গল্প- ঋণশোধ

ঋণশোধ
– রাখী চক্রবর্তী

 

দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেয় মা, বিকেল হতেই তো পাত্র পক্ষ চলে আসবে। যদি পছন্দ হয়ে যায় তোকে দেখে।–মা তোমাদের খুব চিন্তা হয় না আমার বিয়ে নিয়ে?আচ্ছা একটা কথা বলতো, রূপের তো এই ছিড়ি আমার,তাহলে মনি নাম কেন দিলে?

তুই আমাদের সোনা মেয়ে। ভুল করে মনি নাম দিই নি তো, চোখের মনি তুই তোর বাবার,আমার

-তোমার ঐ একই উত্তর। যতবার জিজ্ঞাসা করি ততবার ,,
-কি রে। মনি ঘুমিয়ে চোখ মুখ ফোলা যা চেহারা তোর হয়েছে। এবারও না যেন…

-বৌমা একদম বাজে কথা বলবে না। আমার মেয়ে ফেলনা না যে যার তার হাতে সঁপে দেব।

-দেখুন আপনার মেয়ের ভাগ্যে কি আছে? আমার খুড়তুতো ভাইয়ের সাথে তো বিয়ে দিলেন না। সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা হুমম ।

মনিকে আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। এই নিয়ে এগারোটা হল। পাত্র আসে মনিকে দেখতে, পরে খবর দেবো বলে সেই যে যায় আর এমুখো হয় না তারা।

মা কালীকে পুজো করবে সবাই কিন্তু ঘরের বৌ কালো হলেই যত বিপত্তি।

মনিকে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে কে জানে।

বিকেল পাঁচটার সময় ছেলের মা, বৌদি, দাদারা কলকাতা থেকে নারায়ণ পুর এল মনিকে দেখতে।
নারায়ণ পুর গ্রাম হলেও আলোর ব্যবস্থা ভালোই আছে। 
রাধাগোবিন্দর নাম নিয়ে মনির মা মেয়েকে নিয়ে এল পাত্র পক্ষের বাড়ির লোকজনের সামনে।
ছেলের নাম নয়ন দে।
– তোমার নাম কি মা
– মনি পাল
বাহ্ সুন্দর নাম তো।
এমনিতে মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। গায়ের রঙটা যা কালো। তা যাক গে, ছেলে আমাদের খুব ফর্সা কিন্তু 
মনি মনে মনে ভাবছে, গেল তবে এটাও, এত ফর্সা ছেলে নিশ্চৎই কালো মেয়েকে বিয়ে করবে না

-মেয়ে আমার খুব সুন্দর গান করে

মনি একটা গান গেয়ে শুনিয়ে দাও মা।
-ও ও, হ্যাঁ মা ।
মনি গান শুরু করল,’এত সুর আর এত গান যদি কোনদিন থেমে যায়” মাঝপথে গান থামিয়ে দিয়ে ওনারা বললেন, ও সব গান টান আমাদের বাড়িতে চলে না।

-তা কাজকর্ম কি কি জান?
মনির মা বলল, মেয়ে ঘরের টুকটাক সব কাজ পারে।
নয়নের মা বললেন, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে ।আপনারা নয়নকে একদিন এসে দেখে যান।
মনি দৌড়ে ঘরে চলে গেল। এবার মনি লজ্জাতে লাল হল কি?
কালো তো তাই ঠিক বোঝা গেল না।

নয়নের মা দু’দিন পর মনিদের বাড়িতে আবার এসেছেন। মনির হাতের মাপ নিতে। বালা,চুরি, আংটি
মনি বলছে ,আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে রইলাম মা।এ জীবনে না হোক আসছে জন্মে ঠিক শোধ করে দেব মা। আমার মত কুৎসিত মেয়েকে আপনি ঘরের বৌ করছেন।
-না বাছা কে বলতে পারে কখন সুযোগ চলে আসবে ঋণ শোধ করার। তখন না হয় করে দিও শোধ।

দু’দিন পর মনির মা, দাদা ,বৌদি নয়নের বাড়ি গেল নয়নকে দেখতে। বাড়ি ঘর সবকিছু ই তো দেখতে হবে। সবাই বলে লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না। মনির ক্ষেত্রে তো কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

মনি চাতক পাখির মত হাঁ করে বসে আছে কখন ওরা বাড়ি আসবে। পাকা কথা কি আজই বলবে। নানান দুশ্চিন্তা মনিকে ঘিরে ধরেছে ।

একটু রাত্রি হল ওদের বাড়ি ফিরতে।
মনি …মনি আয় মা তোর বিয়ে ঠিক করে এলাম মা।ছেলেকে খুব সুন্দর দেখতে। এত সুন্দর নয়নকে দেখতে। আমারা তো দেখে এলাম। তুই এক্কেবারে শুভদৃষ্টিতে দেখবি তোর স্বামীকে।

