গল্প- বনলতা

বনলতা
-পারমিতা চ্যাটার্জী

 

হসপিটালে যাবে বলে সবে অরিত্র ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে একটা টোস্টে কামড় বসিয়েছে, এমন সময় মা হঠাৎ রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মায়ের ওরকম অগ্নিমূর্তির দিকে চেয়ে, অরিত্র বলল,”কি হয়েছে মা! প্রেশারটা আবার বাড়লো না কি! কিরকম যেন লাগছে তোমাকে?”
মা সেরকমই ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিলেন, “এক সপ্তাহ কেটে গেলো, আমরা মেয়েটাকে দেখে এলাম, এখনও তোমার কোনো সদুত্তর পেলামনা, প্রেশারের আর দোষ কি! আজও ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না, উনি বললেন, ওঁর মেয়ে খুব অপমানিত বোধ করছে, বারবার আমি ফোন করছি বলি, আসলে আমাদের আপনাদের পরিবারটাকে খুব ভালো লেগেছে তাই মেয়ে বেরিয়ে যেতে ফোন করলাম, একটা কিছু বলে দিন, আমি বলেছি, আমি অত্যন্ত দুঃখিত দিদি, আমি আজই আপনাকে জানিয়ে দেবো, অন্তত মেয়েটার সাথে একবার কথা বলে তো দেখ।”
অরিত্র বুঝতে পারলো, যে কোনো মেয়ের পক্ষেই এটা খুব অসম্মানের, তাছাড়া যে মেয়েটিকে তারা দেখে এসেছে সে ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করে এম.ফিল করছে, দেখতেও অত্যন্ত সুশ্রী কিন্তু সে যা খুঁজছে তাতো নেই, তা কোনদিনও পাওয়া সম্ভব নয়, তাহলে? একটু সময় নিয়ে বললো, “ঠিক আছে ওঁদের মেয়েকে বলে দাও একটা সময় দিতে, আমরা একটু কথা বলে নিতে চাই, যেদিন যেখানে বলবে আমি সেইমতন সময় অ্যডজাস্ট করে নেবো।”
উফ্ এই কথাটা বলতে তুই একসপ্তাহ লাগিয়ে দিলি! নে খেয়ে নে এবার।
অরিত্র দেখলো মুহূর্তে তার মায়ের গলার স্বর একদম বদলে গেলো, মনে মনে হাসিও পেলো।
খেয়ে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবলো, কি যেন মেয়েটার নাম ছিলো! ও মনে পড়েছে, ওর নাম ছিলো তিস্তা, হ্যাঁ তিস্তার মতই চঞ্চল সে, খুব সপ্রতিভ কিন্তু তার মন যে দখল করে বসে আছে সেই শান্ত স্নিগ্ধ কালো চোখের মেয়েটি, যার নাম বনলতা, ঠিক যেন জীবনান্দ দাসের বনলতা।
বনলতা তার পেশেন্ট হয়ে এসেছিল, তার স্বামী তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো, তার চিকিৎসা করতে করতে অজান্তে কখন যে তার মনটাকে সাথে করে নিয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি। সে জানেও না বনলতা এখন কেমন আছে! তার আর কোনো সন্তান হলো কি না! কিছুই জানেনা।
বনলতার প্রথম সন্তান জন্ম দেবার সময় থেকেই সে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল,
কারণ তার স্বামী তখন আমেরিকায় চলে গিয়েছিল তার কোনো এক কলিগকে সাথে নিয়ে।
বনলতা সন্তানসম্ভবা খবর পেয়েও সে কোনরকম খোঁজ খবর করেনি, এসেছিল একদম শেষ মুহূর্তে, বনলতার তখন জ্ঞান ছিলো না। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, তারপর বনলতার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে একটা সই করতে হবে, সে কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, বনলতার প্রেশার খুব হাই এবং ই.সি.জি. রিপোর্ট বলছে হার্টের কন্ডিশন ও ভালো নয়। এমত অবস্থায় দু’জনকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব, তবু্ও আমরা চেষ্টা করবো।
