Site icon আলাপী মন

ম্লান গোধূলির ‘আকাশ’

ম্লান গোধূলির ‘আকাশ’
-রীণা চ্যাটার্জী

দরজার বাইরে স্বাগতার মুখ দেখা গেল। বন্ধুকে দেখে অলি হেসে উঠে বলে,
-আয়, দ্যাখ কতো দেরী করলি! একা একা বসে ভালো লাগছিল না। তাই এই গল্পটাই বারবার পড়ছিলাম- ‘নিমগাছ’ বেশ লাগছিল জানিস!
-তাই! তাহলে একবার আমিও পড়ে নিই, দে দেখি..
-হ্যাঁ,এই নে। বনফুলের ছোটগল্প, পড়ে নে এখনি হয়ে যাবে পড়া। তারপর গল্প করবো জমিয়ে। কতোদিন পর দেখা হলো বল! ভাগ্যিস এসেছিলাম, তাই তো দেখা হলো তোর সাথে। একসাথে তো আর আসাই হয়ে ওঠে না রে আমাদের। কতোদিন একসাথে বসে গল্প করিনি বল?

অলি বলে স্বাগতাকে। দুই বান্ধবীর দুপুরের আলাপচারিতা শুরু হয় নিভৃতে বহু দিন পর। অলি আর স্বাগতা দু’জন সেই ছোট্ট বেলার বন্ধু। যদিও বিবাহের পর দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ এখন খুব কম হয়। হলেও তা ক্ষণিকের জন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ। পরিবার, সন্তান, আত্মীয়, দায়িত্ব- কর্তব্যের মাঝে দু’জনেই সংসারে ব্যস্ত গৃহিণী। বেশ কয়েক বছর পার করে হঠাৎ করেই আজ দু’জনেই একসাথে এসেছে পিত্রালয়ে। অলি এসেছে ওর ভাইঝির জন্মদিন উপলক্ষে। আর স্বাগতা অসুস্থ বাবাকে দেখতে। উপলক্ষ্য যাই হোক, ওরা ঠিক করেছিল সব কাজ সেরে আজ দুপুরে একসাথে গল্প করবে। ইচ্ছে আছে, ফিরে যাবে পুরোনো দিনের বাল্য-কৈশোরের স্মৃতির ভাণ্ডারে।

