Site icon আলাপী মন

গল্প- অভিনয়ের খেলাঘর

অভিনয়ের খেলাঘর
– রেহানা দেবনাথ

 

সুকন্যার আজ এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেবার সময় নেই! সেই ভোর পাঁচটা থেকে উঠে ঘর পরিষ্কার করা সাজানো সব করেছে! তারপর একহাতে জল খাবার করছে। সৌমিত্রকে অনেকবার বলেও একটা কাজের মাসি রাখতে পারেনি।
সৌমিত্রর একটাই কথা- সারাদিন ঘরে বসে করো কি! বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা আর রান্না করা, ব্যস তারপর সারাদিন আরাম! আর আমাকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় তারপর দু’টো পয়সায় মুখ দেখতে পাই।
সুকন্যা কথার উত্তর দেয় না। মনে মনে ভাবে অফিসের ম্যানেজাার, থাকো তো সারাদিন এ.সি. ঘরে ল্যাপটপের সামনে! আর আমি সকালে কাজের মাসি, রান্নার ঠাকুর, বাচ্ছার আয়া, ঘরের কেয়ার টেকার, অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির নার্স, আর সন্ধ্যাবেলা বাচ্চার দিদিমণি আর রাতে তোমার জন্য রম্ভা শয্যা সঙ্গিনী…তাহলে হাড়ভাঙা খাটুনি কে খাটে বাপু!

সৌমিত্র বাজার থেকে ফিরেই চিল চিৎকার- কি হলো জল খাবার রেডি হয়েছে তো? ওরা সবাই রাস্তায় আছে আধ ঘন্টার মধ্যেই ঢুকে পড়বে।

সুকন্যা ঠান্ডা জলের বোতলটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে- সব রেডি, শুধু ওনারা এলেই লুচি ভাজবো।

সৌমিত্র আপাদমস্তক সুকন্যাকে দেখে বলে- নিজের চেহারার কি ছিরি করে রেখেছো! ওদের সামনে একদম এভাবে আসবে না। তোমার মত গেঁয়োটাকে বিয়ে করে আমার মান সম্মান তো গেছে! তার উপর কি চাও ওরা এসে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করুক!

সুকন্যার দু’চোখে জল চলে আসে সে কোনো রকমে আঁচল দিয়ে মুছে নেয়।

সৌমিত্র মুখ বেঁকিয়ে বলে- আর নাটক করতে হবে না, গিয়ে রেডি হও। বাপের বাড়ি থেকে একটা জিনিস তো ভালোই শিখেছো, ন্যাকা কান্না! যাও যাও মাথাটা গরম করিও না।

সুকন্যা রান্না ঘরে এসে বেসিনের কল খুলে দিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে আর মনে মনে বাবাকে দোষারোপ করে। ‘কেন বাবা তুমি আমার গ্রাজুয়েশনটা শেষ করতে না দিয়ে বন্ধুর কথায় রাজি হয়ে বিয়েটা দিয়ে দিলে? ওরা আমার গান, নাচ সব ছাড়িয়ে দিয়ে এমনকি ফাইনাল পরীক্ষাতেও বসতে দিল না শ্বশুরের অসুস্থতার কারণে। আমার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল! শুধুমাত্র তোমার জেদের জন্য! তোমাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করবো না।’

বাইরে হৈ চৈ শুনে সুকন্যার সম্বিৎ ফেরে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে শাড়ী পরে, মুখে ক্রিম মেখে বসার ঘরে এসে দেখে সৌমিত্রর পাশে একজন সুন্দরী মহিলা বসে আছে, পরনে হালকা কমলা রঙের শাড়ি আর স্লিপলেস ব্লাউজ অন্য প্রান্তে সোফায় আরো ছয় জন পুরুষ মিলে ঠাট্টা তামাশা করছে।
সৌমিত্র রেগে বলে- ওরা কখন এসেছে আর তোমার এখন আসার সময় হলো! সুকন্যা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সৌমিত্র সবার সঙ্গে সুকন্যার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলে- শুধুমাত্র বাবার জোরাজুরিতে ওই সুদূর গাঁ থেকে এই মাকাল ফলটাকে বিয়ে করে এনেছি না হলে কত সুন্দরী শিক্ষিত স্মার্ট মেয়ে আমার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতো!
এমন কেন বলছো সৌমিত্র! বৌদিকে তো দেখতে যেমন খাসা তেমন গুণও আছে নিশ্চয়! পাশ থেকে একজন সুকন্যার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বলে।
তার দিকে তাকিয়ে সুকন্যার গা জ্বলে ওঠে! কি বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে আছে!
জলখাবার রেডি করে আনছি, তোমরা কথা বলো। কথাটি বলে সুকন্যা একটু হেসে রান্না ঘরে চলে আসে।
কিছুক্ষণ পর সৌমিত্র এসে বলে- ভালোই তো ঢং শিখেছো!
সুকন্যা অবাক হয়ে বলে আমতা আমতা করে বলে-আমি আবার কি করলাম?
কি করেছ কিছুই বুঝতে পারছো না! ন্যাকা। কথা বলতে বলতেই সুকন্যার বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে।
আহ! আহ! ছাড়ো, লাগছে….গোঙাতে গোঙাতে সুকন্যা বলে।
সৌমিত্র তত জোরে চাপ দিয়ে বলেে- চিৎকার করলে হাত ভেঙে দেব, পরপুরুষ দেখলেই পাতলা শাড়ি, পিঠ কাটা ব্লাউজ পরার ইচ্ছে হয়! দুশ্চরিত্রা কোথাকার।
সুকন্যা কাঁদতে কাঁদতে বলে- তুমিই তো বলেছিলে গেঁয়োদের মত না সাজতে তাই…..
মুখে মুখে আবার কথা বলা হচ্ছে যাও চেঞ্জ করে জলখাবার নিয়ে এস তাড়াতাড়ি, কথাটা বলে সৌমিত্র ফ্রীজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে যায়।
সুকন্যা জলখাবার নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখে সৌমিত্র সেই মহিলার কাঁধে হাত দিয়ে বসে আছে। সুকন্যাকে ঢুকতে দেখে হাতটা নামিয়ে নিয়ে বলে শব্দ করে আসতে পারো না, ভুতের মত হাঁটাচলা কেন? বলে হাসিতে ফেটে পড়ে সৌমিত্র।
সুকন্যা চুপ করে খাবার দিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুনতে পায় তখনো তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা হচ্ছে।

