবে সেক্ষেত্রে আমি ওই চিঠিটা পুলিশের হাতে তুলে দেব । এখন ভেবে দেখ থাকবি না যাবি” । রমেন শান্ত হয়ে বসে পড়ল, মনে হল যেন একটু ভয় পেয়েছে । জিজ্ঞাসা করল, “তুই কি করতে চাস” ? বিনয় বলল, “ কিচ্ছু না, আমারা শুধু অতীতের পাতা থেকে সেই ঘটনাগুল তুলে এনে বিচার করতে চাই সত্যিই আমারা অপরাধী কিনা । তাতেই আমার স্ত্রীর আত্মা শান্তি পাবে । বল তোরা রাজী কিনা” ? সবাই ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল । রমেন বলল, “যত্ত সব ঝামেলা, কিন্তু কি করা যাবে আর । পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে” । বলেই ঢকঢক করে গেলাসটা খালি করে ফেলল । বিনয় বলল, “বেশ, তবে রাজদীপই শুরু করুক” । রাজদীপ মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে শুরু করল —–

আজ আমরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বাস করলেও একসময় আমারা এই গ্রামেই থাকতাম । একই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা, একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা । একসঙ্গে কত দিন কত রাত কাটিয়েছি । আমাদের অন্তরঙ্গতা দেখে সবাই হিংসা করত, তোদের মনে আছে নিশ্চই । তারপর উচ্চমাধ্যমিকে আমি আর রমেন বিজ্ঞান আর রঞ্জন আর তুই কলা বিভাগে ভর্তি হলি । কিন্তু আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব একটুও শিথিল হয়নি । বরং তা আরো বেড়ে গিয়েছিল । একইভাবে আমারা উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর একই মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হই । আমি বায়োলজিতে, রমেন পদার্থবিদ্যায়, রঞ্জন ইংরাজিতে আর তুই বাংলায় সাম্মানিক নিলি । বেশ চলছিল, পড়াশোনা, খেলাধুলা, হাসিঠাট্টা । সবই ঠিকঠাক ছিল । গোল বাধল ‘কলেজ সোশালের’ দিন । সেদিনই প্রথম শুচিকে দেখলাম । যেমন গানের গলা তেমনই নাচের মুদ্রা । রূপ যেন অঙ্গ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে । ঠিক যেন রুপকথার পাতা থেকে উঠে এসে আমাদের সামনে নৃত্য পরিবেশন করে গেল । সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল । মনে হল ও যেন আমার কত কাছের । ওকে আরো কাছে পেতে চাই । তোদের লুকিয়ে মঞ্চের পিছনে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করে এলাম । করমর্দনের সময় একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ খেলে গেল আমার সারা শরীর বেয়ে । বাইরে এসে দেখি তোরা আমায় দেখে হাসছিস । বলছিস, “কিরে প্রেমে পড়ে গেলি নাকি’ ? আমি চেঁচিয়ে বলেছিলাম, “হ্যাঁ তাই । ইয়ার্কি করবি না” । তারপর ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম তোদের কাছ থেকে । পরদিন ছিল রবিবার । সকাল দশটায় এঁদোপুকুরের পাড়ের আশফল গাছের নীচে সবার আসার কথা ছিল । মন চাইছে ছুটে চলে যেতে তোদের কাছে কিন্তু গতদিনের ঘটনার লজ্জা পিছন থেকে টেনে ধরছিল । শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বই জয়ী হয় । গিয়ে দেখি শুধু আমি নয় তোদেরও সবার একই অবস্থা । তোরাও মনে মনে মরেছিস । আর সেটাই তো স্বাভাবিক । কিন্তু আমি বললাম, আমি আগে ওর কাছে গেছি তাই দাবিটা আমার বেশী । তোরাও তা অস্বীকার করিস নি সেদিন । বরং বিনয়, তুইই বলেছিলি যে শুধু আমাদের কথা ভাবলেই হবে না, মেয়েটার কথাও ভাবতে হবে । এমনও তো হতে পারে যে ওর আগে থাকতেই অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে । তার চেয়ে বরং আমরা ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশব, আর যদি আমাদের মধ্যে কাউকে ওর ভাললাগে তবে সেই ওর জীবনসঙ্গিনী হবার অধিকার পাবে । তাতে আমাদের বন্ধুত্বও অটুট থাকবে আবার ওকেও হারাতে হবে না । এইভাবেই আমারা ধীরে ধীরে একটু একটু করে ওর সঙ্গে মিশতে শুরু করলাম । শুচিও আমাদেরসঙ্গে বন্ধুর মতই মিশতে শুরু করল । কিন্তু আমার কথার মাধুর্যে আর রূপে প্রভাবিত হয়ে ও প্রথম আমার দিকেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে । একদিন আমিই ওকে প্রথম প্রস্তাব দিই । সেদিন ছিল রবিবার । সুমন মাস্টারের কাছে পড়তে আসত ও দুপুর বেলায় আমি জানতাম । আমি আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম । ও আসলে আমি ওকে আটকাই তারপর একটু ইতস্তত করে হঠাৎই কথাটা ওকে বলে ফেলি । আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে ও এত সহজে সব মেনে নেবে । সেদিন ও জানতে চেয়েছিল আমাদের ভবিষ্যৎ কি । আমি বলেছিলাম আমি ডাক্তারি পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি, সামনের জয়েন্টে নিশ্চিত ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাব আর একবার পাশ করতে পারলে সেও নিজেকে ডাক্তারের স্ত্রী বলে গর্ব অনুভব করতে পারবে । আমাদের মেলামেশা আরো বেড়ে যায় । আমি সত্যিই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে যাই । ও নিজের বাড়িতে আমার কথা জানায়, কিন্তু ওর বাবা মা আমার ব্যক্তিত্বে, আমার শিক্ষায় ভরসা রাখতে পারেননি । তারা ছিলেন একটু গোড়া প্রকৃতির । তাই ব্রাক্ষ্মনের মেয়েকে একজন জেলের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন । ও আমার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিল । কিন্তু আমি রাজী হই নি, চাইনি আমার বা ওর বাবা মাকে কষ্ট দিতে । একরাশ দুঃখ নিয়ে চোখের জলে বিদায় জানিয়ে চলে গিয়েছিলাম ডাক্তারি পড়তে । ওর দিকটা দ্বিতিয়বার ভাবার মত অবকাশ ছিল না আমার । জানতেও চাইনি ওর কি হবে । আমি আজও ওকে ভালবাসি তাই আজও অবিবাহিত । কিন্তু কাউকে ভালবেসে তাকে মাঝপথে ছেড়ে চলে যাবার মত কাপুরুষতা আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায় । ওর জীবনে প্রথম আঘাতটা আমিই দিয়েছিলাম । আমি ডাক্তার হয়েছি কিন্তু নিজের কাছের মানুষটাকে শান্তি দিতে পারিনি । আমি অপরাধী, আমি স্বীকার করছি আমার অপরাধ । রাজদীপ চোখের জল মুছতে লাগল ।

