ভালবাসার রাজপ্রাসাদ

ভালবাসার রাজপ্রাসাদ
-রাখী চক্রবর্তী

 

 

না,পালকির ব্যবস্থা করা গেল না। তবুও, ঘোড়ার গাড়ি খারাপ কি! বড় মামা অনেক দাম দিয়ে গাড়িটা ভাড়া করেছে। আজকের দিনে তো সব ঘোড়ার গাড়ি বুক হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। আজ নববর্ষ এর উৎসব। পয়লা বৈশাখ। চতুর্দিকে শঙ্খ ধ্বনি, উলু ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা।সাজ সাজ রব ।দোকানে দোকানে হালখাতার পুজো শুরু হয়েছে। প্রতিটি গৃহে মঙ্গল ঘট সুসজ্জিত করে স্থাপিত হয়েছে।

দুর্গাপুর স্টেশন এ নেমে ঘোড়ার গাড়িতে বড় ছেলেকে দেখে পুতুলের দিম্মা মানে শশীবালাদেবী চমকে উঠলেন। এ হেন ব্যবস্থা উনি আগে কখনও দেখেনি।ঘোড়ার গাড়ি চেপে উনি নিজের বাড়ি যাবেন এ যেন স্বপ্নের মতো লাগছে ওনার কাছে। এত দিন মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। আজ থেকে উনি মুক্ত নিঃশ্বাস নেবেন প্রাণ ভরে তার স্বামীর ভিটেতে।

কিন্তুু পুতুলের মন খুব খারাপ আজ কারণ ওর দিম্মা চলে যাচ্ছে তার ভালবাসার প্রাসাদে। ওরাও যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কি? ওরা তো আবার নিজেদের বাড়িতেই ফিরে আসবে দুদিন পর। কিন্তু দিম্মা তো আর আসবে না।

গত একমাস পুতুল অন্য রকম আমেজে ছিল ।ভাললাগা, খুশি যেন প্রাণ ভরে উপভোগ করল পুতুল।যেদিন পুতুল, দিম্মা আসার খবরটা পেয়েছিল সেদিন ও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ ওর দিম্মা আসছে ।থাকবে এক মাস।ওর মার শরীর খারাপ তাই।নয়তো কোনদিন দিম্মা এ বাড়িতে থাকেনি। “নিজের বাড়ি তে নুন ভাত খেয়ে ও সুখ” দিম্মার মুখে এই কথা শুনে শুনেই বড় হয়েছে পুতুল। ওকে মামার বাড়িতে আর এখন যেতে হবে না।মামা মামি ভাই বোন বেশ জমজমাট ওর মামার বাড়ি ।

যাইহোক পুতুলের তো আনন্দ আর ধরে না। কত গল্প, কত কথা হবে দিম্মার সাথে।কেউ তো নেই কথা বলার সঙ্গী, খেলার সঙ্গী। মা বাবার সাথে আর কত গল্প করবে।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পুতুল ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে কখন দিম্মা আসবে। আর তর সইছে না ওর। আজ তো রবিবার পড়ালেখা বন্ধ। ছুটির দিনটা বেশ ভালোই কাটবে ওর। পুতুলের বাবা কোন সকালে বাজারে গেছে। ওদের বাড়িতে আজ উৎসবের এর মেজাজ। তবে এই আনন্দের মেজাজ একমাস থাকবে। মানে দিম্মা যত দিন থাকবে।

শেষমেশ দিম্মা এল। কত গল্প, কত আলোচনা, গাইমা কত সের দুধ দেয় এখন?
বাছুরগুলো কি এখনো বাঁধা থাকে নরুল মামার বাড়িতে? পুষি কি তোমার বাড়িতে রোজ আসে? পুঁটি মাছ কি ধাইমা এখনও বিক্রি করে?

