প্রতিশোধ
-রাখী চক্রবর্তী
“পানকৌড়ি জলে দিচ্ছে ডুব ডুব ডুব,,,,
তাই না দেখে ছোট্ট সোনা হাসছে খুব খুব ,,,”
পুকুর ধারে বসে পাগলিটা এই ছড়াটা রোজ বলে।শোনা যায় এই পুকুরে নাকি পাগলির তিন বছরের বাচ্চা ডুবে মারা গেছিল। তারপর থেকেই পুকুর ধারটা ছিল তার বাসস্থান।অবশ্য একটা ভাঙ্গা বাড়ি আছে পাগলির।ওটা ওর জন্ম ভিটে। বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে সন্তান সম্ভবা মালতী বাপের ভিটেতেই এসে উঠেছিল। বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছে।
মালতীর মা ও বেশি দিন বাঁচেনি। একমাত্র সন্তান এর নাম রেখে ছিল মালতী ‘অমর’।ছোট থেকেই অমর দুষ্টু। মালতী নাজেহাল হয়ে যায় অমরকে সামলাতে সামলাতে।মালতীর বাড়ির সামনেই একটা বিশাল পুকুর আছে। কত মাছ পুকুরে। অমর খুব লাফালাফি করত জলে মাছগুলোকে দেখে।পানকৌড়ি, মাছরাঙা জলে ডুব দিয়ে মাছ তুলছে। সেই দেখে ছোট্ট অমর কি হাসত। মালতী তখন এই ছড়াটা বলত-
“পানকৌড়ি জলে দিচ্ছে ডুব ডুব ডুব
তাই না দেখে ছোট্ট সোনা হাসছে খুব খুব “
সে দিন দুপুর বেলায় মালতী অমরকে ঘরে বসিয়ে রান্না ঘরে ভাত এর ফ্যান গালতে গেছে ফিরে এসে দেখে অমর ঘরে নেই।খোঁজ, খোঁজ অমর কোথায় গেল?
-ও বামুন মা, অমর কে দেখেছো?
-না তো।
এই ভর দুপুরে বাচ্চাটা কোথায় গেল। গাঁয়ের সব বাড়িতে খোঁজ চলল অমরের। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না অমরকে।
বিকেলের দিকে অমরের খোঁজ মিলল। অমর এর ছোট্ট দেহটা ফুলে ফেঁপে পুকুরের জলে ভেসে উঠেছে ।
মালতী এখন পাগলি নামেই খ্যাত। রোজ দুপুরে পুকুরের ধারে বেশ কিছুক্ষণ থেকে তারপর মালতী ঘরে ফেরে। বেশ কিছু দিন ধরে প্রমোটার মদনলাল এর দল মালতীর বাড়িটার ওপর থাবা বসিয়েছে। মালতী অমরের জন্মভিটেকে কিছুতেই কারোর হাতে তুলে দেবে না। কত স্মৃতি কত যন্ত্রণা কত আবেগ এই ছোট্ট বাড়িতে আছে। প্রমোটার মদনলাল ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। তবুও ছলে, বলে, কৌশলে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না পাগলিটাকে।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা গুম ধরে আছে। মালতী পুকুর ধারে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে চিৎকার করে খুব কাঁদল। গাঁয়ের মানুষরা আর তেমন কানাঘুষো করে না মালতীর ব্যাপারে। সবাই জানে পাগলামির চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেলে মালতী বসে বসে কাঁদে।
বিকেলের দিকে খুব ঝড় বৃষ্টি হল। তারপর আকাশ পুরো শান্ত হয়ে গেল। রাত বাড়ছে, মালতী তাও খিড়কিতে বসে আছে ঘুম তো কবেই চলে গেছে ওর জীবন থেকে। হঠাৎ দরজায় খুটখাট আওয়াজ শুনতে পেয়ে মালতী ঘরের বাইরে এসে দেখে মাখনলাল দাঁড়িয়ে আছে।কিরে পাগলি দরজাটা অর্ধেক ভাঙ্গা তো। তাই চলে এলাম রে। চল, লায়লা মজনু খেলি।
মালতী বলল, তুই যা এখান থেকে। বাড়ি তুই পাবি না।
মাখনলাল হাসতে হাসতে মালতীর কাপড় খুলতে খুলতে বলল, আজ তোর শেষ দিন। শুরু হল মালতীর ওপর পাশবিক অত্যাচার।
মালতীর চিৎকার সেই রাতে গায়ের অনেকেই শুনেছিল। পাগলির বকবক ভেবে তেমন কেউ গা লাগাইনি।মাখনলাল মালতীকে ভোগ করার পর একটা দেশলাই কাটি জ্বালিয়ে ঘরে ফেলে দিয়ে চম্পট দিয়েছিল সে রাতে।
সকাল বেলায় মালতীর পোড়া দেহ আর পোড়া বাড়ি দেখার জন্য গায়ের লোক থিকথিক করছে।
মাখনলাল ছিল মালতীর দুর সম্পর্কের দেওর। আজ অনেক দিনের ইচ্ছে পুর্ণ হল ওর। মালতীকে ভোগ করল, এবার বাড়িটাও..