বিনয় মাঝে মাঝেই গেলাসে মদ ঢেলে দিচ্ছিল । সকলেই নিশ্চুপ, নিস্তব্ধতা এমন যেন একটা আলপিন পড়ার আওয়াজও শুনতে পাওয়া যাবে । এবার রমেন নিজেই একটানে গেলাসের মদ শেষ করে চিৎকার করে উঠল – আমার কোন দোষ নেই । আমি অপরাধী নই । আমি তো ওকে বিয়ে করতেই চেয়ে ছিলাম । কিন্তু ওর মত অহংকারী মেয়েরা কোনদিন সুখী হয় না, তাই শুচিও সুখী হয় নি । আমার ইঞ্জিনিয়ারীং পড়ার ক্ষতি করেও ওর কাছে ছুটে আসতাম ওর মনোবল বাড়ানোর জন্য । পাগলের মতো ভালবাসতাম ওকে । একটু হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম । আমাদের দু বাড়ি থেকেই বিয়ের সব কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল । যখন ওর থেকে দূরে থাকতাম তখন ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম । মনে মনে ওকে আমার রানী করে রেখেছিলাম । কিন্তু একটা ছোট্ট ভুল সব শেষ করে দিল । সেদিন কলকাতার হস্টেল থেকে ফিরে সোজা ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম । সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না । ওর বাবা মা কোথায় যেন একটা গিয়েছিল, বোধহয় ওর মাসির বাড়ি । আমাকে দেখে ও উৎফুল্ল হয়ে উঠল । দুপুরে এসেছি বলে আমার খাওয়া হয় নি জেনে আমায় যত্ন করে খাওয়াল । তারপর আমি আর ও ওর ঘরের বিছানায় গিয়ে বসলাম । ওর হাতটা হাতে ধরে গল্প করছিলাম । হঠাৎ অন্ধকার করে জোর বৃষ্টি নামল সঙ্গে বিদ্যুতের বিভৎস আলো আর প্রাণঘাতি আওয়াজে ও কেঁপে কেঁপে উঠছিল । হঠাৎ কাছেই কোথাও প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ল, ও জড়িয়ে ধরল আমাকে । আমার শরীরে স্পন্দন খেলে গেল । নিজেকে হারিয়ে ফেললাম । তারপর যখন জ্ঞান ফিরল বুঝলাম আমি ওর সাথে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করে ফেলেছি । ও কাঁদছিল আর আমাকে চলে যেতে বলছিল । আমি যেতে চাইনি । তোরা বিশ্বাস কর ওটা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না । আমি অনেক বুঝিয়ে ছিলাম, বলেছিলাম আমি সব কিছুর দায় নিতে রাজী । তবু ও আমাকে ক্ষমা করে নি । বলেছিল যার নিজের উপর নিয়ন্ত্রন থাকে না তার সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব নয় । আমি যেন আর কোনদিন ওর মুখোমুখি না হই । তোরাই বল আমার দোষ কোথায় ? ওই ঘটনার কথা মনে রেখে আমি আজও বিয়ে করি নি । আমার মনে ওর জায়গায় আর কাউকে বসানো সম্ভব নয় ।

কিছুক্ষন সবাই নিশ্চুপ । তারপর রঞ্জন ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ও খুব অভিমানী ছিল, ভীষণ প্রখর ছিল আত্মসম্মান বোধ । যখন জানতে পারলাম রমেনের সাথে ওর আর কোন সম্মন্ধ নেই, কোন এক অজানা কারনে বিয়েটা ভেঙে গেছে । তখন একদিন আমি ওর সাথে দেখা করলাম । ও আগের মতই খুশী হল, নানান গল্পের মধ্যে কেটে গেল অনেকটা সময় । এক সময় আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম রমেনের সঙ্গে বিয়েটা কেন হল না সেই ব্যপারে । প্রথমে ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইল । কিন্ত আমিও নাছোড়, অবশেষে ও মুখ খুলল । শোনাল সেই ভয়ংকর দিনের কথা । একথাও জানাল যে রমেনের ভুল সে তার শরীরে বহন করছে, একটু একটু করে বেড়ে উঠছে সে । আমি অত্যন্ত ব্যথিত হলাম, সমব্যথী হয়ে