সন্দেহবাতিক

সন্দেহবাতিক
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

সুমনার আজ একটু দেরী হল অফিস থেকে ফিরতে। অটো থেকে নামার পর তার বাড়িতে যেতে আরও মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। ও এই পথটুকু হেঁটেই যায় রোজ। যাবার পথে একটা বড়ো সবজির আর ফলের দোকান আছে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সবজি আর ফল রোজ কিনে নিয়ে যায়। সকালে উঠে স্বামী অম্লান যেদিন লাগে মাছ চিকেন বা ডিম কিনে দেয়। ছেলে পিকু ডিম আর চিকেন ভালোবাসে মাছটা কিছুতেই খেতে চায়না। তাও রাতের খাওয়ারটা সুমনা রোজ নিজেই ওকে গল্প করে খাওয়ায়। তখন মাছ জোর করে খাইয়ে দেয়। আজ হয়তো পিকু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। রাতের খাওয়ারটা ও কিছুতেই কাজের মেয়ে শিপ্রার কাছে খেতে চায়না। অম্লানও অসন্তোষ প্রকাশ করে দেরি হলে, আর শাশুড়িমা অত কিছু বলেন না তিনি ভালোমানুষ নির্বিবাদী। বরং ছেলেকে বলেন- আগে মেয়েটাকে একটু জিরোতে দে তারপর না হয় জিজ্ঞেস করিস।

অম্লানের সবই ভালো কিন্তু দেরি হলেই কপাল কুঁচকে যায়। নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে- কেন দেরি হল?
– কাজ ছিল
– দেখো আমায় কাজ দেখিওনা
– তোমার অফিসে কি কাজের জন্য দেরি কখনও হয় না? আর তোমার এত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
-আলবাত বাধ্য। কে পৌঁছে দিল অফিসের বস?
সেদিন সুমনা রাগের মাথায় বলে ফেলেছিল, দেখ নোংরামি কোর না। ছেলে বড়ো হচ্ছে। এখন অনেক সংযত হওয়ার প্রয়োজন।
-কিসের সংযত? মা অফিসের বসের সাথে নোংরামি করে বাড়ি ফিরবে, সেটা ছেলেরও জানার দরকার। সুমনা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, মুরোদ আছে একার রোজগারে সংসার চালানো? আর একবার যদি এধরনের নোংরা কথা বল..

এগিয়ে এসেছিল সুমন কঠিন ভাবে। তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে সজোরে গালে চড় মারতে মারতে বলছে, মুরোদ দেখাচ্ছ আমায় তুমি মুরোদ দেখাচ্ছ? আমিও দেখছি তোমার কত সাহস বেড়েছে? বলে পায়ের চটি খুলতে যাচ্ছিল। ভয়ে সুমনার মুখ নীল হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় অম্লানের মা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, কত জন্ম পাপ করলে যে তোর মত সন্তানের জন্ম দিতে হয় তাই ভাবি, এক সন্তান তাও নুনে পোড়া।

এমনিতে অম্লান সুমনাকে যে অনাদর করে তা নয়।বাড়ির সব জিনিস সুমনার পছন্দে কেনে। কোনো একটা মুখ থেকে বার করলেই সেটা সাধ্যের অতিরিক্ত দাম দিয়ে হলেও ঠিক নিয়ে আসে। প্রতিদিন অফিস ফেরত সুমনার পছন্দের খাবার নিয়ে ঢোকে। বেশির ভাগ দিনই সুমনাই আগে ফেরে এক একদিন দেরি হয়ে যায়। তখনই ওর পাগলামো শুরু হয়। সন্দেহ করা.. সুমনার মনে হয় তখন ওর এটা একটা অসুখ। তাকেই দায়িত্ব নিয়ে এর থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
সুমনা ঝগড়ার সময় অনেকবার বলেছে, স্ত্রীকে বিশ্বাস করতে না পারাটা স্ত্রীকে অসম্মান করা, অপমান করা, আমি কেন দিনের পর দিন তোমার এই অসম্মান অপমান মেনে নেব? আমি এবার ডিভোর্স নেব।
অম্লান বলেছে, ডিভোর্স নেবে? আমি ছেলে দেবো না।  সে কোর্ট ডিসাইড করবে তুমি বলার কে?
সেদিন মারধোরের পর সুমনা শাশুড়ির কাছে ঘুমায় পিকুকে নিয়ে। অম্লানের সাথে কথাবার্তা একেবারে বন্ধ। অম্লান অনেকবার চেষ্টা করেছে সবকিছু ঠিক করে নেওয়ার কিন্তু সুমনার কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। কাল ওর খুব জ্বর ছিল। আজ অফিসেও যায়নি। সুমনা ডাক্তার ডেকেছে। ওষুধ এনে দিয়েছে। সকালের খাবারের জন্য স্যুপ বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু নিজে কাছে যায়নি। অম্লান রাগ দেখিয়ে খাবার খায়নি। সুমনা নির্বিকার, ও নিজে খেয়ে অফিসে বেরিয়ে এসেছে।