সুকন্যা ঘরে ঢুকে রাগে দুঃখে দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকে। তারপর উঠে চোখের জল মুছে ভাবে গত পাঁচ বছর ধরে অনেক সহ্য করেছি, আর নয়!
বিয়ের কয়েক মাস পর এই অপমান অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল কিন্তু বাবা তাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে! বাবা বলেছে ‘বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুর বাড়িই হলো নিজেদের ঘর, তখন তারা বাপের বাড়িতে অতিথি!’ তারপর থেকে আর সুকন্যা বাপের বাড়ি যায় না বললেই চলে। বাবা মা’কে তার কষ্টের কথাও বলে না।
হঠাৎ পিঠে হাত পড়তেই সুকন্যা চমকে দেখে পিছনে সেই সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে! পরিচয় করার সময় জেনেছিল ওনার নাম মিলি।

সুকন্যা তাড়াতাড়ি উঠে বলে- আপনার কি কিছু চাই?

মিলি একটু হেসে বলে- হ্যাঁ, একটু বরফ আর ব্যথার মলম।
সুকন্যা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে- কার চোট লাগলো? আপনার? বলতে বলতে নিমেষের মধ্যে ফ্রীজ থেকে এক টুকরো বরফ ও ব্যথার মলম নিয়ে হাজির। দেখি কোথায় লেগেছে?
মিলি সুকন্যার হাত থেকে বরফ নিয়ে ওর বাঁ হাতের কনুই থেকে লাগাতে শুরু করে। তারপর সযত্নে হাতে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেে- কি করে এমন হলো?
সুকন্যা কালসিটে পড়া হাতের দিকে তাকিয়ে বলে-পড়ে গিয়েছিলাম সকালে।
মিলি বিস্ময়ের সুরে বলে- প্রথম যখন তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো তখন তো ওই দাগ ছিল না, পরে জলখাবার নিয়ে গেলে তখন দেখতে পেলাম!
সুকন্যা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে- না না আগেই ছিল আপনি দেখতে পান নি।
মিলি মুচকি হেসে বলে- ঠিক বলেছ আমরা মেয়েরা সব এক! স্বামীর অন্যায় কাজগুলোকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত থাকি আর এই সুযোগেই ওরা একটার পর একটা অন্যায় করে যায়। বলেই মিলি শাড়ি তুলে থাইয়ের মধ্যে কাটা দাগগুলো দেখায়।
সুকন্যা সেই ক্ষত দেখে আঁতকে উঠে বলে- কি করে হলো!
মিলি ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে- স্বামীর ম্যানেজার বন্ধুর পার্টিতে আসতে না চাওয়ার প্রতিদান! আমার স্বামী প্রদ্যুৎ, অফিসের সুপারভাইজার। প্রোমোশনের লোভে সব বন্ধুদের সঙ্গে বউকে ঘনিষ্ঠ করতে ওর লজ্জা করে না। কিন্তু আমি সবসময় পারি না। যখন প্রতিবাদ করি তখন ওর হিংসার ছবি সারা শরীরের এঁকে দেয়!
সুকন্যার চোখের সামনে প্রদ্যুৎ-এর ছবি ভেসে উঠলো। বসার ঘরে মিষ্টি নম্র ভাষী লোকটি যাকে তার সবচেয়ে ভদ্র মনে হয়েছিল!
সুকন্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- কিছু মনে করবেন না, আপনি ওনাকে ছেড়ে দেননি কেন বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন?
মিলি হো হো করে হেসে ওঠে বলে- এ দেখি এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখায়!
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মিলি বলে- কিছু মনে করো না বোন, তুমি আমি সবাই এক মায়ার বাঁধনে আটকে আছি! যার নাম সংসার। তিন তিনটি ছেলে মেয়ে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আটকে পড়েছি। প্রথম প্রথম ভেবেছি অভাব শেষ হয়ে গেলে ও ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু না, আমি ভুল ওর লোভ দিন দিন বেড়ে চলেছে! আর আমার এই বাঁধন ছেড়ার ক্ষমতা বা উপায় নেই। যতদিন যায় এই বাঁধন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তাই সময় থাকতে বাঁচার সঠিক পথ খুঁজে নিতে হয় বোন। কথাটা বলে চোখ মুছতে মুছতে মিলি বেরিয়ে যায়।
সুকন্যা ধপাস করে বসে পড়ে। ভাবতে থাকে মানুষ কত বড় অভিনেতা। একজন মানুষ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার করে, তাকে দেখে বোঝাই যায় না কোনটা তার আসল রূপ।
সুকন্যা উঠে দাঁড়ায় আর চুপ করে অপমান,অন্যায় অত্যাচার সহ্য করা চলবে না… এর যোগ্য জবাব তাকে দিতেই হবে…

Exit mobile version