Site icon আলাপী মন

‘জয়জিৎ’

 ‘জয়জিৎ’
-অংশুমান রায়চৌধূরী

‘খক্ খক্ খক্….’

‘প্রতি রাতে নাম সংকীর্তন হোক ছাই না হোক খঞ্জনী বাজবেই৷ জ্বালিয়ে মারলো৷ সেই বিয়ে এস্তক চলছে , থামবার নাম নেই৷ আজ পেট কাল বুক পরশু হাঁপা…’

‘চু….প৷’ বলে ধমক দিয়েই কাশির দমকে খক্ খক্ করে কাশতে শুরু করলেন বীরেন্দ্র নাথ রায় ওরফে বীরেন বাবু৷

‘দেখ, আর ভালো লাগেনা, ভোর হতে না হতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেহটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে তোমার বাসক, তুলসীর রস বানাতে বানাতে আমারই চোখে তুলসী পাতা পড়ার জোগাড় হল৷ তবুও তোমার কাশি গেল না!! ই….চ্ছা করে নেবুলাইজারটাকে চিরতরে ওই দেহতে ফিট করে দি৷’

‘ধুস্, নিকুচি করেছে সংসারের, খক্, খক্… আজ এই রাতেই এ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাব৷’বলেই প্রায় মশারি ছিঁড়ে দেহটাকে বের করার উপক্রম করতেই বুড়ি বলে উঠলো..’যেখানে যাবে যাও, আমি তোমাকে আটকাবো না, তুমি ঘর থেকে বেড়ুলেই আমি একটু আয়েশ করে ঘুমাবো৷ কত রাতের ঘুম যে আমার চোখে’ বলেই লম্বা … একটা হাই তুললেন পুষ্পা দেবী৷ আড় চোখে বুড়োকে একবার মেপে নিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘যাবেই যখন স্থির করেছো তখন গলার মাফলার, মাংকি ক্যাপ আর তোমার সখের খ্যাষ্টা চাদরটা নিতে ভুলো না যেন, কিছু বাঁধালে তো লাট খেয়ে এখানেই এসে পরবে, অন্য কোনোখানে তো জায়গা জুটবে না৷ ছেলেরাও…৷’ বলেই ফিক্ ফিক্ করে বুড়ি হাসতে লাগলো৷

‘উঁ…ম্! আবার হাসির বহর দেখাচ্ছো৷ শোন ওই দাঁত বের করে হাসিটা আমারই দান৷ বাপের বাড়ী থেকে আনা দাঁতের পাটি দু’টোর কবেই তো হরিবোল হয়ে গেছে, যদি না বাধিয়ে দিতাম…’ খক্ খক্ খক্…..৷

‘কি বললে! তুমি আমায় দাঁতের খোটা দিলে, আমাকে! যে কিনা সব সময় তোমার পেছনে টিক্ টিক্ করে, কি করলে তুমি একটু সুস্থ থাকবে, একটু ভালো থাকবে তাকে তুমি…’ বলেই বুড়ি কাঁদতে বসলো৷

‘খক্ খক্… আহা এত রাতে কান্না কা…. খক্ খক্ ৷’

‘আজ তোমাকে বলতেই হবে, এই সারাটা বিবাহিত জীবনে তুমি আমাকে কি কি দিয়েছো? কত লাখ টাকার গয়না গড়িয়ে দিয়েছো, কত টা…???’

‘আবার শুরু করলে, খক্ খক্ …. আমাদের ছেচল্লিশ বছরের বিয়ের মেয়াদে কম সে কম ছিয়ানব্বইবার এই একই কথা শুনে গেলাম৷ আজ বাদে কাল কাঁধে চড়বে তবুও গয়নার মায়া.. খক্ খক্ … এখনো গেল না৷

‘না যাবে না , ওইতো ওই একটুই যা শখ ছিল আমার, তাও ঠিক মত পূরণ করতে পারলে না৷ এক জোড়া কানের আর একটা বাউটি ছাড়া আর কি দিয়েছো শুনি? নেহাত পরবর্তীকলে আমার বাপটা দয়া ঘেন্না করে ভরি পাঁচেক সোনা দিয়েছিল তাই পরে বাঁচলাম৷ প্রেম করার সময় চিঠি জুড়ে কত আদিখ্যেতা, কথার ফুলঝুড়ি, বলে কিনা তোমাকে আমার সবটুকু দিয়ে রানী করে রাখবো৷ হ্যাঁ রানীই করেছো আমায়, ওই আগে যা চাক শব্দটা যোগ হয়েছে৷’

‘আরো কত কি দিয়েছি খক্ খক্ … অত কি ছাই মনে রেখেছি৷

‘তবুও আজ পর্যন্ত সঠিক হিসাবটা দিয়ে উঠতে পারলে না৷’

‘ধুর তোর সংসার৷’ বলে বুড়ো মাংকি টুপিতে মুখ ঢেকে গায়ে চাদর জড়িয়ে খক্ খক্ করে কাশতে কাশতে সোবার ঘরের দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল৷