-আরে দিম্মাকে বিশ্রাম করতে দে। কত দুর থেকে এসেছে।একসাথে কত প্রশ্ন তোর।পুতুলের মা বকবক করতে থাকে ।

পুতুলি দিম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,এখন তুমি শুধু আমার। নো মেয়ে ,নো জামাই হা হা হা….।
রাতের বেলায় সেদিন খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল পুতুল। দিম্মা মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর ও নিশ্চিন্তে ঘুমাচছে।রাত তখন এগারোটা হঠাৎ পিপাসায় ওর ঘুম ভেঙে গেল। জল খাবে বলে পুতুল জলের বোতল আনতে ঘরের বাইরে যেই বেরিয়েছে তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর মা ফোনে কথা বলছে। ও ভাবছে এত রাতে মা কার সাথে কথা বলছে। দাদা দাদা বলছে তাহলে কি বড় মামার সাথে, ফোনে কথা বলতে বলতে ওর মা ঘরে ঢুকে গেল। পুতুল ওর মার ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেল। ওর মা বলছে “কালকেই আমাদের বাড়িটা ভাঙ্গা হবে তো। এক মাসের মধ্যেই একতলাটা কমপ্লিট করবি। মাকে সারপ্রাইজ দেবো। হ্যাঁ,, রে মাকে যত্নে রাখব। আর শোন, নববর্ষের দিন যেন গৃহ প্রবেশ হয়। এটা মাথায় রাখবি। এদিকটা আমি সামলে নেব। আমরা দুই ভাই আর এক বোন মিলে মাকে নববর্ষের দিন এই উপহার দেবো। শোন, বাড়ির নাম রাখবি “ভালবাসার রাজপ্রাসাদ”।
পুতুলের বুকটা সেদিন গর্বে ভরে গেছিল।সব শুনে ও বিড়বিড় করে বলতে লাগল,”দিম্মার মতো যেন সব বৃদ্ধ বৃদ্ধারা শেষ বয়সে নিজের ভালবাসার রাজপ্রাসাদে থাকতে পারে। বৃদ্ধাশ্রম যেন তাদের ঠিকানা না হয়।
আজ সেই শুভক্ষণ। কিন্তু পুতুলের দিম্মা কিছুই টের পেলেন না, কি হতে চলেছে ।ঘোড়ার গাড়ির থেকে নামতেই উনি চমকে গেলেন।
হ্যাঁ.. রে.. পিয়াল আমার টালির বাড়ি কোথায় গেল? সুমি, পিয়াল,পলাশ তোরা এত হাসছিস কেন?

পিয়াল মানে পুতুলের বড় মামা হেসে বলল,”মা তুমি যখন ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলে তখন তোমাকে কার মতো লাগছিল বলো তো, বলো বলো?
পুতুলের ছোট মামা পলাশ বলল, “মাকে সারদা মার মতো লাগছে। সাদা শাড়ি মাথায় ঘোমটা কতদিন, কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম মা।
তোমার ছেলে মেয়েরা তোমাকে আজ বরণ করে তোমার ভালবাসার প্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করবে। কিছু মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি আমরা। আমাদের ক্ষমা করে দিও। শশীবালা দেবীর চোখ ছলছল করছে। কত কষ্ট করে তিন ছেলে মেয়েকে তিনি মানুষ করেছেন। সত্যিকারের মানুষই হয়েছে ওনার সন্তানরা।আজ পয়লা বৈশাখ গৃহ প্রবেশের সব অনুষ্ঠান, পুজো পাঠ অতিথিদের আপ্যায়ন কোন ত্রুটি রাখেননি শশীবালা দেবীর সন্তানরা। আজকাল কত গৃহে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই, বৃদ্ধ মা বাবাদের অযত্ন, আমরা দেখতে পাই। সেখানে পলাশ, পিয়াল, সুমিদের মত ছেলেমেয়েদের মার প্রতি ভালবাসা দেখে সত্যি মন শান্ত হয়ে যায়। দৃষ্টান্ত হয়ে সারা জীবন বেঁচে থাকুক এইসব ছেলেমেয়েরা সাধারণ মানুষের মনে। ভগবান বলে যদি কিছু থাকে এ ধরাধামে তা হল মা ও বাবা।

Loading

Leave A Comment