গল্প- মাতৃ সুখ

মাতৃ সুখ
– রাখী চক্রবর্তী

 

মিলি আর রবির সুখের সংসার। রবির বাবা অনেক বছর হল গত হয়েছেন। তাই মাকে রবি চোখের আড়াল করে না। মা বলতে পাগল রবি। মার পাগল ছেলে রবি।
নাতি নাতনিদের নিয়ে খেলবে মজা করবে কত আশা রবির মায়ের। কিন্তু মিলি এখন সন্তান চায় না। বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেল।এখনও সন্তানের মুখ দেখল না রবি।
মিলি শাশুড়ির কোন দেখাশোনা করে না।নিজের বন্ধুদের নিয়েই মত্ত থাকে সর্বদা।
রবি বোঝাতে থাকে মিলিকে, যে মেয়েদের মাতৃত্বেই আসল সুখ। মা ডাক শুনলেই তোমার মন শান্তিতে ভরে যাবে। মিলি এ সব কথাতে পাত্তা দেয় না।
এই ভাবেই চলছে রবি মিলির সংসার।
হঠাৎ সেদিন রাত্রি বেলায় মিলি খুব রেগে গেল ঘুঙুরের শব্দ শুনে
ছুন, ছুন, ছুননন,ছুননন,,,
বাপরে আর পারিনা। মিলি কানে বালিশ চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
– বৌমা একটু জল দেবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে। আর একটু গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত দাও খুব খিদে পেয়েছে।
মিলি চোখ খুলে দেখল শাশুড়ি মা ওদের খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ঘুঙুর
-এতো রাতে তোমার মার আবার ভীমরতি শুরু হল। এই বুড়িটা আর কত জ্বালাবে কে জানে?
এই রবি ওঠো ওঠো। যাও মাকে ঘরে নিয়ে যাও। কি হল…ওঠো।
-এত রাতে আবার কি হল? ঘুমাতে দাও
-শুনছ না ঘুঙুরের শব্দ। এই দেখ মা আমাদের ঘরে চলে এসেছে। এই চার দিন তুমি ছিলে না রাত বিরাতে কোন ঝামেলা করেনি যেই তুমি আজ এলে ওমনি…শুরু হল

-সত্যি তো, বাড়ি ফিরে মার সঙ্গে একবারও দেখা করলাম না। রাত এগারোটা বেজে গেল তাই ভাবলাম মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল সকালে মাকে দেখব। তা তুমি এই চারদিন মাকে ঠিক করে দেখে রেখেছো তো।খাবার ঠিক মতো খেয়েছে তো মা। চলো, মাকে ঘরে দিয়ে আসি। মা, মা কোথায় গেল মা
-এইমাত্র তো দেখলাম এখানে দাঁড়িয়ে ছিল।
ঘর থেকে রবি বাইরে বেরিয়ে দেখল মা তো নেই।
মিলি বলল, এই মাত্র তো ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার কাছে জল চাইল…ঐ তো, ঐ তো, মা বারান্দায় বসে। মা মা বলতেই রবির মা উধাও।
মিলি বাথরুমে গেছিল হঠাৎ
চিৎকার করে বলল- রবি তোমার মা আমাদের বাথরুমে। কতবার মাকে বারণ করেছি। কেন এসেছে?
রবি বলল, আমার মার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে এটা আমার মার বাড়ি।রবি বাথরুমে এসে দেখল মা নেই। মা কোথায় গেল?
মিলি বলল, মাকে তো বাথরুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম না। এই দেখো মার ঘুঙুর।
রবি ভাবল মার সাথে দেখা করতে যাই নি বলে এত রাতে মা আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। রবি মার ঘুঙুরটা হাতে নিয়ে বারান্দায় আসতেই মা বলল, কেমন আছিস বাবা।
– মা তুমি বারান্দায় বসে কেন? ঘরে চল ।
– না ,তুই এখানেই বস
– মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তোমার কোলে আমি শুলাম। এবার বলো মিলি তোমার যত্ন করেছে তো মা। ঠিক ঠাক ওষুধ খেয়েছ তো মা?
– আমাকে জল দে খুব তেষ্টা পেয়েছে। রবি মাকে জল খাইয়ে দিল। মা তোমার হাত এত ঠাণ্ডা কেন! একটা চাদর গায়ে দাও।
রবি চাদর আনতে যাবে ওর মা বলল, থাক লাগবে না। তুই একবার আমার ঘরে যা। তুই কাজে চলে যাওয়ার পর আমি পা পিছলে বাথরুমে পড়ে গেছিলাম রে।
– কি বললে মা,মা কোথায় গেলে! আমার সঙ্গে কথা বলছিলে তো!
মিলি…মিলি
– কিসের এত হাঁক ডাক তোমার। কি হয়েছে
-মা বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে আমাকে বলোনি কেন?
এখুনি চল মার ঘরে।

