নতমুখী
– সত্যেন্দ্রনাথ পাইন
“কলম” কথাটার মধ্যে মাত্র তিনটি অক্ষর। অথচ বাংলা স্বররর্ণে ও ব্যঞ্জন বর্ণের ব্যাখ্যায় এর তুলনা ভগ্নহৃদয়ে প্রেমহীন হয়ে বেঁচে থাকার সামিল।
Pen is mighter than sword. মানে করলে দাঁড়ায় ” অসির চেয়ে মসি দড় “;! তবু , অসি বা তরবারি সর্বদা ঊর্ধমুখী।সে বিপ্লবে হাত না লাগিয়েও বিক্ষিপ্ততায় ধ্বংস করে কারোর চূড়ান্ত সফলতা কিংবা জীবন। আর “কলম” প্রতিনিয়ত বিপ্লবী। বিপ্লব যেন তার ঘনিষ্ঠতম আপন। তবু সে নম্র স্বভাবী, বিনয়ী, এবং শ্রান্তি হীন প্রেমিকা।
যে বা যারা এই কলম নিয়েই ক্ষমতা বান হতে চায় বা চান সে বা তাঁরা ভাবেন কি কলমের সততা আয়ত্বা ধীন নয়? ভাবেন না। বোধহয়। তাই “ভালবাসি” -টুকুও নিছক অভিমানে তাদের কলম থেকে বেরিয়ে আসতে অবসাদগ্রস্ত হয়।
কলম তো নতমুখী। সোজা করে ধরলে কিংবা উঁচুতে তুলে ধরলে”কলমে”র অপঘাতে মৃত্যু ঘটে। সেখানে উপেক্ষা, নির্লিপ্ততায় অহংকার জন্মায় না। বিচ্ছেদ ঘটে। অর্থাৎ’কলম’ বিনম্রচিত্তে বিপ্লবাত্মক হয়েও ভালবাসা পেতে ও দিতে চায় সকলকে সবসময়ই।
যারা এই কলম ধারী তারা বোঝেন নিশ্চয়ই কোথায় প্রেম আর কোথায় অবসাদগ্রস্ততা থেকে পিছু হটার ডিপ্রেশন।ঠেলতে ঠেলতে যখন কেউ কুয়োর কিনারে মৃত্যুকে খুব সামনে থেকে দেখতে পায় তখনও সে কলমকে সাথী করে তার মৃত্যুর প্রমানপত্র হিসেবে রেখে যেতে চায় জটিলতার অহংকারহীন ভালবাসা। এবং সেটা অবশ্যই নতমুখীনতারই পরিচয় বহন করে। তাই নয় কি!?
এখানে সংস্কৃতিচর্চার সুর – তাল- লয়- ছন্দ যেমন আছে তেমনি আছে “মা”হয়ে”স্ত্রী”হয়ে ভালোবাসা মাপার যাদুকরী মানদণ্ড স্বরূপ উন্মোচন। এখানে বেড়ে ওঠা দেদীপ্যমান জ্যোতির সাথে পূরুষতান্ত্রিকতার ছোঁয়া থাকলেও সে নারী স্বরূপা মৃন্ময়ী । অবজ্ঞা তার অজানা। সে নিথর হয়েও, প্রেমাভিলাষী হয়েও ছলাৎ ছল অবহেলাকে “তুড়ি মেরে দৃঢ়তায় এগিয়ে নিয়ে চলে। তবু তার মুখ নয়। বিনম্রতায় বিশ্বের ধুলোবালিছাই থেকে ঘরে ফিরে”ভালবাসতে'”চায়। সে সামনে না থেকেও পূর্ণ প্রেমিক হত্যায় পূর্ণতা পেতে চায়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সে অভিনয় করে বিনম্রচিত্তে। তাতেই চির জনপ্রিয়তা এবং স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ্য করি। বিদূষী স্ত্রী হয়েও কোমল কঠোর রূপী সহচরী। প্রশংসা, নিন্দা সবই তার জানা।
