পান্তা ভাত
-অমল দাস
-পান্তা পান্তা পান্তা… আরে পান্তই তো খেতে বলেছে! তো কি হয়েছে? মুখের মধ্যে দিয়ে ঠুসে তো দেয়নি? বিষও দেয়নি! তাই বলে এতো কাণ্ড? রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসবি?
-মা তুমি আমাকেই বকছো? তুমি আমার মা তো, না ওর? এখানে আসাই আমার ভুল হয়েছে…
-হ্যাঁ এসেছিস কেন? বিষ দিলে না হয় থানা পুলিস করতাম। পান্তার জন্য কি নতুন আত্মীয়ের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করতে যাব!
-আমি কি তাই বললাম তোমাকে, ঝগড়া করতে যাও? একটু উগ্র কণ্ঠেই বলে।
-তাহলে এলিই কেন? জামাই বা দিয়ে গেলো কেন? যে জামাই হাসি ছাড়া কথা বলে না! সে আজ একটুও কথা না বলেই চলে গেল! নতুন সংসার কিভাবে মানিয়ে চলতে হয় সেটাও বলে দিতে হবে! বয়স তো কম হয়নি!
-এ ব্যপারে তোমাকে আমার কিছুই বলা উচিৎ হয়নি! বিয়ের পর ছ’মাসেই যে আমি পর হয়ে গেছি বুঝিনি। আগামীতে আর আসবো কি না ভাববো।
-সে যা ভালো বুঝিস করবি।কিন্তু রাগ মিটিয়ে ও বাড়ি গিয়ে উঠ, তারপরই না হয় ভাবিস। এবার একটু থেমে নিজেই আস্তে আস্তে বিড়বিড় করতে লাগলো, আমাদেরই ভুল ছেলে মেয়েদের ভালোমন্দ খাইয়ে আদর যত্নে বাড়িয়ে তুলেছি তো, যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি, যা খেতে চায়নি তা দিইনি! যদি ছোট থেকেই পান্তাভাত ঠেসে ঠেসে খাওয়াতাম তাহলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না! রাতের জল দেওয়া ভাতে সকালে শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে বা পিয়াঁজ কুচিয়ে বা আলু ভাজা, কাঁচা লঙ্কা-নুন দিয়ে মাখিয়ে খেতে যে কি স্বাদ.. সে আর এজনমে বুঝবি না। বোঝাতেও পারলাম না!….
এখানে নবীন বিবাহিতা মেয়ে পামেলা ও তার মা জয়শ্রীর কথোপকথন তুলে ধরা হোল। পামেলার বিয়ে হয়েছে ছ’মাস পূর্ণ হয়ে সাতে পড়েছে। আজ সকালে পামেলার শাশুড়ি সুমেধা তার ননদের বাড়িতে পূজা অনুষ্ঠানের জন্য গেছে বিকালেই ফিরবে। যাওয়ার সময় পুত্র রিতেশ কে বলে গেছে -টিফিন কিছু করলাম না, জল দেয়া ভাত আছে খেয়ে ডিউটি যাস! আর বৌমা যদি খায় তো খাবে, না হয় কিছু একটা করে নিতে বলিস।
রিতেশ বিকেলে ডিউটি থেকে ফিরে হাত পা ধুয়ে টিভি চালিয়ে নিউজ দেখছে। পামেলা রিতেশের জন্য হালকা টিফিন সাজিয়ে নিয়ে এলো, খেতে খেতেই জিজ্ঞাস করলো- দুপুরে কি রান্না করলে? পারলে… কিছু করতে?
একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে অভিমানী সুরে পামেলা উত্তর- যাহ্… এভাবে বলছ কেন? আমি কি রান্না জানি না! মা করেন বলে আমি করিনি এতো দিন, তাই বলে মা না থাকলে কি করব না!