বুড়ির কান্না , ঝগড়া, সব মাথায় উঠলো৷ এই রাতে বুড়ো যদি বেড়িয়ে যায় তবে এমনিতেই আজ ঘুম আসছে না, চোখটাও বোজানো দায় হবে৷ দিনের বেলা যেমন তেমন রাতে সে এই জনমানবহীন শূণ্য বাড়ীতে কিছুতেই একা থাকতে পারবে না৷ তাই মৃদু স্বরে ডাকলো-‘কি গো গেলে কোথায়, কি গো! ভালো হবে না বলে দিচ্ছি৷ আমি কিন্তু কালই বড় ছেলের বাড়ী চলে যাবো৷’কোন উত্তর নেই৷ ‘আচ্ছা সদর দরজা খোলার কি শব্দ হল?’ পুষ্পা দেবী ভালো করে মনে করার চেষ্টা করলেন ‘উম হুঁ, না, শব্দ শোনা যায় নি, তবে নিশ্চই ব্যাটার বুড়ো ঘাপটি মেরে বাইরের ঘরের কোথাও গিয়ে বসেছে, তার ওপর ওর হাটুর ব্যাথাটাও গতকাল থেকে বেড়েছে৷ সুতরাং…..৷’

বীরেন বাবু ঘর থেকে বেড়িয়ে বৈঠকখানার খোলা জানলাটার পাশে রাখা সোফায় বসে মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন৷ প্রায় বছর দুয়েক পর আজ তার বুড়ির সাথে ঝগড়া হয়েছে, পূষ্পার মুখের এই চিরাচরিত ঝগড়ার বিষয়গুলো বুড়োকে যেমন আনন্দ দেয় তেমনি একটা হাল্কা অভিমানেরও জন্ম দেয়৷ বীরেনবাবু বেশ জানেন যে পুষ্পা এক্ষুনি সেই আগের মত তার গোসা ভাঙাতে ছুটে আসবে আর বলবে “রাগ করোনা লক্ষীটি চল ঘরে চল”৷
জানালার বাইরের তখন রূপোর হরির লুট চলছে৷ পৃথিবীটা রূপোর দ্যুতি মাখতে ব্যস্ত, আর তারি ছোট্ট একটা ভাগ সে এই খোলা জানলা দিয়ে ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে দিয়েছে৷

‘না, ওকে রাগানোটা উচিত হয় নি, কিন্তু কি করবো চোখে যে ঘুম আসছিল না৷ ঘুমের ওষুধটা গতকাল শেষ হয়েছে, মাসটাও ফুরাতে যায়, ওইতো পেনশনের ওই কটা টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া, কে জানে বুড়োর কাছে টাকা পয়সা আছে কিনা! নিশ্চয়ই নেই তা-না-হলে প্রেসারের ওষুধটা আনলো আর ঘুমের ওষুধটা আনলো না!!’

রূপোর ছোঁয়ায় বীরেন বাবুর মন এখন অতীতে ঘোরা ফেরা করতে শুরু করেছে৷স্মৃতির রোমন্থনে এক এক করে জেগে উঠেতে শুরু করে অতীতের পাতায় ঘুমিয়ে পড়া ঘটনাগুলো৷ মনে পড়তে থাকে কিভাবে তিন তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে টেক্কা দিয়ে এই বীরেন নামক পৃথ্বীরাজ পুষ্পা নামক সংযুক্তার মন জিতে নিয়েছিল৷ কি ভাবে কলেজ শেষে ছোট একটা কারখানায় কর্মরত এই কেরাণীটা “কিনু গোয়ালার গলি” থেকে বেড়িয়ে রাজপথে পা রেখেছিলো, কি ভাবে “ঘরেতে এল না সে তো মনে তার নিত্য আসা যাওয়া” সংলাপটির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করে পুষ্পাকে নিয়ে সংসার পেতে ছিল৷ হ্যাঁ, এই জিহাদে পুষ্পার ভূমিকাও কিছু কম ছিল না৷ সে যদি তার বাবার ওই বিপুল ঐশ্বর্য ছেড়ে বীরেনবাবুর হাত না ধরতো, তাঁকে স্বপ্ন না দেখাতো তবে এই বীরেনও বোধ হয় হরিপদ কেরাণী হয়েই রয়ে যেত৷
বছর পাঁচেকের কষ্টে চলা সংসারের মধ্যেই পুষ্পার কোল আলো করে বাড়ীর খুঁদে সদস্য জয়ের প্রবেশ৷ আর ঠিক ছয় বছরের মাথায় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেন্জের দৌলতে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে বীরেনবাবুর সরকারি চাকুরের খাতায় নাম নথিভুক্তকরণ৷ হয়তো এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হল জিৎ, তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান৷
শুরু হল ওদেরকে মানুষ করার সংগ্রাম৷ পাশাপাশি ভাড়া বাড়ী ছেড়ে মাথা গোঁজার নিজস্ব ঠিকানা তৈরীর চেষ্টা৷ তিলে তিলে গড়ে তুললেন আজকের এই বাড়ী৷ ছেলেদের অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়া, শিক্ষা এসবের দিকে নজর দিতে দিতে কখন যে যৌবনের সূর্য পশ্চিমগামী হয়েছে তা রায় দম্পতি টেরি পায়নি৷ এরপর ক্রমে ক্রমে দুই ছেলের চাকরি হল, বিয়ে হল৷ আর রায় দম্পতি মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে বার্ধক্যের খাতায় নাম লেখালো৷ বর্তমানে তাঁরা এই এক চিলতে বৈঠকখানা যুক্ত তিন কামড়ার ঘরে দু’জনাই থাকে ঠিক তাদের প্রথম সংসার পাতার দিনগুলোর মত৷ ছেলেরা দু’জনেই এখন জীবন ও জীবিকার খোঁজে ঘর ছেড়ে পর হয়েছে৷