বনলতার স্বামী মৃগাঙ্ক বলেছিল, “ডাক্তার আপনারা দেখবেন আমার স্ত্রীর যেন কোন ক্ষতি না হয়, ওর জীবনটা যেন বাঁচে।”
বনলতা একটা একটা করে দিন গুণ ছিল সন্তানের মুখ দেখবে বলে, সে যখন জানতে পারলো যে তার সন্তানকে বাঁচানো যায়নি তখন সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। খাওয়া পুরো বন্ধ করে দিল, কারুর সাথে কথা বলতো না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো শুধু। স্বামী বহু চেষ্টা করেও তাকে এক চামচ স্যুপ খাওয়াতে পারেনি, তখন তার ওপর ভার পরে বনলতকে সুস্থ করে তোলার।
তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল, বনলতা সুস্থ হয়ে যেদিন স্বামীর হাত ধরে বাড়ি চলে যাচ্ছিল সে সেদিন তার চেম্বারের জানলা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো, হঠাৎ দেখলো বনলতা পেছন ফিরে তাকিয়ে তার দিকে চলে যাচ্ছে আসতে আসতে কম্পাউন্ড পার হয়ে। যতদূর দেখা যায় দু’জন দু’জনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলো।
বনলতার সেই দৃষ্টির ভাষা সেদিন সে পড়তে পেরেছিল।
মনে মনে একটা গোপন আশাও পোষণ করে রেখেছিল হয়তো কখনও কোন একদিন সে আসবে! না বনলতা আর আসেনি। সে হয়তে সুখেই আছে তার কথা ভেবে এখন সে বর্তমানকে নষ্ট করতে পারেনা।
যে আসছে তার জীবনে, সে বনলতা নয়, সে তিস্তা , তিস্তাকে তিস্তার মতো করেই গ্রহণ করতে হবে, তারমধ্যে বনলতাকে খুঁজলে চলবে না।
দু’ একদিনের মধ্যে অরিত্রর মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো, অরিত্র কোনো পেশেন্টের ফোন ভেবে বেশ ভারিক্কি চালে ফোনটা ধরে উত্তর দিল, “ইয়েস ডাঃ অরিত্র ইজ স্পিকিং”
ওপার থেকে কলকল করে মহিলা শব্দের হাসির শব্দ ভেসে এলো, তারপর হাসি সামলে বললো, “আপনি তো আচ্ছা মশাই, ফোন করতে বললেন, আর চিনতেই পারছেন না! “
মুহূর্তের মধ্যে অরিত্রর শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো, বুঝতে পারার পর সেও সহাস্যে উত্তর দিল, “ও বুঝেছি, মনে হচ্ছে তিস্তা নদী, কিন্তু নদী তো খুব শান্ত হয়, কিন্তু আপনি যেভাবে নির্ঝরিণী ঝর্ণার মতন হাসি ছড়ালেন, তাতে আপনার নাম কোনো ঝর্ণার নামে হওয়া উচিৎ ছিলো”
ওপার থেকে আবার সেই কলকল শব্দ বেজে উঠলো, “আপনি তো খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন! আমার তো ধারণা ছিলো ডাক্তাররা নীরস প্রকৃতির হয়।”
ডাক্তাররা নীরস প্রকৃতির হয় এ অভিযোগ কিন্তু সত্য নয়, অনেক ডাক্তার সাহিত্য ও সংগীত চর্চাও করে থাকেন। তাছাড়া আমি কিন্তু মনের ডাক্তার, “দেখবেন আমি কিন্তু আপনার পেশেন্ট নই, আমার আবার মনের চিকিৎসা করতে যাবেন না যেন, আমি একদম সুস্থ মনের মেয়ে”
“হুম, সে তো বুঝতেই পারছি, তা বলুন কবে মহাশয়ার দেখা পাবো?”