বৌমা বল,বল কেমন দেখলে নয়নকে

– ঐ ফর্সা বেশ ভালো কিন্তু চোখে তো কালো চশমা দেওয়া কি করে দেখব চোখ দুটো?
-তা শুনলে না চোখ উঠেছে নয়নের, লাল টুকটুকে চোখ। তাই কালো চশমা পড়ে আছে
-এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের আয়োজন করতে পারবেন তো মা।
– হ্যাঁ হ্যাঁ করতেই হবে। এত ভালো পাত্র হাত ছাড়া করব না।
গোধুলি লগ্নে মনির বিয়ে হল।
সবার একই প্রশ্ন পাত্রর চোখে কালো চশমা কেন?
মনির মা একই উত্তর দিচ্ছেন “নয়নের চোখ উঠেছে”
তোমার সব ঋণ শোধ করলাম। একমুঠো খই ছুঁড়ে সব খাবার শোধ করলাম মা , মা,যত অপমানিত হয়েছ আমার জন্য সব শোধ করলাম মা। ভালবাসা কি করে শোধ করব মা তোমার?

মনির চোখের পাতায় এক বিন্দু জল। মা তুমি এতদিন চোখের জল ফেলেছ। আর ফেলো না। হাসি মুখে বিদায় করো।কনকাঞ্জলী দিয়ে মা মেয়ের মুখ দেখে না।তাই মনির বিদায় ওর মা দেখল না।

মনির জীবনের চরম অধ্যায় শুরু হল।
ফুলশয্যার রাতে মনি জানতে পারল নয়ন অন্ধ।ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বলটা নয়নের কপালের নীচে লেগেছে। তারপরই সব অন্ধকার।

নয়নকে জড়িয়ে ধরে মনি বলল, তুমি আমার চোখ দিয়ে দেখবে। আমি তোমাকে আলো দেখাব।

নয়নের মুখে তৃপ্তির হাসি। বৌভাতের পরের দিন নয়ন ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজনদের সামনে বলল, মনি আমাকে ওর চোখ দুটো দেবে। আমি আবার দেখতে পারব। আবার পিউ আমাকে ভালবাসবে। আমরা বিয়ে করব। নয়ন খুশিতে পাগল। সবাই অবাক হয়ে গেল নয়নের মুখে এই কথা শুনে।

মনি হতবাক হয়ে গেল। কি বলেছে সে নয়নকে আর নয়ন কি বুঝল।

নয়নের মা মনিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মনির কাছ থেকে ঋণশোধ করার কথাটা বলল, তুমি তো বলেছিলে বৌমা আমার ঋণ তুমি শোধ করবে। এই সেই সময়। তুমি কথা রাখো বৌমা। আমার নয়ন আবার খেলবে আবার হাসবে। পিউ, পিউ ওর জীবন সাথী। আবার ওদের মিলন হবে। তুমি চাও না তোমার স্বামী দু’ চোখ ভরে পৃথিবীর আলো দেখুক।তুমি তো বিবাহিতা কেউ তোমাকে অপয়া বলবে না।ধন্য ধন্য করবে সবাই তোমায়।
নয়ন ওর চোখে মনিকে রাখবে এর থেকে আর কি ভালো হতে পারে বৌমা..

মনি ঘরের এক কোনে বসে আছে। ভাবছে সেই দিনের কথা। তাই কালো বলে কোন আপত্তি ওনারা করেননি সেদিন। মার মুখটা শুধু চোখে ভাসছে মনির।
এক মাসের মধ্যেই নয়নের মনি হয়ে উঠল মনি। এত ভালবাসা কেউ পায় না। ভাগ্য ভালো হলে তবেই থাকা যায় স্বামীর নয়নে।

আর মার ঋণ কেউ কোনদিন শোধ করতে পেরেছে? তাই তো মনি আবার মার কাছে ফিরে এল। মার ঋণ শোধ কখনওই যে করা যায় না।
মারুতি থেকে নেমে মনি পা রাখল নারায়ণ পুর গ্রামে।লাঠি নিয়ে এক পা পা করে এগোচ্ছে বাপের বাড়ির দিকে ।
– মা ,মা আমি মনি এসেছি
– মনি মা আমার কি হয়েছে?চোখে কালো চশমা হাতে লাঠি?
আমাকে থাকতে দেবে তো মা? আমি যে ঋণ শোধ করে এলাম মা।
– তোর চোখে কি হয়েছে?
– নয়ন অন্ধ ছিল মা। তাই আমার চোখ দু’টো দিয়ে দিলাম। আমি ওর চোখ দিয়েই পৃথিবীর আলো দেখব।
আর তোমার রাধা গোবিন্দকে বলো তো আসছে জনমে যেন কালো বর্ণ না দেয় আমাকে। কালো রূপে বড় জ্বালা মা,বড় জ্বালা

Loading

Leave A Comment