সুর
– সঞ্চিতা রায়
আজ অনেক দিন পর সঙ্গীতমুখর চৌধুরী বাড়ি। অনিন্দিতা আর ঋতমের দ্বৈত কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে সৌদামিনীর মন অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনে সে বিরাট এক সঠিক কাজ করেছে। সৌদামিনী অনিন্দিতার বড় ছেলের বৌ,অনিন্দিতার আদরের বৌটি। বৌমা না বলে অনিন্দিতা প্রথম থেকেই সৌদামিনীকে বৌটি বলে। সৌদামিনী এ বাড়ীতে বৌ হয়ে এসেছে সাত বছর হ‘ল। প্রথম দিন থেকেই শাশুড়ীর চোখের মণি সে। আর সেও শাশুড়ীকে মামনী বলে। মায়ের কাছে করা সব আব্দার সে এখন অনিন্দিতার কাছেই করে। একদিন সৌদামিনীর ঘর পরিস্কার করতে করতে একটি গানের ডায়েরী তার হাতে পরে।
‘মামনী তুমি গান করতে’?
‘সে অনেককাল আগের কথা।’ ছোটো থেকেই গানের অনুরাগী ছিল অনিন্দিতা। তাঁদের বাড়িতে ছিল সঙ্গীতের পরিবেশ। বাবা খুব ভাল গান গাইতেন। মা সেতার বাজাতেন। কাকু জেঠুরাও ভাল গান গাইতেন। বাবার কাছেই অনিন্দিতার গান শেখা শুরু। ক্রমে ক্রমে তাঁর গানের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। গান তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে ওঠে। গান ছেড়ে বাঁচার কথা সে ভাবতেও পারত না। একসময় ঋতম আসে তাঁর গানের শিক্ষক হয়ে। বাবাই চাইছিলেন, মেয়ে খুব ভাল কারোর কাছে তালিম নিক। ঋতমের গানের গলা মুগ্ধ করতো অনিন্দিতাকে। আর অনিন্দতার সুর ছুঁয়ে যেত ঋতমের হৃদয়কে। মিষ্টি এক ভাললাগার রঙ ছুঁয়েছিল দু’জনকে। হয়তো বা ভালবাসার ফুল ফুটেছিল অন্তরে অন্তরে। কিন্তু এই অনুভূতি অব্যক্ত হয়ে থেকে গেল। অনিন্দিতার জন্য এক বড় ব্যাবসায়ী পাত্রের সন্ধান আনলেন তাঁর বাবার বন্ধু। পাত্রের বিরাট আবস্থা। দু’দুটো কারখানার মালিক। অনিন্দিতাকে কোন এক বিয়ে বাড়িতে দেখে ছেলের নাকি ভাল লেগেছে। এই সমাজের মধ্যবিত্ত বাড়ি, এমন পাত্র পাওয়াকে বিরাট সৌভাগ্য মনে করে। এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হয় নি। অনিন্দিতার গান নিয়ে অনেক দূর এগানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাড়ির চাপে বিয়ে করে নিতে বাধ্য হয়। কিছুদিনের মধ্যেই অনিন্দিতা বুঝতে পারে সঙ্গীতের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার জীবনসাথী দিব্যেন্দুর নেই। বস্তুত কোনো ব্যাপারেই তাদের মানসিক মিল নেই। দিব্যেন্দু বড় বেশী বস্তুবাদী। আবেগ, সখ এগুলোর কোনো গুরুত্ব তার কাছে নেই। স্ত্রী গান করবে বা শিখবে তা সে ভাবতেই পারে না। এসব নাকি অনাবশ্যক ভাবাবেগ। সুর হারিয়ে যায় অনিন্দিতার জীবন থেকে। যন্ত্রে পরিণত হয় সে। যান্ত্রিক জীবনে যখন অসহ্য হয়ে উঠতো সে, মনে হ’ত, ঋতমের সঙ্গীতমুখর জীবনের একটা দিনও যদি তার সাথে কাটতো, তাহলে