“দেখা পাবার জন্য খুব উদগ্রীব বুঝি?”
“খুব না হলেও একটু উদগ্রীব তো বটেই”
“তাহলে তো আপনার নিজের মনের চিকিৎসাটা আগে করতে হয়”
“মানে!”
“মানে যাকে দেখার জন্য উদগ্রীব তাকে এই কথাটা বলার জন্য একসপ্তাহ সময় নিয়ে নিলেন”
‘না, এতোদিন ঠিক উদগ্রীব ছিলাম না। তবে আপনার সাথে কথা বলার পর হলাম”
“ও তাই বুঝি?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই, এবার বলুন কোথায় কবে দর্শন পাবো?”
“খুব তাড়া মনে হচ্ছে?”
“আরে বাইরে পেশেন্টরা ওয়েট করে আছে..”
“ও সরি সরি, কোথায় করা যায় বলুন তো?”
“আপনি যখন তিস্তা তখন গঙ্গার ধারে দেখা করাই ভালো, মানে আউটরমঘাট”
“গ্রেট আইডিয়া, তাহলে এই রবিবার আউটরমে এই সন্ধ্যা ছটা নাগাদ, আপনার অসুবিধা নেই তো?
“না না ঠিক আছে, রবিবার তো অফ ডে” “একদম ঠিক আছে, তাহলে এবার রাখি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, টা টা”
“হ্যাঁ টা টা”
ফোনটা রেখে দিয়ে অরিত্রর মনে একটা শিহরণ বয়ে গেলো, না মেয়েটা খুব সপ্রতিভ, দেখি কথা বলে, বিয়ে তো করতেই হবে। যাকে সে মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছে, সে তো কোনদিনই তার হবেনা, তাই এই বন্ধন থেকে তাকেও মুক্ত হয়ে আসতে হবে।

বনলতা এখন নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, মৃগাঙ্ক অফিস যাবে তার খাবার দাবার গোছাতে রান্নাঘরে তাড়াতাড়ি মাছের ঝোলটা বানাচ্ছে, টিফিনের জন্য ফল কাটছে, স্যান্ডউইচ তৈরি করছে, এই তাড়াহুড়োর সময় আবার মৃগাঙ্কর ডাক দিলো তাকে ঘরে, সবই তো হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে এসেছে, আবার ডাকছে কেন কে জানে! সে আবার মা হতে চলেছে, মৃগাঙ্কর আদর ও যত্নে মাঝে মাঝে সে যেন
হাঁপিয়ে ওঠে। সবই করে যায় কিন্তু মনের কোণে প্রথম জীবনের সেই অপমানটা থেকেই গেছে। মৃগাঙ্ক হাজার চেষ্টা করেও তাকে ভাঙতে পারেনি।
ঘরে ঢুকতেই মৃগাঙ্ক তাকে কাছে টেনে নিলো, বনলতা অস্বস্তিতে পরে গেলো, “আরে কি করছো? রান্নাঘরে রান্নার মাসি আছেনা? “
“থাক তাতে আমার কি! সারাদিনের জন্য অফিস যাচ্ছি, এইসময়টা একটু কাছে থাকতে পারোনা?”
“তোমার রান্না টিফিন এগুলো তো সব দেখে দিতে হবে”
“হ্যাঁ, নিজের খাবারটা খেয়েছো তো?”
“হ্যাঁ, খেয়েছি”
“কি খেলে? দু’টো টোস্ট তাই না? চল আমার সাথে বসে এখন একটা ডিম সিদ্ধ খাবে”
“ওরে বাবা এখন আমি পারব না”
“পারব না বললে হবে? তুমি তো জানো এখন তোমার খাওয়ার কত প্রয়োজন? জানি আমি তোমার মনে জায়গা করতে এখনও পারিনি, হয়তো একদিন পারবো, আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি কিন্তু যে আসছে তার কথা ভেবে একটু খাও।’
বনলতার কোমল মনে মৃগাঙ্কর কথাগুলো খুব করুণ শোনালো, সে এগিয়ে এসে স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললো, “কে বললো জায়গা করতে পারোনি?”
