Site icon আলাপী মন

বিলম্বিত লয়

বিলম্বিত লয়

-অমল দাস

 

নিলাদ্রি তরুণ প্রজন্মের নবীন সাহিত্যক। সাহিত্য রসনায় ও কাব্যিক চর্চায় বর্তমান কালে তার বিশেষ নাম ডাক হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ ইতিমধ্যে তার কয়েকটি কাব্য এবং গল্প গ্রন্থ প্রাকশিত হয়েছে যার ছয়শ-র অধিক পুস্তক পাঠক মহলে বিস্তার লাভ করেছে, এটা একজন সদ্যোজাত কবি সাহিত্যিকের মনোমুগ্ধকর উপলব্ধিও বটে এবং আগামীতেও তা জারি থাকবে এমনই আভাসপূর্ণ মনোবাঞ্ছা।

নিলাদ্রি বিবাহ করেনি, একক ভাবে জীবন অতিবাহিত করছে। বৈবাহিক সুখের লিপ্সা যে তার মধ্যে নেই বলা যাবে না, তা অন্তরে উষ্ণ জলের ন্যায় টগবগ করে ফুটতে থাকে একান্তে। বহু ললনা অন্তরের খড়কুটায় দেশলাই কাঠি মারলেও তা তড়িতে নিবারণ করে সংযত রয়েছে,  তার একটাই কারণ উপার্জনের কোন হদিশ জোটাতে পারেনি সে বিশেষ ভাবে। চাকুরীর চেষ্টা করতে করতে ইদানীং বয়স কিছুটা বাড়িয়ে নিয়েছে, বা বেড়ে গেছে। এটা তো গামছায় বেঁধে রাখবার বস্তু নয়। তবু চাকুরী জোটাতে পারেনি। ছাত্রগৃহে শিক্ষকতা বিক্রয় করে, আর লোক সমাজে জীবনবীমা বিক্রয় করে, তার দিবানিশি যাপন হচ্ছে বাবা-মাকে নিয়ে। একাধিক শুভাকাঙ্ক্ষীই তাকে যুক্তি দিয়েছে যে বিবাহ একটা করলেই হবে সংসার আপনিই চলতে লাগবে। অতপর কন্যার যোগান কেউ করল না, সন্ধানও দিলনা। এটা ছাড়াও তার কেবল অহরহ মগজে জ্ঞান বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্ষান্ত হল না! মাঝে মাঝে খোঁটা দিয়ে বলতে লাগল “ওরে আমাদের ছেলে মেয়ের তো ক’দিন পরেই বিয়ে লাগবে! তুই এখনো করলি না! ওতে প্রদীপ কি আর জ্বলবে।” কেউ বললো “হ্যাঁ রে… সাহিত্যে ডুবে থাকলে শুধু হবে, না কি প্রজননের চিন্তাও করতে হবে! ধীর গতি হোক তবু বংশ গতি তো বাড়াতে হবে”। একটু চুপ থেকে কিনা আবার নতুন সংযোজন “হাওয়া চলে না স্রোত? মোমবাতি ধরে দেখব? ধরলেই সব জানা যাবে, এখন কি অবস্থা”? ইত্যাদি ইত্যাদি আশঙ্কা। যেন তারা বিয়ে করে তাদের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে স্বর্গ হতে ফিরিয়ে এনেছে। আর এই গো বেচারা নিজেকেই উদ্ধার করতে পারল না। যুক্তি তর্ক আগান বাগান থেকে এসে ঘুরত কিন্তু সমাধা বা সহযোগিতা মিলত না। কেবল যেখানে যেমন জলের মতন আকার ধারণ করে সবই সামাল দিয়ে আসত।