-কি জানি মা থাকলে তো সকালে টিফিনটা হয়! আজ তো হোল না! পান্তা খেয়ে গেলাম। তা তুমি কিছু বানিয়ে খেলে না তুমিও পান্তা…
শেষ হয়নি তার আগেই পামেলা বলে ওঠে- আমাকে পান্তা খেতে বোলনাতো, আমার ভালো লাগে না!
-তাহলে কি খেলে?
-কিছুই না!
-সাড়া সকাল না খেয়ে রইলে, তবু পান্তা খেলে না? একদিন না হয় খেয়েই দেখতে! শুধু শুধু ভাতটা নষ্ট হোল।
-দেখ ভাত নষ্টের দায় আমাকে দিও না, আমি খাইনা জানো! তবুও মা মাঝে মাঝেই আমাকে খেতে বলেন। সেটা আমার ভালো লাগেনা।
-মা খেতে বলে মানে…? তোমাকে কি বলেছে নাকি খাও বা খেতেই হবে! এমন তো জোর করেনি!
ব্যস এই এক কথায় দু কথায় একটু মনকষাকষি হতেই নতুন বউ হয়ে আসা পামেলা অভিমানী হয়ে বলে ওঠে- আমি আজ বাড়ি যাবো যদি পারো দিয়ে এসো একবার! না হয় আমি নিজেই…
রিতেশ আর কোন রকম বাঁধা না দিয়েই নির্লিপ্ত সুরে শুধু বলল, তৈরি হও দিয়ে আসছি।
রাতে সুমেধা ফিরে বৌমাকে ঘরে না দেখে রিতেশকে প্রশ্ন করে, তুই ঘরে, বৌমা কোথায়?
রিতেশ মুখ লুকিয়েই উত্তর দেয়- বাড়ি গেছে।
মা আঁচ করতে পেরেছিল রিতেশ মিথ্যে বলছে, তাই শুধালো হঠাৎ বাড়ি কেন? কি হয়েছে?
-ওর মা ফোন করেছিলেন তাঁর শরীরটা ভালো নেই তাই দেখতে গেছে।
-তুই নিয়ে গেলি না একাই… একটু থেমে আবার প্রশ্ন- কবে আসবে কিছু বলল?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই রিতেশ একটু উদাস সুরে বলল- যাক! গেছে, দেখি কবে আসার ইচ্ছে হয়!
মায়ের মনে সন্দেহ হোল ভাবল আমি বাড়ি থেকে কি গেলাম! অমনি ঝগড়া মনকষাকষি। বা হঠাৎ কি কাণ্ড করলো দুজনা যে, একজন বাপের বাড়ি আর একজন ঘরে বসে চুপচাপ! প্রশ্ন অনেক তবুও আর বিশেষ কিছু বলল না.. চুপ করে পাশের ঘরে চলে গেল।
পামেলা রাতে মায়ের সাথে ঝগড়া করে প্রায় না খেয়েই শুয়েছিল। তাই সকালে একটু বেলা করে ঘুম ভাঙতেই খিদেয় পেট কামড়াতে থাকে। ওর বাবার মুদি দোকান আছে বাজারে কাছে, মা’ও বাবার সাথে গেছে কিছু সব্জি নিয়ে ফিরবে। যাওয়ার সময় বলে গেছে- ডিম রুটি আনা আছে, জ্যাম, জেলি, কলা-দুধ কর্ণফ্লেক্স, বাটার সবই আছে যা ইচ্ছা, করে খেয়ে নিতে, রাতে তো দানা-পানি কিছু পড়েনি! খিদে লাগবে নিশ্চয়ই?
