আবহমানের আহ্বান
-রীণা চ্যাটার্জী
আর তো বাকি কয়েক পল কয়েক মুহুর্ত। তারপর হারিয়ে যেতে হবে চিরতরে। জমে থাকবে কতো কথা, কতো ঘটনা, কতো ব্যথা স্মৃতি হয়ে- একটা সংখ্যা হয়ে শুধু ইতিহাসের পাতায়। পুরোনো পঞ্জিকার মাঝে। হয়তো বেশ কয়েক বছর, বা শতাব্দী পরে উঠে আসবো আবার কোনো বিশেষ ঘটনার হাত ধরে বিস্মৃতির আড়াল থেকে।
মনে পড়ে যাচ্ছে আমার আহ্বানের শঙ্খ ধ্বনি, আবেগ, উৎসবের বাতাবরণ। সেদিন ও ঠিক বুঝতে পারিনি, কি হচ্ছে! শুধু দেখলাম সংখ্যাটা বদলে আমার নামের সাথে জুড়ে গেল। বুঝলাম সংখ্যার জন্ম হলো একটা। আর কিছু না, কাল রাতের সাথে আজকের ভোরের তো সেই এক সখ্যতা। হাত ধরাধরি করে চাঁদ ডুবে সূর্য উঠলো। আমার কানে কানে ফিসফিস করে শেষ চৈতি রাত বললো- ভয় পেও না যেন, কিছু আলাদা হয় নি । আজ একটু আনন্দ করছে সবাই তোমাকে ঘিরে, মন্দ কি?
আমি বললাম- কাল রাতে যে দেবেশ বাবু মারা গেলেন, দাহ হলো আজ ভোরবেলা। কি করে ওনার পরিবার আলাদা করবে কালকের রাত আর আজকের ভোরের! ওনার স্ত্রী’কে দেখো এক ভাবেই বসে আছেন। সময় যেন থমকে গেছে ওনার জন্য! উনি বুঝতে পারবেন আমার জন্ম হলো?
আবার দেখো ওই যে পারমিতা ওর ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে ট্রেনে উঠেছে স্বামীর, শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য। মেয়েটাকে নিয়ে নতুন করে লড়াই শুরু ওর। ট্রেন থেকে তো এখনো নামে নি। টিকিট কেটেছে একটা ঘোরের মাথায়- কিন্তু জানে না কখন নামবে। শুধু প্রিয় বান্ধবীর ভরসায় ওর ঠিকানার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়েছে। ওর রাত আর ভোর কি করে আলাদা হবে? ও কি করে বুঝবে আমার জন্ম হলো?
উৎসবের মেজাজে রোজের ভোরের সাথে সেদিনের ভোর ছিল অন্যরকম। ব্যস্ততা, আলস্য সব অন্যরকম। তার মাঝে বসেই ‘চৈতি রাতের’ সাথে কথা বলছিলাম।
চৈতি রাত বলে উঠলো- ওই দেখো সবাই কি রকম সেজে নতুন খাতা, লক্ষী-গণেশ হাতে নিয়ে বেরিয়েছে। কতো আনন্দ! ওরা তো বড়ো ব্যবসায়ী বড়ো আয়োজন। উপাচার, বিনোদন প্রচুর, ভালোই লাগে। পাশে দেখো নীলিমা আর সোমেন দাঁড়িয়ে আছে ওদের ছেলের হাত ধরে। ওরাও পূজো দেবে। সোমেনের ছোটো দোকান। সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে ওর পরিবার আজকের জন্য। নতুন জামা, নতুন শাড়ি পড়ে– উন্নতি, আর মঙ্গল কামনায় পূজো দেবে। ওদের কাছে আজকের ভোর প্রতি বছর নতুন করে ধরা দেয়। নীলিমার পরিবারের মতো এরকম অনেক পরিবার অপেক্ষা করে আজকের দিনটার। ওদের কথা ভাবো, ওদের আনন্দের কথা ভাবো ওদের জন্য একটা সংখ্যা নতুন করে জীবনের রসদ এনে দেয়। ওদের জন্য এই উৎসবের খুব প্রয়োজন। আজ রাত ফুরোলেই আবার একঘেঁয়েমির জীবন ওদের নিত্য অভাব, নিত্য অনটনের। একদিন ভুলে থাকুক সব। দুঃসহ জীবনের মাঝে এক টুকরো আনন্দ।
ভাবতে থাকি সত্যি কথা। এ তো দিন আর রাতের মতো সেই নিত্যকাল। একটু আলো, একটু আঁধার মাঝে খুঁজে নেওয়া জীবনের স্বাদ। তবুও কালকের ঘটনার কিছু রেশ ভুলতে পারি না। বলি- ওই ওরা যে এখনো স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছে ওরা? ওরা কি করবে!
মুচকি হেসে চৈতি রাত বলে- সব আমি বললে হবে? তুমি কিছু অনুভব করো, সময় সব শিখিয়ে দেবে। এখন আমার যাবার পালা। “আজ খেলা ভাঙার খেলা… ” গুনগুন করতে করতে রাত হারায় দিনের কোলে।
তারপর সেদিন সারাদিন ধরে দেখলাম কতো আনন্দ, কতো ছোট্ট ছোট্ট সুখ। হারিয়ে একাত্ম হয়ে গেলাম নিজের অজান্তেই ভিড়ে সবার মাঝে।
সেই শুরু তারপর থেকে চলছে, অবিরাম চলা। দেখলাম পারমিতার কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার টুকরো টুকরো লড়াই, পথচলা সময়ের সাথে। দেবেশ বাবুর স্ত্রী সময়ের হাত ধরে আজ আবার ঘোর সংসারী, সবদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হাল ধরতে সংসারের, যাতে সংসার ভেসে না যায় খড়কুটোর মতো। যদিও প্রতি রাতে তার বালিশ ভেজে প্রিয় মানুষের শোকে, অন্ধকারে হাতড়ায় সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু। নীলিমা আর সোমেনের জীবন যুদ্ধ নতুন উদ্যমে। কাল অনেক রাতে সোমেন ফিরেছে, ওর পরিবারের উৎসবের সামান্য উপাচার নিয়ে। ছেলেটা খুব ব্যস্ত করেছে নীলিমাকে কখন আনবে নতুন জামা, নতুন প্যান্ট। নীলিমার কাছে উত্তর ছিল না। তাই গল্প বলে খাইয়ে, ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এখন পরম মমতায় ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে দেখছে, আর ওর জামায় হাত বোলাচ্ছে। খুব স্বস্তি সকালে ছেলে ঘুম থেকে উঠে প্রশ্ন করলেই , হাসি মুখে ধরিয়ে দেবে নতুন পোশাক।
চরৈবতি মন্ত্রে বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, বকুল, শিউলি, পলাশ মেখে আজ আমি শেষ চৈতি রাত। বৈশাখী ভোরের হাতে সমর্পণের পালা এসে গেছে। জানি সেও আসবে আমার মতো মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে। তাই অপেক্ষায় আছি অধীর অপেক্ষায়… শিখিয়ে যেতে চরৈবতী মন্ত্র যেমন করে আমাকে শিখিয়ে ছিল আমার পূর্বসূরী, ঠিক সেই ভাবে শিখিয়ে দিতে। তারপর? তারপর মিশে যাব আবহমান কালের স্রোতে। এসো নববর্ষের প্রথম প্রভাত, এসো বৈশাখী ভোর, “আমার সকল রসের ধারা তোমাতে আজ হোক- না হারা…”