 যারা সদোপদেশ দিয়েছে তাতে দুই ধরনের মর্মার্থ নির্গত হয়েছে বোধের প্রস্রবণ হতে, এক- বিবাহ কেবল বংশ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। দুই- বিবাহ যৌন সুখের ধন্বন্তরি মহৌষধি। কেউ আত্মিক সুখের কথা বললো না। কেউ অন্তরঙ্গ বন্ধু মেলবার কথা বলল না। কেউ সুখে দুঃখে জনম সাথীর কথা বলল না। কেউ স্বামী স্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে সংসারে সুখের স্বর্গ স্থাপন করবার কথা বলল না। কেবল বোঝানো হলো ও বস্তু ইঞ্জিন আর খনির মেলবন্ধন। এ সমস্তই নিলাদ্রি ভাবত কিন্তু কাউকে কিছু বলত না।   

বলতে কি সে পারত না! পারত! কিন্তু নিলাদ্রি নিতান্তই ভদ্র তাই মুচকি হেসে চুপ থাকত।অভদ্র গোছের ছোকরা হলে যে ভুলিয়ে-ভাঁওতা দিয়ে এতদিনে একখান বিয়ে সে করতেই পারত তাতে সন্দেহ নেই। কারণ দুই চার জন ললনা তার উপর মেঘ ঘনিয়ে বৃষ্টি হয়ে ভিজাতে চায় নি তা নয়! সে কেবল ভবিষ্যত ভেবে ছাতা খুলে নিরুত্তর নিরাপদ রয়েছে এযাবৎ কাল।

তবে কয়েকদিন পূর্বেই হরিদ্বার বেরাতে গিয়ে ভগবানের কাছে চিন্তা সংকটে পতিত হয়েছিল ভীষণ ভাবে। প্রণাম সেরে সকলেই ভগবানের কাছে দাবী দাওয়া পেশ করে থাকে ইচ্ছা খুশি আদায়ের লক্ষ্যে। এটা কতদূর প্রতিপন্ন হয় জানা নেই, তবুও যেন এদাবী বংশানুক্রমিক এবং ন্যায্য। নিলাদ্রিও এই দাবী হতে বিচ্যুত হতে পারল না। কিন্তু ভাবল কি চাইবে! মাছের বাজার, আলুর দোকান, বইয়ের বাজার লেখার খাতা, বাবা-মা, অনেক ভেবে সে তার নিবেদন শোনাতে লাগল “প্রভু আমাকে একটি সুষ্ঠু সুশীল মননশীল জীবন সঙ্গিনী দিও আর কিছু চাইনা”। অতএব সেও চাহিদা ত্যাগ করে ব্যতিক্রমী হতে পারল না। সেও ঈশ্বরের নিকট লোভ সংবরণ করতে ব্যর্থ। সফল হবে বা কি করে! ইদানীং বিবাহ ধ্বনি যেন তার কানের সাথে দুলের আকারে ঝুলছে এবং মন্দিরের ঘণ্টার ন্যায় ঢংঢং করে বাজছে। এ সমস্ত তারই ফলন।  

নবপ্রজন্মের অনান্য লেখকদের মতই নিলাদ্রিও সোশ্যাল মিডিয়ায়র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এতে তার পুস্তকের বিজ্ঞাপন হয়েছে অধিকতর এবং অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছেও বটে। এক কাপ চায়ে ঠোঁট সিক্ত করে আপন পেন খাতা নিয়ে কাব্য লেখবার আয়োজন করছে। তার আগে ভাবল ফেসবুটা একটু দেখেই নি সমস্ত দিনের আপডেট, তার পরেই লিখব। ফেসবুকে প্রবেশ করতেই তার অতিপরিচিত এক পাঠিকা বান্ধবীর অপরিসীম সুন্দর মুখখানির একটি আলোকচিত্র সামনে এসে থামল। এই চিত্র দেখা মাত্রই নিলাদ্রির অন্তর ভেদ করে শিরা উপশিরা হয়ে প্রেম উত্তেজনার রক্ত সমস্ত শরীরে উদ্দীপনা জাগিয়ে গেল। মনে হতে লাগল সে কি কেবল তার জন্যই! নয়তো খোলা মাত্র সম্মুখেই কেন? তার একক গৃহ নিমেষে বসন্ত কেবিন হয়ে গেল, আকাশে বাতাসে ফুল ঝরতে লাগল। রজনী গন্ধার সুবাস ভাবজগতে আলোড়িত করে তুলল। অন্তরে কেমন এক অবর্ণনীয় উদ্বেগ জাগরিত হলো। যদিও এই উদ্বেগ সুখানুভূতির। এটা যে প্রথম ঘটল সর্বাঙ্গে তা নয়, তবে আজ কিন্তু অন্যরকমই অনুভূতি। এই বান্ধবীটিকে সে অন্তর গহীনে লালল করে চলছে বহুকাল হতেই কিন্তু ঠোঁট ফুটিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে নি। বাক্যালাপ করে থাকে তার সঙ্গে, কেবল বাক্য বিলাপ হয়ে উঠলো না। খোঁজ কিছু নিয়েছে বটে তবে নিজ মনের খোঁজ তাকে দিতে পারে নি।  