পামেলা বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে ঢুকে এটা সেটা হাতাতে থাকে। ডিম রুটি কলা চোখের সামনেই ছিল কিন্তু সে কিছু অন্যই খুঁজছে হয়তো! একটা ছোট গামলার ঢাকনা খুলেই দেখে সেখানে অল্প জল দেয়া ভাত রয়েছে, যা আছে খেলে তার চলে যাবে।সে রুটি ডিম জ্যাম জেলি ভুলে পান্তার দিকে ধ্যান জ্ঞান দিয়ে একাগ্র চিত্তে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ এভাবেই দেখে মনে মনে কি হিসাব নিকেশ করল জানা নেই! হয়তো ভাবলো খেয়ে দেখি বিষ না সুস্বাদু, কিছু তো হবে! হয় মরব না হয় পেট ভরবো। রাগ তো আছেই মায়ের উপর শাশুড়ির উপর রিতেশের উপর যা হয় হবে। হয়তো এমনটাই ভেবে ছিল বা অন্য কিছু, সে আলু পিঁয়াজ কেটে গ্যাস জ্বেলে কড়াইয়ে ভেজে নিলো। তারপর পান্তা থালায় তুলে একবার জল দিয়ে ধুয়ে আবার একটু জল নিলো। তারপর নুন কাঁচালঙ্কা আর ভাজা দিয়ে মেখে নিলো। এবার মুখে দেওয়ার আগে সে কেমন একটা গন্ধ অনুভব করে মুঠো ভাত আবার থালায় রেখে দিলো। কিছুক্ষণ নিশ্চল থেকে আবার নাক চেপে মুখে দিতে লাগলো, তখন তার চোখে অবজ্ঞার জল ছলছল করছে। কিন্তু প্রথম গ্রাস গিলতেই কি অনুভব করলো সেই জানে। তারপর আর এক গ্রাস তারপর আবার তারপর… এভাবেই নিমেষে শেষ করে নিলো। এটা যে খুবই সুস্বাদু সেটা কিছুক্ষণ পরেই তার মুখ ও শরীরী হাব ভাবেই স্পষ্ট ছিল এবং এই গরমে বেশ আরামদায়ক সেটা সে বুঝেছিল।
মা ফিরে এসে মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাস করল না, হয়তো রাতের রাগ এখনো রয়েছে। রান্না ঘরে ঢুকে দেখে ডিম রুটি আর বাকি সব তেমনই পড়ে আছে, ভাতের জায়গাটা খালি। মা বুঝল স্নেহ মিশ্রিত আনন্দে মুচকি হাসলো, তবু চুপ রইল, অপেক্ষায় রইল মেয়েই এসে বলুক তার পান্তার অভিজ্ঞতা।
পামেলাকে আনার জন্য সুমেধা রিতেশকে সকালেই বলে রেখেছিল, এদিকে পামেলাও বিকেলে রিতেশকে ফোন করেছে নিতে আসার জন্য। সেই মত রিতেশ সন্ধ্যার পরেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তবে রাতে তার আর ফেরা হয়নি, শ্বশুর-শাশুড়ির আপ্যায়নে সেখানেই থেকে গিয়েছিল। এদিকে রিতেশের ডিউটি যেতে হবে তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে আর দেরি না করেই দুজনে বেরিইয়ে পড়েছিল। ফেরার পথে রিতেশের খোঁচা দেয়া প্রশ্ন, রাগ মিটেছে না কি বাপের বাড়ির ভাতও হজম হোল না? পামেলা শুনেও শুনলোনা, লজ্জিত তবে অভিমান মুছে রেখে খোলা বাতাসে মনের ডানা মেলে ধরেছে।
বাড়ি ফিরে পামেলাকে নামিয়ে রিতেশ অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। পামেলা শাড়ি বদলে রান্না ঘরে শাশুড়ি মায়ের সাহায্য করতে লেগে যায়। বেলা বাড়তেই সুমেধা বলে ওঠে বৌমা টিফিন আছে খেয়ে নাও! ঐ সকালে বেরিয়েছ নিশ্চয়ই কিছু খাওনি! রিতেশকে বললাম সেও খেলো না অফিস যেতে দেরি হবে বলে। হয়তো ওখানে কিছু খেয়ে নেবে! তুমিও কিছু খেয়ে নাও খালি পেটে থেকোনা।
পামেলা তখন সব্জি কাটছিল মাথা নিচু করেই সলজ্জিত ভাবেই বলল- মা জল দেয়া ভাত আছে? তাহলে দিন আমি খাবো!