“সত্যি পেরেছি? মৃগাঙ্ক ওকে সবলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অজস্র আদরের চিহ্ন দিয়ে গেলো ওর কপালে, বুকে, গলায় চিবুকে, নিজের অজান্তেই যেনো বনলতা স্বামীর আদরে আজ শিহরিত হল,
খুব ভালো লাগলো তার, হাত ধরে বলল-“চল খাবে চল।”
পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিবার আউটরমে তিস্তা আর অরিত্র একটা খুব আনন্দময় সন্ধ্যা কাটালো। দু’জনেই দু’জনের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো আর সিদ্ধান্ত নিলো তারা একসাথে পথ চলতে পারবে।
তিস্তা সত্যি একটা আনন্দের গতি সে মানুষকে বিস্বাদ থেকে নিমেষেই খুশিতে ভরিয়ে দিতে পারে।
বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেলো, একমাস বাকি।
এরমধ্যে দু’জনে মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করতে লাগলো আর ফোনে তো রোজ রাতে প্রায় একঘন্টা ধরে কথা বলে যায়। প্রধান বক্তা তিস্তাই তার ঝরঝরে ঝর্ণার মতন অজস্র কথা অরিত্রর মনকে কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শুধু মনের মধ্যে রাখা সেই ছবিটা যখন মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে, অরিত্র নিজেই নিজেকে বলে, “কেন ভুলতে পারিনা তোমায়, কেন তোমার শান্ত দিঘির মতন চোখের দৃষ্টি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, মনটাকে এলোমেলো করে দেয়, যেখানেই থাকো, শুধু ভালে থেকো, তোমায় না ভুলেই আর একজনকে ডেকে এনেছি মনে, তাকেও ভালোবেসেছি, শুধু তুমি থেকে যাবে আমার নিভৃত মনের এককোণে একটা ছোট্ট জায়গা দখল করে, তাই থাকো আর কিছু তো করার নেই আমার”
মৃগাঙ্ক অফিস বেরিয়ে যাবার পর ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে, বনলতা আনমনা হয়ে জানলা ধরে দাঁড়ায়, আজ মৃগাঙ্কর আদর তার মনকে স্পর্শ করেছে, মানুষ তো ভুল করেই, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো সে আপ্রাণ করছে, তার এই প্রচেষ্টােকে সে সম্মান জানাবে। মৃগাঙ্কর সন্তানের সে মা হতে চলেছে, আগের সন্তান ছেলে ছিলো, যাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। এবার মৃগাঙ্ক বলেছে, “আমি তোমার মতন শান্ত স্নিগ্ধ মিষ্টি একটা বনলতা চাই।” জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার চলে আসার সময় অরিত্রর নির্নিমেষ দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে ছিলো অনেক না বলা কথা, তারও তো ছিলো অনেক কথা, কেউ কাউকে কিছু বলতে পারেনি, শুধু নীরব সুন্দর একটা অনুভূতি তার মনে এসে বারবার মনটাকে দখল করে বসে। হয়তো অরিত্র এতদিনে বিয়ে করে নিজস্ব সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, এরকম কত পেশেন্টই তো তার কাছে যাওয়া আসা করে, কে আর মনে রাখে বনলতা নামে কোন এক বিশেষ পেশেন্টের মনের না বলা অনুভূতির কথা!