‘বুড়োটা গেল কোথায়? খক্ খক্ শব্দটাও তো আর শোনা যাচ্ছে না, তবে কি!!’ ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে পুষ্পা দেবী ঘরের মেঝেতে পা রাখলেন৷

অনেকক্ষণ এক ভাবে বসে থাকা বীরেনবাবু তার পা দু’টোকে যৌবনের আবেশে একটু জোরেই নাড়িয়ে ফেললেন আর সঙ্গে সঙ্গে বেতো হাঁটুটার এক খামচায় মুখ কুঁচকে অস্ফুট শব্দ বেড়িয়ে এল৷ চেপে রাখা কাশিটাও প্রাণ ফিরে পেয়ে খক্ খক্ শব্দ তুলো নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙে খান্ খান্ করে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করলো৷ দেওয়াল ঘড়িটা টিক টিক শব্দ তুলে বলে উঠলো ‘বাংলায় ফিরে আয় বাপ৷’ কেবল মাত্র এত বিদ্রুপের মাঝে নিরাপত্তার উষ্ণতা নিয়ে যে বীরেনবাবুর বুকে হাত বোলালো সে আর কেউ নয় পুষ্পা৷

‘তুমি এখনো ঘুমাও নি?’

‘ঘুমের রসদ যে গতকাল ফুরিয়েছে, ঘুম আসবে কোথা থেকে!’

মুচকি হেসে বীরেনবাবু বললেন ‘তবে আজ দু’জনে খক্ খক্ .. বাকি রাতটা গল্প করেই কাটিয়ে দি, কি বলো?’

‘বুড়ো আজ আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে, কেন তুমি বড় ছেলে এবং বউমার অনুরোধ উপেক্ষা করে আমাকে নিয়ে এই বাড়ীতেই রয়ে গেলে! কেন? আমাদের দুই ছেলে বা ছেলেদের বউ কেউই তো খারাপ নয়, তবে কেন থাকলে না ওদের সাথে? টি.ভিতে দেখা বাবা পেটানোর ঘটনা, তোমার মত যুক্তিবাদীর মনে এতটা প্রভাব ফেলেছে এ আমি বিশ্বাস করি না৷ তবে বল কেন, কেন থাকলে না ওদের সাথে?’

‘শুনবে! তবে শোন, আমি জানি আমার পুত্র এবং পুত্রবধু দু’জনেই খুব ভালো৷ ওরা হয়তো আমাদের আরো ভালোবাসবে আমাদের খেয়াল রাখবে, যত্ন করবে এতটা পর্যন্ত সব ঠিক আছে ৷ আমার কথা ছেড়ে দাও কিন্তু ভগবান না করুন যদি কোন দিন ওদের মধ্যে কেউ তোমাকে কটু কথা বলে বসে তবে আমি যে সহ্য করতে পারবো না৷ অন্যের কাছে তোমার মুল্য যাই হোক না কেন, আমার কাছে তুমি অনন্যা তুমি… খক্ খক্ … তাই আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে অন্যের হাতে… খক্ খক্ .. কক্ষনো না৷’

বুড়ির চোখের জল রূপালী আলোর ছোঁয়ায় মুক্ত হয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে বুড়োর পায়ের কাছে৷

‘এটা কি বলতো?’

বুড়ি ঝুঁকে পরে দেখে বুড়োর হাতে ধরা ঘুমের ওষুধের একটা পাতা আধো অন্ধকারেও চকচক করছে৷
মুখে অভিমানের ভাব টেনে পুষ্পা দেবী বলে ওঠে-‘এটা আমাকে আগে দিলে একটুতো ঘুমতে পারতাম, শুধু শুধু..’

‘আগে দিলে আজকের এই সুন্দর রাতটা কাছে পেতাম? ওই ঝগড়াটা, এই চাঁদের আলো, এত দিন পর পাশাপাশি বসা, ফিরে পেতাম কি?’

‘যত সব আদিখ্যেতা, বুড়ো বয়সে ভীমরতি৷ লক্ষীটি চল ঘরে চল রাত যে ফুরতে যায়৷’

Exit mobile version