শাশুড়ি বললেন, তুই যা আমি দেখে নেব।
আজ সুমনা অবাক হয়ে গেল। তার এতোটা দেরি হয়েছে অথচ অম্লান একবারও তাকে ফোন করেনি! কি হল? জ্বরটা বেশি বাড়েনি তো? আজকাল খুব ডেঙ্গু হচ্ছে এদিকে। যদিও তার সবরকম টেস্ট হয়েছে কিন্তু রিপোর্ট এসেছে কিনা জানে না। তাছাড়া কেই বা রিপোর্ট আনাবে? কেমন একটা অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। ভাবলঝ একবার ক্লিনিকে গিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে নেবে। কিন্তু এতো রাতে তো ক্লিনিক খোলাও থাকবেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা অন করে অম্লানকে ফোন করতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তার মনে হল পিছন থেকে কে এসে যেন তার মুখটা চেপে ধরেছে। সে কথা বলতে পারছেনা। তারা তাকে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে অম্লানের ফোনটা বেজে গিয়ে ওপার থেকে অম্লানের আকুল গলা শোনা যাচ্ছে, কি হল ফোন করলে কেন? তুমি কোথায়? উত্তর দিচ্ছনা কেন? অম্লান শুনল, কে একজন বলছে এই বরকে ফোন লাগিয়ে দিয়েছে। দাঁড়া তোর হচ্ছে… অম্লান এ কথা শুনে পাগলের মতো মাকে বললো, মা ও কোন এক বিরাট বিপদে পড়েছে। ও ফোন করেছিল, তারপর আমার কানে এইসব কথা এলো। অম্লান গায়ে প্রায় একশো দুইয়ের ওপর জ্বর নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মা পিছন থেকে বললেন, তুই একা কি করবি রে? আগে পুলিশে ফোন করে সব জানা।

অম্লান পুলিশে ফোন করে সব বলল,
ও.সি. মি সুরজিত চ্যাটার্জী অম্লানকে বললো আপনি ফোনটা নিয়ে এখনি আসুন। ফোনটা কোথা থেকে এসেছিল সেটা দেখে ট্র্যাক করতে হবে।
অম্লান নীচে নেমে দেখল। একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছে। সে নিজেও তখন জ্বরে টলছে। ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল -বহুত জলদি চলিয়ে,পুলিশ স্টেশন-

– কিছু হয়েছে দাদা?

– হ্যাঁ আমার স্ত্রী খুব বিপদের মধ্যে আছে.. 
– আমি খুব তাড়াতাড়ি পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছি। এই বাজারের আগেই যে ঝোপের মতো আছে ওখান থেকে আমি কয়েকটা ছেলের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম আর একটা মহিলা কণ্ঠের গোঙানি। আমি একা আর কি করব ভেবে নিজেই যাচ্ছিলাম পুলিশ স্টেশনের দিকে। সত্যি এই শয়তানগুলোর জন্য দেশটা একেবারে বনজঙ্গল হয়ে গেছে। পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাতেই ড্রাইভারের মুখে সব শুনে আর ফোন ট্র্যাক করে ওসি মিঃ চ্যাটার্জী ফোর্স নিয়ে পৌঁছে গেলেন।

অম্লান পৌঁছে দেখে সুমনাকে ওরা মাটিতে শুয়ে ফেলে, ওর গা থেকে কামিজটা প্রায় খুলে নিয়েছে আর সুমনা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। তার মুখ গলা রক্তাক্ত। পুলিশ পেছন থেকে গিয়ে ধরে ফেলে চারটি ছেলেকে বাকি দু’জন ছুটে পালায়। ফোর্স ছোটে ওদের পেছনে।