তবু, চরিত্রাঙ্কনে, স্বদেশ প্রেমে, অশ্রুময়তায় এবং প্রবলতায় সে মা গান্ধারী যেন। তিনি পুত্রশোকে মূল্যমান হয়েও সদা ধর্মের জয়গান গেয়েছেন নতমুখে। এটাই তো মহা-ভারত।
অথচ, সেই ভারতেরই জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী একদিন pen strikeবা কলম ধর্মঘট ডেকেছিলেন। এবং তাতেই দুর্ধর্ষ প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ভয় পেয়েছিল। নতমুখী কলম বোঝাতে চেয়েছিলেন অবগুণ্ঠন ঢাকা প্রেয়সী স্ত্রীও পুরুষকে হার মানাতে সক্ষম।
অতএব হে কলমচীগন, উপেক্ষিতা না হয়ে নিজস্ব নন্দন চর্চায় সামিল হতে জীবনসঙ্গী রূপী লেখাকে পরকীয়া না ভেবে ট্র্যাজিক সম্পর্কের বিফলতা য় প্রসারিত প্রতিভা, উদ্দীপনায় অনিবার্যভাবে অভিশপ্ত অনিন্দ্য সুন্দর অসহনীয় সৌভাগ্যের শিকড়ে আত্মবিশ্বাস প্রস্ফুটন করাকেই নতমুখে পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করার বিতর্কিত নিত্যসঙ্গী করার যুদ্ধে প্রাণের মানুষের অসহায় পরিণতি কে না দেখার প্রয়াস করে কলমের নীড় বাঁধাকে সাথী করার লক্ষ্যে ছবি আঁকলে কেমন হয়! অপূর্ব “সাহিত্যকুঞ্জ” তখন যথার্থই প্রযোজ্য মনে হবে এ নতমুখী কলমের পুষ্পবৃষ্টিতে।
আর আমি ও তাই সেই কলম নিয়েই এখন নাটুকে কলমচি হবার বাসনায় বিষাদকে ভুলে আইনসিদ্ধ পরকীয়ার মোহে নতমুখে প্রমানিত করতে চেয়েছি কলমের নম্রতা ভরা দৃঢ়তা ওপ্রত্যয়ভরা উপলব্ধির জমিদারীত্ব। দেখেছি তুলনাহীন বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের দরবারে মহামানব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্র, সুকান্ত, জীবনানন্দ, নজরুল, শেলী, কীটস্ , বায়রণ পৃভৃতি অসংখ্য যাঁরা কলম ধরেছেন এবং সাহিত্য সেবায় মনোনিবেশ করে সম্মানের শিখরে পৌঁছেছেন প্রত্যেকেই ঐ নতমুখী কলমের অনায়াস অনর্গলতার আশ্চর্য গুনে ও শিল্পিত সভ্যতায়।
তবু কলম চিরকালীন নতমূখী।
সোনাদানা হীরে জহর, মনি মুক্তা দি রত্ন ই কেবল অলংকার নয়। অলংকার মানে তো নারীর ভূষণ। নারীদেহের অলংকার যেমন নমনীয়তা। তেমনি কলম থেকে উদ্গীরণ হোলো লেখকের মনের একান্ত অভিব্যক্তি- যা লেখাটিতে নানা রকম ফুলে ভরিয়ে প্রত্যয় ঘণীভূত করে; অলংকারে পরিণত হয়। সৌন্দর্যের ড্রইংরুমে রসসৃষ্টি করে। এবং স্থানীয় স্বীকৃতি অর্জন করে
রূপ ও দামে যাই হোক না কেন “কলম” তবু কলম ই এবং অতিবিনয়ী নতমুখী।
অস্বীকার করার উপায় নেই কলমের শিল্পিত মনের আদিগন্ত বিস্তৃতি অসাধারণ অলংকার —যা বাজারে কেনাবেচা চলে না!