চারতলা পাঁচতলা বিল্ডিং হবে। তাই সব সিমেন্ট, বালি, ইট পাথর আসছে। মাখনলাল ধুতির কোঁচা ধরে তদারকি করছে। বাড়িটার একতলার ঢালাই এর দিন মাখনলাল খুব ব্যস্ত। এবার এক এক করে দোতলা তিনতলা ঢালাই হবে ।
মাখনলাল চা খাচ্ছে লেবার মিস্ত্রিদের সঙ্গে। হঠাৎ মাখনলাল চিৎকার করে উঠল তুই আবার এসেছিস। যা বলছি এখান থেকে।
-কি হয়েছে দাদা আপনি এমন করছেন কেন?
-ঐ দেখ, ঐ পাগলিটা এসেছে, বলছে- আমার শাড়িটা দে
-কোথায় দাদা কেউ নেই তো এখানে। কোন পাগলি? মালতী..সে তো মারা গেছে
-এই তো মালতী..
মালতী তোকে অনেক কাপড় দেবো। তুই যা।
-দাদা আপনি মালতীকে কাপড় দেবেন কেন? আপনার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেল?
-মালতী আমাকে বাঁচতে দে। পালাও সব পালাও।
গায়ের মানুষরা সব বলাবলি করছে মালতীর ভুতকে দেখছে মাখনলাল। নিশ্চয়ই কোন ব্যাপার আছে।
মাখনলাল বিড়বিড় করে বলছে মালতী তোকে আবার আমি মারব। তোর পাগলামি আমি ঘোচাচ্ছি। বিশাল একটা লাঠি হাতে নিয়ে মাখনলাল মালতীর পিছু পিছু ছুটছে।তারপর এদিক ওদিক ছুটে মাখনলাল পুকুর ধারে এসে যেই বসেছে। তখনি ঝুপ করে একটা আওয়াজ হল। মাখনলাল জলে ঝাঁপ দিল না কি কেউ ঠেলা দিয়ে ফেলে দিল সেটা কেউ বুঝতে পারলো না। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে পুকুরের জলে তিন দিকে তিনটি বুদবুদ হচ্ছে। মাখনলাল তো তার পাপের শাস্তি পেয়ে গেল। মালতী তার নিজের ওপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিল।
ঐ বাড়ির ত্রিসীমানায় আজ আর কেউ যায় না। ভর দুপুর বেলায় বা সন্ধ্যা বেলায় পুকুরের জল ঘুরতে থাকে। গাঁয়ের মানুষরা জানে মালতী আর অমর এর আত্মা ওখানেই আছে। তবে ওরা কারোর ক্ষতি করে না।
নিশুতি রাতে মালতীর গান ঐ গাঁয়ের অনেক মানুষ আজও শুনতে পায়
“পানকৌড়ি জলে দিচ্ছে ডুব ডুব ডুব..তাই না দেখে ছোট্ট সোনা হাসছে খুব খুব “