উষ্ণতার ছোঁয়া
– রাখী চক্রবর্তী
রোদের যা ত্যাজ একটু বিকেল গড়ালে কাজে যাতি পার তো, হ,
-সন্ধ্যা হলি তো মুশকিল।
কেউ দুয়ারের বাইরে আসতি চায় নে কো
ছলেধরা বলি সককলে চিললায় ওঠে
– আমাগো বড় পোলাটা গরমে ব্যরাম হয়ে শ্যাষ হইয়া গেল।
তুমার যদি শ্যাষে গরমে হেই দশা হয়। আমি থাকব ক্যামনে
পরাণ চাচা আর চাচি সুখ দুঃখ’র কথা কইচে।
– আগে আমাগো কাজের কদর ছেল এহন তো আমাগো কাজ ডগে উঠিল। নতন নতন ম্যাশিন আইছে বাজারে। পুরাতন আর কদদিন চলবে।
শিল কাঁটাও..শিল কাঁটাও…বলতে বলতে
ভর দুপুরে এক বয়স্ক লোক তিনানের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।
– ও দাদু, দাদু একটু দাঁড়াও আমি আসছি।শিল কাঁটাও মানে কি গো
-তুমি বুঝবে না বাবা।
-বল না ?
-মশলা করার জন্য শিল নোড়া লাগে। সেটাকেই একটু পরিষ্কার করে কেটে দিই আমি।
-আমাদেরটাও নিয়ে আসছি একটু দাঁড়াও।
তিনান এক ছুটে ঘর থেকে মশলার মেসিনের জারটা নিয়ে এসে বলল, দাদু এইটা পরিষ্কার করে দাও।
-না না এটা তো শিল নোড়া নয়।
-মা তো এতেই মশলা করে
-না বাবা এটা দুসরা জিনিস আছে। এটা ধনী পরিবারের লোক জন ব্যবহার করে।আমি আসি এখন
-দুপুর বেলায় তোমাকে ডাকলাম আমি।একটু কিছু খেয়ে যাও। ঠামমি বলেন, দুপুরে বাড়িতে কেউ এলে তাকে খাবার দিতে হয়।নাহলে নারায়ণ ঠাকুর রাগ করবে।
পরাণ চাচা ভাবল দু’দণ্ড জিরিয়ে নি তাহলে।যা রোদের ত্যাজ বাড়ছে।একটু পড়ে না হয়…
তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
-আমি আর মা
-একটু জল দাও তবে। তেষ্টাতে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে
-হ্যা দাদু ভেতরে এসো। এই নাও, জল খাও।
ঠামমি, “মাথায় অর্ধেক সাদা চুল আর অর্ধেক টাক। পরনে ময়লা একটা লুঙ্গি আর ছেঁড়া জামা”।এই দাদুকে আমি আমার ঘরে বসিয়েছি, জল দিয়েছি। এবার খাবার দেবো। নারায়ণ ঠাকুর আর রাগ করবে না তো। তিনান ফোন করে ওর ঠামমিকে শিল কাঁটাও দাদুর কথা বলল। এই গরমে দাদুর খুব কষ্ট হচ্ছে গো।
ঠামমি তো চিন্তাতে পড়ে গেল। চেনা নেই জানা নেই,,
তিনানের ঠামমি দিল্লিতে আছে এখন। ওর বড় পিপি নিয়ে গেছে ।
– দাদুভাই মাকে দাও ফোনটা
-মা তো বাথরুমে
-আচ্ছা মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে আমাকে ফোন করতে বলো।
তিনান ‘হ্যাঁ’ বলে ফোনটা রেখে দিল।
এই কাঠফাটা রোদে আবার যেতে হবে তোমাকে তাই না দাদু
-এসব অভ্যেস আছে আমার বাবা
-তোমার নাম কি?
-তিনান দে
-তোমার নাম কি দাদু?
-আমাকে সবাই পরাণ চাচা বলে ডাকে
আচ্ছা তবে আমিও তোমাকে পরাণ চাচা বলে ডাকব
-তিনান, এই তিনান
ওই মা ডাকছে। তুমি বসো আমি আসছি।
আয় সোনা,খাবি না। কত বেলা হয়ে গেল।
-মা আমার সনতু মা।
-আচ্ছা,এত আদর কিসের? হ্যাঁ!