তিস্তা আর অরিত্রর বিয়ের দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেলো। সুখী দম্পতি বলতে যা বোঝায় ওরা তাই। ওদের মাঝখানে এখন এক ছোট্ট অরিত্র এসেছে, যার নাম তিস্তা দিয়েছে অভিজয়।
তবু মাঝেমধ্যে যখন রিমঝিম বৃষ্টিতে অরিত্রর ঘুম ভেঙে যায়, মনের কোণে ভেসে ওঠে সেই স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি, নিজের মনেই কবিতা বলে, “যেতে যেতে কেন তাকালে ফিরে, কি বলতে চেয়েছিলে সেদিন, না বলেই গেলে চলে।”
তিস্তার স্পর্শে তার চেতনা ভাঙে, নিজের মনের ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিস্তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কাজের ভিড়ে তোমাদের তেমন করে সময় দিতে পারিনা, চল একটু পাহাড়ের দিকে বেড়িয়ে আসি।”
তিস্তা তো এককথায় রাজি, বলে “তুমি ব্যাবস্থা কর আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি।”
মৃগাঙ্ক সেদিন অফিস থেকে ফিরে বনলতাকে কাছে টেনে বলে, “আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, বনলতার অবাক মুখের দিকে চেয়ে অরিত্র বলে, বেড়াতে যাবো আমরা সিকিমের দিকে, তোমার পছন্দ তো?” ছেলে মানুষের মতন ঘাড় দুলিয়ে তিস্তা বলে, “হ্যাঁ, খুব পছন্দ, কবে যাবো?”
“সামনের রোববার রওনা হব। তোমাদের গরমজামা সব ঠিকঠাক আছে তো? না হলে চল তোমার আর কথার কিছু গরমজামা কিনে নিই”
“না আমার সব আছে, কথার জন্য কিছু নিতে হবে।” কথা ওদের সন্তান, চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে, পুরো নাম কথাকলি।
বেরিয়ে পরে ওরা সিকিমের উদ্দেশ্যে।
সিকিমে খুব আনন্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃগাঙ্ক, বনলতা আর ছোট্ট কথাকলি। অনর্গল কথা বলে যায় বলে ওর নাম দেওয়া হয়েছে কথাকলি। ওর মিষ্টি মিষ্টি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে ওর বাবা মা।
মৃগাঙ্ক অনেকদিন পর বনলতাকে এতো হাসতে দেখে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “তোমার ভালো লাগছে তো বনো? “
বনলতা চোখ বুৃৃঁজে উত্তর দিল, “ভীষণ ভালো লাগছে”
“তাহলে, একটা…”
“এই মেয়ে আছে না!”
“ও তো এগিয়ে গেছে,” এই বলে আর দেরি না করে মৃগাঙ্ক একটা গাঢ় চুম্বন দেয় বনলতার ঠোঁটে।
যথারীতি কথা দেখে ফেলে আর বলে, “এ বাবা তুমি আমার মতন মাম্মাকেও কিসি দাও?”
অপ্রস্তুত মৃগাঙ্ক তাড়াতাড়ি বলে, “না না তোমার মাম্মার ঠেঁটটা একটু লেগেছিল তাই দেখছিলাম “
বনলতা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “দেখলে তো?”
“তা কি করবো বলো, এমন রোমান্টিক জায়গায় একটু রোমান্স করবনা! তা কি হয়?”
অরিত্র ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে, আকাশটা পুরো হলুদ আর কমলা রঙে মেশানো এক অদ্ভুত সুন্দর রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসছে তিরতির করে এক নাম না চঞ্চল ঝর্ণা। তিস্তা সেদিন হলুদ আর কমলা মেশানো এক সুন্দর পোশাক পড়েছে, ভারি সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে।
অরিত্র একহাতে তিস্তাকে গভীর আবেগে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আকাশটাও আজ তোমার রঙে সেজেছ” তিস্তা বললো, “তুমি একটু ভুল বললে, আমি আকাশের রঙে সেজেছি “।
অরিত্র বললো “আর ঝর্ণাটাকে দেখো তোমার মতন চঞ্চল গতিতে তিরতির করে নেমে আসছে,” তিস্তা হেসে অরিত্রকেও তার হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
দূর থেকে মৃগাঙ্ক দেখলো তাদের মতন এক দম্পতি সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে সেই অপরূপ দৃশ্যের রস গ্রহণ করছে।
মৃগাঙ্ক বনলতাকে বললো, দেখতো ওরা কেমন ছেলে নিয়েও দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আছে”
বনলতা বললো, “ওদের ছেলেটা আর একটু ছোটো, আর তোমার মেয়ের মতন হয়তো বিশ্বপাকা নয়”
“তা বলে এমন রোমান্টিক জায়গায় তোমাকে একটু আদর করবো না! আর তুমি তো কখনোই ওর মতন আমাকে জড়িয়ে ধরবেনা !”