‘নিমগাছ’ পড়ে স্বাগতা বইটা পাশে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অলি ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-কি রে পড়লি? শেষের দিকে খুব অন্যরকম কিন্তু। কেমন যেন মনে হলো আমাদের মতো গৃহবধূদের কথা লিখে গেছেন, বল?
-ধুসস, কোথায় আর বুঝতে পারলো রে আমাদের কথা? আমাদের কথা কেউ বুঝবে না রে কোনোদিন…! হতাশ সুরে স্বাগতা বলে।
-কেন? কি হলো? তোর ভালো লাগলো না! অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অলি।
-না রে, ভালো লাগার কথা বলছি না। আমার মনে হলো না যে, আমাদের কথা লিখেছেন। নিমগাছের সাথে আমাদের অনেক অনেক তফাত জানিস। যেমন দেখ, একটা কথা তো মানবি- নিমগাছ স্বাদে তেঁতো ঠিক, কিন্তু তার সেই গুণের কথাও তো সবাই মানে, কারো কারো কাছে তো ভীষণ প্রিয়-আহ্লাদের স্বাদ। আমাদের গুণ স্বীকার করতেও তো অনেক বিবাদ রে! আর আমাদের গুণ যেমন দেখে না, দোষ কিন্তু দেখে শত চোখে। কারণ জানতে চাওয়ার প্রয়োজন মনেও করে না কেউ- বিচার হয়ে যায়। কি আশ্চর্য দেখ, সংসারের এই বিচারালয়ে আছেন কিন্তু আমাদের পূর্বসূরী নারীরা, সমবয়সী কিছু নারীরা। যাঁদের জীবনেও আছে আমাদের মতো অনেক যন্ত্রণা। তবুও নির্দ্বিধায় বিচারে সামিল হয়ে যান সবাই। বাকি সদস্যরা তো আছেই । নিমগাছের তো সেই জ্বালা নেই রে। বিচার- লড়াই কোনো কিছুই তার গায়ে লাগে না। গুণের কদর তো পায়, না দিলেও তার কোনো মাথাব্যথা নেই। দায়িত্বের দায় তো নেই, জবাবদিহির দায়ও নেই। স্বাগতা বললো।
স্বাগতার কথায় অলি বোধহয় খানিকটা একমত হয়েই স্বগোতক্তি করে,
-হুমমম…
স্বাগতা বলে যায় খুব ধীরে ধীরে। অলি শুনতে থাকে চুপ করে। মৌনতার মধ্যেই খোঁজে নিজের জীবনের রোজনামচার মিল। তাই হয়তো বন্ধুর কথায় থাকে নীরব সম্মতি। স্বাগতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, আবার বলে ওঠে
-এটা ঠিক নিমপাতার পাতা ছিঁড়ে, ফুল-ফল ছিঁড়ে কাজে লাগায়, কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই নিমের গুণ গাইতে, তার উপকারিতার কথা বলতে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলে না। দোষ দেখে কোনোদিন এমন কথা শুনেছিস বল!
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অলির হাতটা ধরে, অলিও বন্ধুর হাত ধরে হাত মুঠো করে নেয়। আবার বলে স্বাগতা,
-ভেবে দেখ, নিমগাছের জীবনে ফাগুন আসে বারবার, সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে ভরে ওঠে প্রতি বসন্তে। নতুন পাতা, ফুলে-ফলে চোখ ধাঁধানো যৌবনের বাহারে। সবার তখন তার ওপর নজর। দখিনা বাতাসের খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেয় নিমগাছ, প্রতি বসন্তে তার নবজন্ম, নবরূপে। নব কলেবরে আত্মপ্রকাশ প্রতিটি বসন্তে।
স্বাগতার স্পর্শে, কথায় বোধহয় কোনো গভীর অনুভূতিতে আলোড়ন ওঠে, তাই চুপ করে বসে শুনতে থাকা অলিও বলে,
-হ্যাঁ রে। ঠিক বলেছিস। আমাদের জীবনেও ফাগুন আসে সময়মতো, দখিনা বাতাস দোলা দিয়ে যায়। তারপর হঠাৎ নিজেদের অজান্তেই পর হয়ে যায় রে আমাদের বসন্ত। আমাদের অনুমতি ছাড়াই। যৌবন যেন আমাদের জীবনে এক অভিশাপের দূত হয়ে আসে। যৌবন আমাদের শেষ হয়ে যায় ভোগ্যা হয়ে আর বংশ রক্ষার তাগিদে। ঝরে যায় কতো প্রাণ অসময়ে যৌবনের ধর্ম রক্ষার তাগিদে। যারা বেঁচে থাকলো তাদের জন্য শুধু দায়িত্বের বেড়াজাল। নিঃশ্বাসটুকু যেন যন্ত্র হয়ে যায়। দখিনা হাওয়ার দোলা, ফাগুন, বসন্ত, মুগ্ধতা সে তো আমাদের সবার জন্য নয়। সেই দুঃখ তো নিমগাছের আছে নেই বল!

স্বাগতা মাথা নেড়ে আনমনে বলে ওঠে,
-মুগ্ধতা? কারোর মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের কলঙ্ক ছুঁয়ে যায় জানিস না! আর এও ঠিক রে মুগ্ধতার রেশ ক্ষণিকের, দৃষ্টি ফেরাতেই সবটাই বিভ্রম। জীবনটা শুধুই তোলপাড় করে দেয়। সেই ঝড় বড়ো ভয়ঙ্কর। সব ভুলে থাকাই একমাত্র উপশম।
আমাদেরা মা, ঠাকুমাদের দেখ নিজের সব স্বার্থ, স্বপ্ন ত্যাগ করে ভাবেন তাঁদের সন্তানের কথা। অথচ কখন কালের নিয়মে চোখের ঝাপসা দৃষ্টি, চুলের রূপোলী রেখা, আর অনেকখানি সাংসারিক অবহেলা তাদের সাথী হয়ে যায়, কর্তব্যের বেড়াজাল শিথিল করে দিয়ে তাদের অজান্তেই। এটা অবশ্যই প্রাপ্তি আর সঞ্চয় বলতে পারিস সারাজীবনের নীরব দায়বদ্ধতার। নিম গাছের তো সেই দুঃখ নেই বল!