-আমি আমার রুমে খাব আজ।
-ও এই ব্যাপার। ঠিক আছে সব খাবার হাম হাম করে খেয়ে নেবে কিন্তু।
-হ্যাঁ মা
মা ঠামমি তোমাকে ফোন করতে বলেছে
তিনান ওর খাবার নিয়ে এসে পরাণ চাচাকে বলল, তুমি খাবার টা হাম হাম করে খেয়ে নাও। একটু রোদ কমলে তারপরই তুমি এখান থেকে যাবে।
তিনানের মা ওর ঠামমির মুখ থেকে সব কথা শুনে রাগে জ্বলতে জ্বলতে তিনানের ঘরে গেল। পরাণ চাচা একগ্রাস ভাতের দলা সবে মুখে দিয়েছে, এর মধ্যে ছেলেধরা, চোর বলে চিৎকার চেঁচামিছি শুরু করে দিয়েছে ওর মা।বাঁচাও…বাঁচাও …
– মা আমি ছেলেধরা বা চোর নই। আমি শিল নোড়া কাটাই।
এই বাচ্চাটাই আমাকে ডেকে এনেছে আমি আসতে চাই নি।
খুব তেষ্টা পেয়েছিল তাই একটু জল খেয়েছি।
-আর এই খাবার। আমার তিনানের খাবার এর দিকে নজর গেছে।
তিনান ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে বলল,
মা পরাণ চাচা খুব ভালো মা। আমি ইচ্ছে করে খাবারটা দিয়েছি পরাণ চাচাকে। বাইরে
এত রোদের তাপ, একটু না হয় এ.সি.তে বসে চাচা বিশ্রাম নেবে।
এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে পাড়া প্রতিবেশীরা সব ছুটে এল তিনানের বাড়িতে। ছেলেধরা দেখবে বলে কথা। এই সুযোগ কি কেউ ছাড়ে।
পরাণ চাচাকে প্রথমে একটা লাইলনের দড়ি দিয়ে ভাল করে বাঁধা হল তারপর লাঠি ,বেল্ট দিয়ে মার শুরু হল।
এর মধ্যে আবার পুলিশে কেউ খবর দিয়েছে।
পরাণ চাচা আধমরা হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তিনানের কথা কেউ শুনল না।
পুলিশ এসে পরাণ চাচার শিল নোড়ার সব জিনিসগুলো দেখল। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পরাণ চাচা।
পুলিশ চাচাকে সোজা করতেই চমকে গেল।
রায়দা দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা
-আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, ইনিই তো স্কুলের বাচ্চাটাকে..
তিনানের মা বলে উঠল, কি সাংঘাতিক কাণ্ডটাই না হত, আমি যদি ঠিক সময় বাথরুম থেকে না বের হতাম। আমার শাশুড়ি মা যদি ফোন করতে না বলতেন তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত।
পুলিশ ইনসপেক্টর রায় বাবু বললেন আপনারা খুব ভুল করেছেন। ইনি ছেলেধরা বা চোর নন।
তিনানের কাছ থেকে সব শুনলেন রায় বাবু। তারপর বললেন, কিছু দিন আগে দুপুর বেলায় স্কুল ছুটির পর একটা বাচ্চা ছেলেকে ছেলেধরার দল বস্তার মধ্যে পুরে নিয়ে যাচ্ছিল। এই চাচাই পুরো দলটাকে ধরিয়ে দিয়েছিল।
তিনান বলল, আমি বলেছিলাম না মা চাচা খুব ভালো।
তুমি তো গল্প বলেছিলে মা দইওয়ালা খুব ভালো ছিল। তাহলে শিল কাঁটাও দাদুকে খারাপ বললে কেন?
আমি আর ককখনো দইওয়ালার গল্প শুনব না।
বেশ খানিকটা সময় লাগল পরাণ চাচার চোখ মেলতে।
পরাণ চাচা চোখ খুলতেই রায় বাবু বললেন, আপনাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসি। চলুন।
পরাণ চাচা তিনানের মাথায় হাত দিয়ে বললেন নারায়ণের দর্শন পেয়েছি। আমি ঠিক একা যেতে পারবো।
পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের শেষ রশ্মিকে সাথে নিয়ে এক পা এক পা করে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলেন পরাণ চাচা শিল কাঁটাও…শিল কাঁটাও…