বনলতা এগিয়ে এসে মৃগাঙ্কর কোমর জড়িয়ে ধরলো, “মৃগাঙ্ক অভিমান করে বললো, থাক জোর করে করতে হবে না”
বনলতা মৃগাঙ্ককে বললো, “তোমার কানটা একটু আমার কাছে নামিয়ে আনো”
“কেন কান ধরবে না কি?”
“আরে একটু নামাও না”
মৃগাঙ্ক কান নামিয়ে আনতেই বনলতা ওর কানে একটা কুটুস করে কামড় দিয়ে বলল, “রাত এখনও অনেক বাকি “
এবার মৃগাঙ্কর মুখ হাসিতে ভরে গিয়ে বনলতাকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে বললো, “না আমার বউটা দেখছি সত্যি খুব রোমান্টিক।”
হাঁটতে হাঁটতে ওরা প্রায় যখন ওদের কাছে এসে পড়েছে তখন মৃগাঙ্ক বলল, ” আরে দাঁড়াও দাঁড়াও এতো দেখছি ডাঃ অরিত্র সেন, যার চিকিৎসায় তুমি ভালো হয়েছিলে”
বনলতা একমুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো, তারপর বললো, “থাক ওদের আর বিরক্ত করো না, ওরা এখন নিজেদের মধ্যে একটু আনন্দ করছে, ছেড়ে দাও”
“কেন বনো, কতদিন পর দেখা হলো একবার কথা বলবেনা? আমি জানি চিকিৎসার সময় তোমরা দু’জন দু’জনের প্রতি দুর্বল হয়েছিলে, হয়তো কেউ কাউকে কিছু বলতে পারোনি, কিন্তু তোমার মনের কোণে এখনও ওর জন্য একটু জায়গা আছে তা আমি বুঝতে পারি, কথা বলো না একবার, কি এমন ক্ষতি হবে তাতে? আমি জানি তুমি এখন আমাকেই ভালোবাসো, তবু কারুর জন্যে যদি একটু জায়গা থাকে, তাতে তো কোন অপরাধ নেই’
বনলতা আরও কাছে এসে স্বামীকে সব ভুলে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললো, “তুমি এতো উদার, আজ আমি এক নতুন তোমাকে আবিস্কার করলাম, এতদিন হয়তো ছিলো, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তা মিলিয়ে গেলো।”
মৃগাঙ্ক অরিত্রর কাছে এসে বললো, “একটু বিরক্ত করলাম,”
অরিত্র ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, ওর চোখ চলে নিজের অজান্তেই বনলতার দিকে!
মৃগাঙ্ক আবারও বললো,”চিনতে পারছেন? আমার স্ত্রী বনলতা দীর্ঘদিন আপনার চিকিৎসায় থেকে সুস্থ হয়েছে, তাই আপনার কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ।”
হেসে অরিত্র বলল, “না না এতে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই, এতো আমার কাজ – আলাপ করিয়ে দিই – আমার স্ত্রী তিস্তা আর আমাদের ছেলে অভিজয়।”
পরস্পর ভদ্রতা বিনিময়ের পরে মৃগাঙ্কই বললো, “চলুন না এতোকাল পর যখন দেখাই হলো তখন একটু বসে চা খাওয়া যাক..”
তিস্তা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো – “হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, অনেকক্ষণ থেকেই মনটা চা চা করছিল, চলুন যাওয়া যাক।” তারপর কথার দিকে চেয়ে বললো – “এই বুঝি আপনাদের মেয়ে! কি নাম তোমার ?”
