শ্রমের দাম
-রাখী চক্রবর্তী
অকল্যান্ড জুট মিলটা নয় মাস ধরে বন্ধ পড়ে আছে। জবার বাবার তাই রোজই শ্রমিক দিবস। চার চারটে সন্তান, বৌ কারোর কোনো ও দায়িত্ব তিনি নিতে চান না।জবা বাড়ির বড় মেয়ে। পনের বছর বয়স। সংসার চালানোর চিন্তাতে ওর রাতে ঘুম হয় না।
জবার ভাই মনতাই কাল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে বলল, মা কালকে ইস্কুল বন্ধ থাকবে। মাসটার মশাই বললেন কাল নাকি শ্রমিক দিবস। দিবস মানে তো দিন জানি,শ্রমিক মানে কি মা?
-যে কাজ করে অর্থাৎ যারা শ্রম করে। তাদের শ্রমিক বলে। তাই কাল সব শ্রমিকদের ছুটি।
-বাবা কেন শ্রম করে না? বাবা তো আগে রোজ মিলে কাজ করতে যেত এখন কেন যায় না মা? বাবা কাজে গেলে ভাত ডাল খেতে পেতাম ভালো করে। কতদিন মাছ খাইনি। ও…. মা বাবাকে বলো না মিলে যেতে।
বাদল জানে না যে গত নয় মাস ধরে মিল বন্ধ আছে। ওর বাবার কাজ নেই। মায়না নেই। ধারদেনা করে, এদিক ওদিক টুকটাক কাজ করে খুব কষ্টে ছয় জনের পেট চালাচ্ছে ওর মা।।আর ওর বাবা মনের কষ্ট মেটাবার জন্য চোলাই পট্টিতে যায় রোজ। আর রাতে বাড়ি ফিরে চিৎকার হা হুতাশ করে।
চৈত্র মাসের সেল থেকে কিছু জামাকাপড় কিনে জবা সেগুলো বিক্রি করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে। শরীর আর ওর চলে না। পেটে ভাত নেই। মন সব সময় কাজের ঠিকানা খুঁজে বেরায়। এর মধ্যে বস্তির বলাই আবার কুনজর দিয়েছে জবার ওপর। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে বলাই সব সময় কুনজর দেয়। যদি বলাইয়ের ভাগ্যতে কিছু জোটে ।
জবার মা আজ খুব সকাল সকাল কাজের খোঁজে বেরিয়ে গেছে। জবা তিন ভাই বোনকে নিয়ে বাড়ি আছে। মনতাই হল জবার বড় ভাই ও স্কুলে যায়। ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। আর দু’টো ভাই বোন খুব ছোট।মনতাই সকাল থেকেই ভাবছে আজ তো শ্রমিক দিবস। আজ আমি কাজ করব। আমি তো আর শ্রমিক নই। শ্রমিকরা কাজ না করলেই হল।বাড়ির কাউকে কিছু না বলে মনতাই বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে ইটভাটার দিকে চলে গেল মনতাই।
– কাকু আমাকে একটু কাজ করতে দাও।আমি তো আর শ্রমিক নই।
ইটভাটার মালিক মনতাইকে ভালো করে দেখল তারপর বলল এই একরত্তি ছেলে তুই কি কাজ করবি?
– কেন কাকু ইট বইবো
– তোর বাবা কি করে?
– বাবার রোজই শ্রমিক দিবস
– তাই তুই কাজ করতে এসেছিস!
– হ্যাঁ কাকু ঘরে খাবার নেই। কাজ করে যা টাকা পাব তা দিয়ে চাল মাছ নিয়ে বাড়ি যাব। সবাই ভালো করে খাব আজ।
ইটভাটার মালিক তপন ঘরাই মনতাইকে ইট সাজিয়ে রাখার কাজ দিল।
কাজ করতে করতে একটা ইট মনতাইয়ের পায়ে এসে পড়ল রক্ত পড়তে লাগল ওর পা থেকে। তবুও ও কাজ করে যাচ্ছে।
দুপুর বারোটা বাজে তপন বাবু এবার সবাইকে পেমেন্ট দেবে। সব কর্মচারীরা লাইনে দাঁড়িয়েছে। মনতাইও দাঁড়িয়েছে।এমন সময় হঠাৎ মনতাইয়ের হাতটা শক্ত করে কে যেন ধরে রেখেছে। মনতাই চিৎকার করতে যাবে সেই সময় কয়েক ফোঁটা জল ওর হাতে পড়তেই ও দেখল ওর মা, মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই এখানে কাজ করতে কেন এলি বাবা? আমি তো আছি ।
মনতাই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা আজ আমরা মাছ ভাত খাব। আমি একটু কাজ করেছি তো কি হয়েছে মা? তুমি তো রোজ কত কষ্ট করো।
মনতাইয়ের পা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে।ওর মা ওষুধের দোকানে গিয়ে পায়ে মলম দিয়ে মনতাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। সাথে মাছ,চাল, তেল শ্রমিক দিবসে একটু ভালো মন্দ খাবার খাবে ওরা। অভাব অনটন তো আছে আর থাকবেও। আজ না হয় একটু আলাদা ভাবে বাঁচার স্বাদ নিল ওরা।
হাজার হাজার জবা ও মনতাই আজও আছে এই পৃথিবীতে যারা পরিবারে দুঃখ কষ্টর মধ্যে দিয়ে ও এই ভাবে সংসারের হাল ফেরানোর চেষ্টা করে, তাদের ভালো ভাবে বাঁচার তাগিদকে আমি স্যালুট জানাই।