এই মাধুর্যপূর্ণ চিত্র দেখে হঠাৎ করে তার যেন আজ উমাকে বিশেষ মনে পড়ে গেল। বাস্তবে এই কন্যার সাথে উমার কতটা মিল আছে, বোঝার উপায় নেই। পিছে কোন শরৎ আছে কি জানা নেই। তবে তার রূপ, স্বল্পভাষী ব্যক্তিত্ব এবং বিচক্ষণ বোধ ও কথামৃতে উমাকে স্পর্শ করে যায়। আর যে দিক হতে এর উমার সাথে মিল রয়েছে তা হল বয়স। সেও উমার মতই অধিক বয়স করে নিয়েছে নিজের এবং কুমারী রয়েছে এযাবৎ কাল। যদিও উমা বিবাহিত তবুও কুমারী। আলকচিত্রের কন্যাও বিয়ে করেনি সে বলেছিল এবং এর কারণ নাকি উপযুক্ত ‘শরৎ’ তার লম্বা শক্ত পাটাতনের ন্যায় ললাটে জুটে ওঠেনি, ভাগ্যের কি পরিহাস!   

নিলাদ্রি সদ্য গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘কলকাতার কাছে’ এবং ‘উপকণ্ঠে’ উপন্যাস দুটি পাঠ শেষ করেছে। এই গল্পকথাতেই উমার চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় এবং এই চরিত্রের সঙ্গে সে এতটাই আত্মিক গভীরতার বন্ধন সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে যে, আলোকচিত্রের কন্যাকে দেখতেই তার মনে হতে লাগল এই সেই উমা যাকে সে অন্তরে অন্তরে ভালবেসেছে গল্পের পরতে পরতে গিয়ে।

অতএব মনে মনে স্থির করল তার ভাবের উমাকে নিয়ে একখানা কাব্য লিখবে এবং তার বাস্তবের উমাকে উৎসর্গ করবে।

ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে রেখেই সে লিখতে মনোনিবেশ করল-

“আচ্ছা উমা তুমি কি জানো

তোমাকে যখনই আমি দেখি আমার অন্তর জ্বলে যায় প্রেমাগ্নিতে

এ আগুন তুমি কেন জ্বালো বলতে পারো?

কেন আমার রক্তে বসে তুফান তোল সাগর বেশে?

কেনই বা এই মুগ্ধ আনন তুলে ধর মুচকি হেসে…”

 

লেখার এই ভাবজগতের কাঁচের দেওয়ালটি হঠাৎ ভেঙে গেল মেসেঞ্জারের টুং আওয়াজে, সমস্ত নিঃশব্দতে নিমেষে যেন হুল্লোড় তুলে তাল পাকিয়ে গেল অনায়াসে। সে দেখল ‘একটি তারা’ ম্যাসেজ দিয়েছে। এই ‘একটি তারা’ নিলাদ্রির পরিচিতা একবিংশতির যুবতী পাঠিকা। ইতিপূর্বে কথোপকথন হয়েছে বহুবার।

সে লিখল- কবি! কাউকে পেলেন?