হয়তো সেই একদিনের স্মৃতিটাই তার এই বদ্ধ জীবনে কিছুটা খোলা হাওয়া হয়ে থেকে যেত। কিন্তু সমাজ সংসারের নাগপাশ যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে । পালাবার পথ নাই। নাই একটু মুক্তি। সারাদিন স্বামী স্ত্রীর কোনো যোগাযোগ নেই, রাতে শুধু দিব্যেন্দুর শারীরিক খিদার তারনায় অনিন্দিতার কাছে আসা। তীব্র অনিচ্ছা সত্বেও অনিন্দিতার দিব্যেন্দুর শরীরের ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হওয়া। ইচ্ছাপাখির ডানা দু’টো ছেঁটে দিয়ে মনের বিরূদ্ধে বেঁচে থাকা। একে একে দুই পুত্রের জন্ম দেয় সে। আরো বেশী করে যান্ত্রিক জীবনযাপনে বাধ্য হয়, ছেলেদের মানুষ করা, তাদের প্রতি কর্তব্য করা এভাবেই কাটতে থাকে তার জীবন। সে যেন এক খাঁচা বন্ধ পাখি। খাঁচার মালিক যেভাবে তাকে চালাবে, সেভাবেই চলতে বাধ্য সে। না ভাললাগা একটা জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়া। ছোট ছেলে বিদেশে যাবে বলে বড়র আগেই বিয়ে করে নেয়। তারা বিদেশেই থাকে। অনিন্দিতার জীবনে একরাশ মিষ্টি হাওয়ার মত এরপর বড় বৌয়ের আগমন। প্রথম থেকেই অনিন্দিতার সব ভাললাগার প্রতি তার নজর ছিল। বিয়ের তিনবছর পর দিব্যেন্দু গত হন। এই তিন বছরে সৌদামিনি এইটুকু বুঝতে পারে তার শাশুড়ী শ্বশুরের কাছে একটা চাবি দেওয়া পুতুল মাত্র। চাবিটা শ্বশুরের নিয়ন্ত্রণে। আধুনিক মানসিকতায় বড় হওয়া সৌদামিনী শাশুড়ির মনকে খুবই বুঝতো। শুধু গানের পর্বটা সে অনেক পরে জানতে পারে। বারবার জিজ্ঞাসা করায় অনিন্দিতা তার জীবন সম্পর্কে ডায়েরীটি বৌটির হাতে তুলে দেয়। এই একটাই মুক্তির জায়গা ছিল অনিন্দিতার। অনেক রাত হ’ত দিব্যেন্দুর বাড়িতে ফিরতে। আর এই সময়টা একটা ডায়েরীতে সে তার জীবনের নানা পর্বের কথা লিখে রাখতো।
স্নান সেরে ঘরে এসে অনিন্দিতা একদিন দেখলো, নতুন একটি হারমোনিয়াম তার ঘরে রাখা। সৌদামিনীর উদ্যোগে আবার করে তার সঙ্গীত চর্চা শুরু। না,তার গলা থেকে সুর হারিয়ে যায়নি এতদিন পরেও। এরপর সৌদামিনী করে বসলো এক দুঃসাহসিক কাজ। ঋতমের বাড়িতে পৌঁছে গেল। ঋতম বিয়ে করেনি। সঙ্গীতকে কেন্দ্র করেই তার জীবন আবর্তিত। আর দিব্যেন্দুও তো এখন নেই। সৌদামিনীর মনে হ’ল হোক না দেরী তবুও জীবনের শেষ বেলায় এসেও যদি দু’টি সঙ্গীতমুখর জীবনকে মিলিয়ে দেওয়া যায় ক্ষতি কি? অনিন্দিতা ঋতম কাউকেই রাজী করা যাচ্ছে না। সমাজ সংস্কার সব যেন বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দু’জনকে অনেক বুঝিয়ে শেষে চারহাত এক করতে সফল হ’ল সৌদামিনী। জীবনের প্রান্তবেলায় আসা দু’টো সঙ্গীতমুখর জীবনকে একসূত্রে গাঁথতে পেরে অপরূপ এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠলো সৌদামিনীর মন।