সুমেধা মাথা তুলে পামেলার দিকে চেয়ে রইল এবং চোখে একটা হাসির ঝলক ফুটে উঠলো। যে মেয়ে পান্তার নাম শুনতে পারেনা সে আজ… যাই হোক ভাবনায় অনেক কিছু ছিল তবু সে ভাবল না, স্নেহের হাত রাখতে চেয়েছিল পামেলার মাথায় কিন্তু রাখল না। পামেলার অবনত নিষ্পাপ মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, মাতৃ স্নেহে চোখ ছলছল করে উঠলো। কোন সাড়া না পেয়ে পামেলা যখন শাশুড়ির দিকে তাকায় তখন সুমেধা সজল চোখ লুকাতে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়। যদিও পামেলার তা অগোচরে রইল না, সে আবার মাথা নত করে নিশ্চুপ ভাবে সব্জি কাটতে লাগলো।
সুমেধা হাসি মুখেই মৃদু স্বরে বলল, বৌমা তুমি পান্তা খাবে কেন? টিফিন করেছিতো সেটাই খাও!
-না মা আজ পান্তা দিন আমি খাবো।
-না বৌমা ওটা তোমার খেতে হবে না, খাওয়ার সময় অবজ্ঞা ধরে নিলে কিন্তু শরীর খারাপ হতে পারে! তুমি টিফিনটাই নাও, জল দেয়া ভাত বেশি নেই ও আমিই খেয়ে নেব।
-দিন না মা! আজ দুজনা ভাগ করে খাই।
এই কথা বলেই পামেলা শাশুড়ি সুমেধার দিকে তাকাল সুমেধাও পামেলার দিকে, একজনার গভীর আব্দার অনুযোগের চোখ তো অন্য জনার সন্তান বাৎসল্যের আত্মিক আন্তরিকতার চোখ, সে এক গভীর আবেঘ ঘন মুহূর্ত, যেন সংসারের সমস্ত মায়া সুখ শান্তি এই একটি পলকে উজ্জীবিত হয়ে যায় এবং এই স্বল্প নয়নালাপেই সুদীর্ঘ সুদৃঢ় এক আত্মীয়তার বন্ধনের ভাষা ব্যক্ত করে দেয়।
এই অল্প সময়েই দুজনার চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। তখন নিজেদের সামলে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চোখের কোন মুছতে কাপড়ের আঁচল তুলে ধরে। সাময়িক চুপ থেকে সুমেধা বলল- একটু বস বৌমা কটা ডাল ভিজিয়ে রেখেছিলাম, পাটায় বেটে বড়া ভেজে নি, তাই দিয়েই দুজনা আজ খুব করে পান্তা খাবো।
তখন পামেলার মুখমণ্ডলে দখিণা বাতাসের সমারোহ, আনন্দ উৎফুল্ল উছ্বলে পড়ছে, যা নিমেষেই চোখে ধরার মত, এই উৎসুক আবেগে সে বলেই ফেলল- মা! আজ কিন্তু আমি আপনার হাতেই খাবো।
সুমেধা শুনে একটু আচম্বিত হোল কিছুক্ষণ পামেলার পানে চেয়ে থাকে। তারপর উঠে এসে পামেলা কে জড়িয়ে ধরে। তার চোখের জল তখন ছলছল নয়, রীতিমত গড়িয়ে পড়ছে। পামেলার পিঠে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই ঠোঁটে শব্দ বেরিয়ে এলো- মা তুমি আমার কত জন্মের পুণ্যের ফল বলতো! আজ তোমাকে পেয়ে আমার মেয়ের অভাব আর রইল না মা, তোমাকে এভাবেই বুকে ধরে রাখব সারা জীবন। এভাবেই…! এভাবেই কেটে গেল কিছু সময়।