প্রশ্ন দেখে সহজেই অল্পবিস্তর অনুমেয় উপরিভাগে যা আলোচনা হয়েছে এও সেইরূপ। এই তরুণীর গভীর উৎসুক ধরা পড়ল প্রশ্নে- কি পেলেন? বা সে কি পাওয়ার কথা বলছে!

নিলাদ্রি উত্তর লিখলো– পেলেই সবার আগে তোমাকে জানাবো।

-জানতে চাইলাম তাই বললেন! কবে করে ফেলবেন জানবোও না!

-জানবে জানবে ‘লাভলি তারা’ ব্যাকুল হয়ো না।

-আমি যদি কারো সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিই! আগ্রহ করবেন?

-হুম বিষয়টা তো আগ্রহের! বলেই ফেলো।

-শুনুন আপনাকে একজন ভালোবাসে খুব

-সে… কলা গাছকেও মানুষ ভালোবাসে, তাই কি জড়িয়ে ধরে।

-আপনাদের সব কিছুতেই ভাবের কাব্য। আরে মশাই ধরবে-ধরবে, চিন্তা কেন করছেন?

কন্যা একবিংশতির হলেও বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল রেখেই চলছে এবং এই কথা চালাচালিতে আর বুঝতে বাকি রইল না যে এও সেই একই কাসুন্দি ঘাঁটছে।

নিলাদ্রি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল- কে শুনি নামই বা কি ?

নিলাদ্রি একটু সংকোচে ভেবে বলল -তাহলে কি ?

তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকে বোধ করি নিলাদ্রির আরও কিছু কথার অপেক্ষা করে নিজেই বলতে লাগল- আমিই বৃষ্টি। আমি আপনাকে ভালোবাসি।

নিলাদ্রি এখন ছত্রিশ, বৃষ্টি একুশ, তার থেকে পনেরো বছরের ছোট অর্থাৎ অসম প্রেম। সে ভাবল এটা ঠিক নয়। এছাড়া বৃষ্টি খুবই আধুনিক সমস্ত দিন কি যে আপডেট দিতে থাকে তাতে সে মাঝে মাঝে উষ্মা প্রকাশ করে বটে, অর্থাৎ অপছন্দে। আবার বয়সের অজুহাত দিয়ে কিছু বললে বৃষ্টি কিনা বলেই বসে “বয়স একটা নাম্বার মাত্র, আসল হল মন”। অন্যদিকে উমাতেও মন কিছুটা এঁটে আছে।  

সুতারং সে অনেক ভেবে একটা উত্তর করল- ‘বৃষ্টি, আমি ভালোবাসি, তবে আমার শ্লেষ্মার সমস্যা আছে কিনা! তাই সাড়া জীবন সঙ্গে রেখে গাত্র গাহন করতে পারবনা !বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁপানি হতে পারে এবং মৃত্যু’।

বৃষ্টি দেখল! হয়তো খুব রাগলো, সামনে থাকলে মুখমণ্ডল দেখলেই বোঝা যেত রাগের পারদ কতটা চড়লো, গাল ক্ষোভে ফুলে কতটা টম্যাটোর মত রক্তিম হয়েছিল।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে লিখল-“কবি তো! এমনই উদাসীন, কোন জগতে থাকেন কে জানে! ভেবে বললে খুশী হতাম।

নিলাদ্রিও আর সাড়া দিল না, কিন্তু তার বক্তব্যের জন্য লজ্জিত হল পরিচিত এক কন্যার নিকট। কেবল চশমাটা খুলে রেখে, চোখ রগড়িয়ে উপরে দেখল মাথা তুলে।

সেখানে তার সেই হরিদ্বারের ভগবান তখন উপস্থিত। সে একটা ছায়া দেখে চমকাল, কিছু বলতে পারল না, ভাবল নিজেরই ছায়া, বুঝল না তার ছায়া উর্দ্ধমুখী হবার নয়। ভগবান মৃদু হেসে বললেন –তুই একটা মদন, তোর দ্বারা হবেনা…………।  

 

 

 

 

Exit mobile version