কথা তরতর করে বলে গেলো, “আমি তো ভীষণ কথা বলি তাই মা আমার নাম কথাকলি রেখেছে”।
কিছু দূর এগিয়ে একটা গুমটি মতন চা খাওয়ার স্টল সাথে সিঙারাও ভাজা হচ্ছে, আবার মোমো আছে।
ওরা সবাই চা সিঙারা খেতে খেতে গল্পে মশগুল হয়ে গেলো, বাচ্চাদের মোমো দেওয়া হলো।
চা খাওয়ার শেষে মৃগাঙ্ক তিস্তার সাথে কথা বলতে বলতে বাচ্চাদের নিয়ে যেন ইচ্ছে করেই একটু এগিয়ে গেলো, পেছনে আসতে আসতে হাঁটতে লাগলো অরিত্র আর বনলতা।
ভেবে পারছিলনা কি কথা বলবে- শেষে অরিত্র বললো- “এখন সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, এখন ঠিক আছে, তবে অনেকদিন পর্যন্ত সব পাওয়ার মধ্যে একটা নীরব দৃষ্টি আমার মনে ভেসে উঠতো, যে দৃষ্টি যেন কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বলতে পারেনি।
আর আপনার?”
“আমারও একটা শান্ত স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি মনের আয়নায় উঁকি দিতো, যে যাবার সময় ফিরে তাকালো কিন্তু কিছু না বলেই চলে গেলো।
এখন তো আমরা দু’জনেই খুশি সংসারের আবর্তনে! কি তাইতো?”
“হ্যাঁ, মৃগাঙ্কর উদারতা আর অকৃত্রিম প্রেম আমায় ভরিয়ে দিয়েছে তবু মনের একটা ছোট্ট জায়গা একজনের দৃষ্টিটা রয়ে গেছে, থাকনা যেমন আছে, জোর করে তাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করিনা বরং সযত্নে রেখে দিই।”
অরিত্র পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বনলতার দিকে তাকালো, তারপর বললো- তিস্তার খরস্রোতা ভালোবাসায় আমিও ভেসে যাই। তবু আমারও মাঝে মাঝে শ্রাবণের অঝোরে বৃষ্টি ধারার সাথে ফিরে আসে সেই শান্ত স্নিগ্ধ মুখটা যাকে চেষ্টা করেও ভোলা যায়না। আমারও মনে হয়, থাকনা মনের স্মৃতি কোঠায় একটা ছোট্ট স্মৃতি।”
আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এলো। যে যার পথে চলে গেলো অতীতকে পিছনে ফেলে বর্তমানের হাত ধরে।
সে রাতে অনেকক্ষণ অরিত্র যেন ইচ্ছে করেই তিস্তার সাথে রোমান্টিক মুহূর্ত কাটালো, হয়তো কিছু ভোলার জন্য, কিন্তু একথাও স্বীকার না করে পারলোনা যে তিস্তাকে সে খুউব ভালোবাসে।
মৃগাঙ্কর বাহুবন্ধনে বনলতাও আজ নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিল, সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে লাগলো মৃগাঙ্কর ভালোবাসা। আজ তারও মনে হলো একদিন মৃগাঙ্ক যত ভুলই করুক না কেন আজ সে বনলতাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেয়।
তিস্তা আর অভিজয় ঘুমিয়ে পড়ার পর অরিত্র একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো- একটু পরে ঘরে গিয়ে নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত ডায়েরিটা নিয়ে এসে একটা কবিতা লিখলো–
“তোমার আমার পথ গেছে বেঁকে
ভালোবাসা তবুও গেছে থেকে
জীবনের কোনো এক অজানা অদৃশ্য বাঁকে।
যেতে যেতে ফিরে একবার তাকালে,
কিছু না বলেই গেলে চলে।”

Loading

Leave A Comment