রমেনের ভুল স্বীকার করেও ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন ও রমেনকে বিয়ে করল না । এক্ষেত্রে সবাই তো তাই করে । ও বলেছিল আমি যেন ওকে আর সবার সঙ্গে তুলনা না করি । যে ব্যক্তি আবেগ আর উত্তেজনার বশে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তার সঙ্গে আর যাই হোক সংসার করা যায় না । আমি তখন ওকে আমাদের সবার কথা খুলে বললাম । ওকে দেখা ও ভালোলাগার কথা আমাদের চুক্তির কথা সব বললাম । তারপর সরাসরি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম । ও জানতে চেয়েছিল এটা আমার দয়া কিনা । আমি তখন ওকে বুঝিয়ে বলি না এটা কোন দয়া নয় । আমার যায়গায় বিনয় থাকলেও একইভাবে তোমার দিকে এগিয়ে আসত । আসলে তুমি যে আমাদের অন্তরের গভীরে বাসা বেধেছ । আমি ওর সন্তানকে স্বীকৃতি দিতে রাজী হলাম । ও আমায় বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে যেদিন আমি ওকে ওর অতীত নিয়ে খোঁচা দেব বা অপমান করব সেইদিনই কিন্তু ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে । আমি ওর শর্তে রাজী হয়ে গেলাম । খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেল আমাদের । বিনয় তোকে তো বিয়েতে নিমন্ত্রন করেছিলাম, তুই এসেওছিলি । তুই তো এসব জানিস । যথাসময়ে ওর একটা ফুটফুটে ছেলে হল, নাম দিলাম পবিত্র । আমরা খুব সুখে ছিলাম । পবিত্রকে কখনো অন্যের সন্তান বলে মনেই করি নি । তাই আর কোন সন্তান নেবার চিন্তাও জাগেনি মনে । পবিত্রর পড়াশুনা শুরু হল ইংরাজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে । ও যত বড় হতে লাগল ওর বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষন বেড়ে যেতে লাগল । আমি ভীষণ খুশী ছিলাম তাই নিয়ে । মনে মনে ভাবতাম ওকে আমি ওর বাবার থেকেও বড় ইঙ্গিনিয়ার তৈরি করে দেখিয়ে দেব যে আমিও কোন অংশে ওর থেকে কম নই । একবার ফাইনাল পরীক্ষায় ও ইংরাজিতেই খুব খারাপ ফল করল । শুচি এর জন্য আমাকেই দোষারোপ করতে শুরু করল । আমি নাকি ওকে ঠিক করে পড়াই না তাই ও এত খারাপ করেছে । যার বাবা ইংরাজি গুলে খেয়েছে তার ইংরাজিতে এত খারাপ ফল ! কথায় কথায় বিতর্ক বাড়তে লাগল । আমারা দুজনেই উত্তেজিত হয়ে রীতিমত ঝগড়া শুরু করে দিলাম । কথায় কথায় হঠাৎ আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল যে আমি ওর বাবা হলে ও কখনই ইংরাজিতে খারাপ করত না, ওরা বাবা বিজ্ঞানের ছেলে তাই বিজ্ঞানে তো ভাল হবেই । বলেই আমার ভুল বুঝতে পারলাম । কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছে । ও স্তম্ভিত হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর শুয়ে পড়ল । আমি অনেক বোঝানর চেষ্টা করলাম, ক্ষমা ভিক্ষা করলাম কিন্তু ও একটিও কথা বলল না । পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি পবিত্রকে নিয়ে ও কোথায় যেন চলে গেছে । একটি কাগজে শুধু লিখে রেখে গেছে, – তুমি চুক্তিভঙ্গ করেছ তাই আজ থেকে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল । আমি তোমাকে