তবুও যেন কোথাও সম্পর্কের সুতো আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টায় অলি বলে, কিন্তু আমাদের শিকড় যেন ছড়িয়ে পড়েছে, এটা তো ঠিক বলেছেন বল! সংসারে আমাদের শিকড় ছড়িয়ে গেছে এতোদূর বোধহয় ওই সংসার নিয়েই আমরা আমাদের অস্তিত্ব খুঁজি। সংসার, পরিবার সবার ভালোলাগা, সবাইকে ভালো রাখা এই চিন্তার সালোক-সংশ্লেষ তো আমাদের রোজ উজ্জীবিত করে। ওইটুকুই অবলম্বন করে বেঁচে থাকি আমরা।

প্রতিবাদ করে স্বাগতা অলি’র এই কথাটাও। বলে ওঠে,
-না রে, আমাদের কোনো শিকড় হয় না রে। শিকড় থাকলে কি আর– জন্ম হেথায় হলেও মরণ কোথায়? এই প্রশ্ন জন্মের সাথে সাথেই জুড়ে যায়। ওই যে নিমগাছটা যত্নে হোক অযত্নে হোক তার চারা, ফুল,ফল,বীজ সব নিয়ে একসাথে থেকে যায় তার শিকড় নিয়ে আমরণ। আর আমরা মেয়েরা জন্মানোর সাথেই আমাদের পরিবার ভাবে- কবে, কোথায় আমরা পরগোত্র হবো। পুরো জীবনটাই আমাদের ঠিকানা বদলাতে থাকে নামের সাথে, ‘বাবার বাড়ি’, ‘শ্বশুর বাড়ি’, ‘ছেলের বাড়ি’। কোথায় আমাদের শিকড় বল? আমরা তো ছিন্নমূল! ছিন্নমূলের কিসের শিকড় রে! তবে হ্যাঁ, আমরা যে দায়িত্ব নিতে দায়বদ্ধ এই চিন্তাধারাটা সেই ছোট্টবেলায় মনে চারাগাছের মতো পুঁতে দেওয়া হয়, ক্রমে ওটাই শিকড় হয়ে যায়, জানিস…
দুপুর গড়িয়ে কখন বিকেল হয়েছে খেয়াল থাকে না। গোধূলির ম্লান আলোয় দুই বন্ধু দু’জনের হাতে হাত দিয়ে বসে থাকে। বলা হয়ে যায় হয়তো শুধুমাত্র স্পর্শ দিয়়ে অনেক না বলা কথা বাল্যসাথীকে। সব কথার প্রকাশ যে কথাতে হয় না। এখন নিমগাছের সাথে কিছুটা মিল দুই বন্ধুর– স্তব্ধতার, মৌনতার। উপলব্ধি, অনুভূতি একাকার হয়ে দু’জনের চোখ থেকে নেমেছে অবিরাম অশ্রু ধারা।
-কি গো পিসিমণি আমাকে কখন সাজিয়ে দেবে? তোমরা কখন তৈরী হবে? সবাই তো এসে পড়বে এবার। সাজবে কখন? কখন কেক কাটা হবে?

অলির ভাইঝি তানিশা একঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে উদগ্ৰীব হয়ে ওদের ডাকতে এসে থমকে যায়, কাঁদতে দেখে। অবাক হয়ে ঠাকুমাকে চেঁচিয়ে ডাকে,

ঠাম্মি, ওওওও ঠাম্মি শিগগিরি এসো একবার এখানে.. ব্যস্ততার মাঝেও ছুটে আসেন অলির মা। ততক্ষণে অলি, স্বাগতা চোখ মুছে নিয়েছে স্বাভাবিক থাকার প্রচেষ্টায়। পাশে তানিশাকে বসিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে অলি, স্বাগতা। ঘরে এসেই তবুও মা যেন কি করে বুঝে যান অলির- স্বাগতার ব্যথা। জড়িয়ে ধরেন তিনজনকে একসাথে অপরিসীম স্নেহে। মা-মেয়ে সবার আকাশ জুড়ে তো একই মেঘের আনাগোনা। মাঝে অবোধ, অবাক তানিশা… ভবিষ্যতের মেঘলা আকাশ।

( কোথাও প্রশ্নরা উঁকি দিয়েছিল অতি প্রিয়, বারবার পড়া এই গল্পটি ঘিরে। দুঃসাহস হয়তো শব্দে দানা বাঁধলো “ম্লান গোধূলির ‘আকাশ’ -এ”। শ্রদ্ধা, বিনম্র প্রণাম জানাই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বনফুলের প্রতি)

Exit mobile version