অম্লান সুমনার কাছে গিয়ে নিজের জামা খুলে ওর শরীর ঢেকে দেয়। তারপর ওকে কোলে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ও তো নিজেই তখন জ্বরে আধমরা। সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, অম্লান আমাকে ছুঁয়ো না আজ আমি সত্যি সত্যি অপবিত্র হয়ে গেছি।
অম্লান কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে কোনো অপবিত্রতা তোমায় স্পর্শ করেনি। তুমি আমার কাছে একইরকম পবিত্র আছো চল হাসপাতালে যেতে হবে। আগে সুস্থ হয়ে নাও।
ও.সি. মিঃ চ্যাটার্জী বললেন, একজন ওঁদের সাথে যাও। তা নইলে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম নেবে না, আমি এদের ব্যাবস্থা করছি।
তিনদিন পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুমনা ভাবছে অম্লান আর তো তাকে ঘরে নেবেনা। দাদা বাইরে থাকে, বাবা মা কেউ নেই সে কোথায় যাবে এবার? পিকুকে ছেড়েই বা থাকবে কি করে?
সিস্টার এসে ঘরে ঢুকল, সুমনা জিজ্ঞেস করল, সিস্টার আমার স্বামী কি এখানে আর এসেছে?
-হ্যাঁ, উনি তো এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। ওনার তো আজকেই ছুটি।
ছুটি তো কিন্তু যাবে কোথায়? অম্লান যে আর তাকে ঘরে নেবেনা। তাতে সে নিশ্চিত..তাহলে? ভাবতে ভাবতেই অম্লান ঘরে ঢুকল।
সুমনা তার সজল চোখ দু’টো তুলে তাকালো। অম্লান কাছে এসে বসে ওর মাথায় নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো, দূর বোকা মেয়ে কাঁদে নাকি? কাঁদার কি হল? আজ তো আমরা বাড়ি যাবো।
– আমি কি করে বাড়ি যাবো?
-অম্লান ওকে দু’হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-কোথায় যাবে?
-আমাকে ছুঁলে? তোমার ঘেন্না করছে না?
-না, আমার কোনো ঘেন্না করছে না। তুমি এসব একদম ভাববে না কোনোদিন। যা ঘটেছে তা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আজ আমার যদি একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে কিছু ক্ষতি হত। তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?
এত সেই অ্যাকসিডেন্ট নয়, কতগুলো নোংরা হাত আমার শরীর স্পর্শ করেছে। আমার নিজেকে নিজের অপবিত্র লাগছে।
-আমার লাগছেনা। ওরা তোমাকে যে প্রাণে মেরে ফেলতে পারেনি এটাই আমার পরম ভাগ্য। নাও চল, আর ছিঁচকাঁদুনির মতোন কাঁদতে হবেনা। বাড়িতে মা আর পিকু আমাদের অপেক্ষায় আছে।
সুমনা অম্লানের বুকে মুখ গুঁজে বলল- তুমি এত মহান?
– দূর আমি মহান টহান কিছু নই, আমি একটা সন্দেহবাতিক স্বামী।

সুমনা একই রকম ভাবে ওর বুকে মুখ গুঁজে থেকে বলল-  তুমি এরকমই সন্দেহবাতিক থেকো আর আমাকে এইভাবেই ভালোবেসে যেও।
-আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। সত্যি বলছি বিশ্বাস কর। আমার সমস্ত জীবন জুড়ে শুধু তুমি আর পিকু। কিন্তু আমি এই সন্দেহবাতিক আর থাকব না। আমি বুঝতে পেরেছি যাকে ভালোবাসা যায় তাকে বিশ্বাস করতে হয়। আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালেবাসো তাই ওভাবে মার খেয়েও আমার জ্বরের সময় আমার জন্য আড়াল থেকে সবই করে গেছ। ভালোবাসা না থাকলে তা সম্ভব হয় নাা।

চল এবার আমরা আমাদের বাড়ি যাই..
অম্লান ওর হাতের দিকে নিজের হাতটা বারিয়ে দিয়ে গান গেয়ে উঠল– ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার হাতটা ধর তোমার কোমল বন্ধনে..

– বাবা! তুমি রবীন্দ্রনাথের গানে কলম চালাচ্ছো?
– ভালোবাসা অনেক সাহস দেয় বুঝেছ?
-হ্যাঁ, বুঝেছি চল এবার।

Loading

Leave A Comment