মুক্তি দিয়ে গেলাম । আমাকে আর পাবার চেষ্টা কোর না । কিন্তু আমি তো মুক্তি চাইনি । অনেক বার গেছি ওদের বাড়িতে, ওর নির্দেশে কেউ আমাকে ওর বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি । কতবার দূর থেকে পবিত্রকে দেখেই আমায় ফিরে যেতে হয়েছে । আমি তো জানতাম ও অভিমানী তাও কেন এমন ভুল আমি করলাম ? আজো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না । সব জেনেও আমি ওকে আঘাত দিয়েছি । আমিই অপরাধী ।

খানিক নিস্তব্ধতার পর বিনয়ের শান্ত গলা ভেসে উঠল । বলল, এরপর একদিন রাস্তায় আমার সঙ্গে রঞ্জনের দেখা হয় । ওর কাছ থেকে সব জানার পরে আমি শুচির সঙ্গে দেখা করি । শুচি আমায় দেখেই বলে – আমি জানতাম তুমি আসবে । বল তোমার কি ইচ্ছা । তোমাদের তিনবন্ধুর ইচ্ছা যখন পূরণ করতে পেরেছি তখন তোমার টাও পারব । আমি বললাম – এভাবে বোলো না । আমারা কিন্তু তোমায় অন্তর থেকেই ভালবেসেছিলাম । হয়তো ওরা ভুল করে ফেলেছে, তার জন্য ওরা যথেষ্ট অনুতপ্ত । আমি ওদের পথে হাঁটতে চাই না । আমি কোন ভুল করতে চাই না । আমিও তোমাকে ভালবাসি । তোমাদের আইনত বিচ্ছেদ হয়ে গেলে আমি আইন মেনেই তোমার ভার নিতে চাই । তবে আমার সঙ্গে তোমার কোন শারীরিক সম্পর্ক থাকবে না । আমি পবিত্রর দায়িত্ব নেব, আর বন্ধুর মতো তোদের পাশে থেকে বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দেব । এতেই আমার শান্তি । তুমি তোমার মতই থাকবে আর আমি আমার চাকরী আর লেখালিখি নিয়েই থাকব । কিন্তু পরস্পরের কাছে তো থাকতে পারব । এভাবেই আমি আমার ভালবাসাকে সম্মান জানাতে চাই । এখন যদি তুমি আমাকে সে সুযোগ দাও । শুচি বলল – অবশ্যই দেব, আমি ভালবাসার শেষ দেখতে চাই ।

যথাসময়ে তোদের বিবাহ বিচ্ছেদ আর আমাদের আইনগত বিবাহ সম্পন্ন হল । তাও প্রায় তিন বছর হল । পবিত্র এখন অনেক বড় । কথামতো আমি আমার মতো আর ও ওর মতো থাকাতাম । আমার কাজ ছিল ওদের সঙ্গে গল্প করা আর খাওয়া, এছাড়া বড়িতে আমি কোন কাজই করতাম না । পবিত্রর সব দেখাশোনা শুচিই করত । ইদানিং লেখালিখি খুব এত ব্যস্ত ছিলাম, রাত করে বাড়ি ফিরতাম । গত সোমবার ওর শরীরটা খারাপ মনে হল, বললাম ডাক্তার দেখিয়ে নিতে । ও বলল, সেরকম কিছু নয় । মঙ্গলবার ওর জ্বরটা বেশ বেড়েছিল । আমায় বলল পবিত্রকে ওর বিদ্যালয়ের বাসে পৌছে দিতে আর আসার সময় যেন আমিই ওকে নিয়ে আসি । আমি পৌছে দিলাম কিন্তু ওকে নিয়ে আসার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম । আর ফেরার পথে ও ড্রাইভার কাকুর হাত ছাড়িয়ে আসার সময় একটা মোটর গাড়িতে ধাক্কা খায় । হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও কোন লাভ হয় নি । আমি সরাসরি হাসপাতালে গিয়েছিলাম তারপর মর্গ থেকে ওর দেহটা নিয়ে দুজনে সৎকার করে রাত্রে বাড়ি ফিরে যে যার ঘরে চলে যাই । তারপর সকালে উঠে দেখি ও চির ঘুমের দেশে চলে গেছে । নীচে পড়ে থাকা মেলাটোনিনের কৌটো দেখেই বুঝতে পারলাম ওকে আর কোনদিনই জাগানো যাবেনা । পাশে রাখা চিঠিটা পড়ে লুকিয়ে রাখলাম । সেখানেই ও আমাদের এই অনুরোধ করে গেছে ।

আবার সবাই নিশ্চুপ । বেশ খানিকক্ষণ পর রাজদীপ বলে উঠল চিথিতে কি লেখা আছে একবার পড়বি বিনয় । ওর শেষ অনুভুতিটুকু জানাবি আমাদের ? ওর অনুরোধে বিনয় চিঠিটা পড়তে শুরু করল –

আমার প্রিয় বন্ধুরা,
তোমরাই আমার অভিশপ্ত জীবনের স্টেডিয়ামে জলন্ত চারটে বাতিস্তম্ভ । তোমাদের আলোতেই আমি আমার বুক ভরিয়ে নিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু তা হল না । এক এক করে সব আলো নিভে গেল । হয়তো ঈশ্বরের এমনই ইচ্ছা ছিল । তোমাদের আমিও মন থেকেই ভাল বেসে ছিলাম । চেয়েছিলাম যে কোন একজনের সঙ্গে আমার জীবনটা কাটিয়ে দিতে । কিন্তু তা হল না । এতে আমার দোষ কোথায় ? তোমাদের স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা আর অবজ্ঞা শুধু আমাকেই নয় আমার সন্তানকেও বাঁচতে দিল না । তোমরা হয়তো নিজেদের মধ্যে কোন দোষই খুঁজে পাবে না । হয়তো আমাকেই দায়ি করবে এই অবস্থার জন্য । কিন্তু একবার ভেবে দেখো তো সত্যিই কি তোমরা নির্দোষ ? রাজদীপ কি পারত না আমাকে নিয়ে আলাদা ঘর বাধতে ? আমি তো আমার পরিবার ছেড়ে যেতে চেয়েছিলাম । কিন্তু ও ওর পরিবার, পারিবারিক সম্পত্তি আর ওর কেরিয়ারকেই সবচেয়ে বড় করে দেখল । ভালবাসার মানুষের জন্য যে ত্যগ করতে হয় তা বোধহয় ওর জানা ছিল না । আর রমেন ? ওকে আমি আমার মন প্রাণ সব দিয়েছিলাম । কিন্তু আমায় একলা পেয়ে – ওর কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিলাম আর ও আমার সর্বস্য লুঠ করল । এমন মানুষের সঙ্গে ঘর করা যায় না । রঞ্জন তবু মন্দের ভাল । ওই সময়ে ওভাবে আমার পাশে না দাড়ালে আমার জীবন কেমন হত তা আমিও জানি না । কিন্তু আমায় ভালবাসার পাশাপাশি ওর মনের মধ্যেও অতীতটাকে পুষে রেখেছিল । অর্থাৎ একটা হীনমন্যতা ওর মধ্যেও ছিল । তাই আমি ওকে মুক্তি দিই । আর বিনয় তুমি তো বিনয়ের অবতার । আমায় শুধু দয়া করেছ, মহান সাজার চেষ্টা করেছ । যদি একটুও ভালবাসার চেষ্টা করতে তাহলে আজ আমায় এই চিঠি হয়তো লিখতে হতো না । তোমার অবজ্ঞা আমার পবিত্রকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল । আমারা বাঁচার শেষ ইচ্ছাটুকুও চলে গেল । তোমাদের কাছে আর আমার কিছুই চাওয়ার নেই । শুধু অনুরোধ তোমরা যদি তোমাদের নিজেদের ভুলগুল বুঝতে পার তবেই আমার আত্মার শান্তি মিলবে । আমি কিন্তু তোমাদের ভালবেসেছিলাম বন্ধুরা । তোমরা ভাল থেক, বিদায় ।

ইতি –
তোমাদের শুচি

কিছুক্ষন পরে বিনয় বলে উঠল, আমরা সবাই ভুল করেছি তা আজ আমাদের কথার মধ্যে দিয়েই প্রমানিত । আমরা সবাই স্বার্থপর । নিজেদের ছাড়া আর কিছুই বুঝিনা । আজ মনে পড়ছে শুচিকে প্রথম দেখার সেই দিনটা । সেই শুচিই আজ আবার আমাদের এক করে দিয়ে গেল । হয়তো আমারা কেউই এই দিনটাকে কোনদিন ভুলতে পারব না । আমার প্রস্তাব শুচির সৎকার থেকে শ্রাদ্ধশান্তি সব আমরা চারজনে একসঙ্গে করি । এতে যদি ওর আত্মা শান্তি পায় । রমেনের হাত থেকে কাচের গেলাস্টা পড়ে স্বশব্দে খানখান হয়ে গেল । ঘরের মধ্যে আবার নেমে এল শ্মশানের নিস্তব্ধতা ।

Exit mobile version