রবি মিলিকে নিয়ে মার ঘরে গেল। দরজাটা ভেজানো আছে। দরজা ঠেলতেই পচা গন্ধতে ওদের বমি চলে এল।
মাটিতে পড়ে আছে রবির মা। মাথাটা ফাটা।রক্ত জমাট। চারপাশে পোকামাকড়। সাদা শাড়িটা লাল ছোপ ছোপ। মুখটা হাঁ করা।যেন কিছু বলতে চাইছে।
মিলি তো এই চারদিনে একবার ও এই ঘরে আসেনি। আসলে হয়তো জানতে পারত যে মা কবে মারা গেছে ।
রবি ভাবতে লাগল মা যে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, জল খেল আমার হাতে। তাহলে কে এসেছিল?
মিলি ভয়ে কাঁপতে লাগল। মা তো খাবার খেতে চাইল, জল চাইল ওর কাছে।

রবির মা একজন বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী ছিলেন। গত দশ বছর হল উনি নাচ করা ছেড়ে দিয়েছেন। কোমরে চোট পেয়েছিলেন তাই ।
কিন্তু ওনার ঘুঙুরকে উনি ছাড়তে পারেন নি।সকাল, দুপুর ,রাত্রি উনি ঘুঙুর নিয়ে হাতে তাল দিতে থাকেন।
মিলি এইগুলো সহ্য করতে পারে না। তাই রবি কাজের জন্য চারদিন বাড়ি থাকবে না এই সুযোগটাই কাজে লাগাল মিলি।
রবি জানতেও পারল না ওর মার সাথে ঠিক কি কি হয়েছে ।
রবি চারদিন আগে যখন ওর মার সাথে দেখা করতে গেছিল তখন ওর মার সামান্য জ্বর ছিল গায়ে। মিলিকে বারবার বলেছিল ডাক্তার এর কাছে মাকে নিয়ে যেও।অফিসের কাজে যেতেই হবে তা না হলে রবি কখনওই মাকে এই অবস্থায় রেখে যেত না।রবি চলে যাওয়ার পর মিলি একবার ও অসুস্থ মার ঘরে যাইনি। খাওয়ার দেওয়া তো দুর অস্ত জলটুক ও দেয় নি। এই চারদিন ধরে রবির মা জীবনের সাথে কি যে লড়াই করেছে তা রবি জানতে ও পারল না।
রবি মার এই দশা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।মিলিকে ঘেন্না করছে রবি।
মিলি তো খুব খুশি। আপদ বিদেয় হল।ডাক্তার বাবুকে খবর দিল রবি,
ডাক্তার বাবু বললেন, দু’দিন আগেই উনি মারা গেছেন।
রবি একরাশ আফশোষ নিয়ে ওর মাকে দাহ করতে গেছে।
এর মধ্যে মিলি কিছুতেই ঘরে থাকতে পারছে না। ছম ছম ছুন ছুন শব্দ ঘরময় ছেয়ে গেছে।

-“একটু জল দাও বৌমা। একটু গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত দাও খুব খিদে পেয়েছে।” বারান্দা,ছাদ, এ ঘর ও ঘর যে দিকে যাচ্ছে মিলি শুধু মাকে দেখছে।আর ঘুঙুর এর ছুন ছুন শব্দ শুনছে ।
রবি মাকে দাহ করে বাড়ি ফিরে এসে মিলিকে কোথাও দেখতে পেল না।
খোঁজ শুরু হল মিলির, পুরো বাড়িতে খুঁজল রবি, কিন্তু না নেই বাড়িতে মিলি ।
পাড়ার একটা ছেলে এসে বলল রবিদা, মিলি বৌদি পাড়ার সব বাড়িতে গিয়ে জল খেতে চাইছে আর বলছে গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত দাও। খুব খিদে পেয়েছে।
রবি ওই ছেলেটার কথা শুনেই দৌড়ে গেল মিলিকে আনতে। মিলিকে দেখে রবি হতবাক হয়ে গেল।পাগলের মতো অবস্থা হয়েছে মিলির। মিলিকে বাড়ি নিয়ে এল রবি। জলের গ্লাস মিলিকে দিতেই মিলি চিৎকার করে উঠল, ঘুঙুরটা নিয়ে যাও। গ্লাসে ঘুঙুর কেন? কোন খাবার মুখে তুলতে পারছে না, মিলি সবখানে মার ঘুঙুরকে দেখতে পাচ্ছে। রবি বুঝতে পারছে মিলি তার কাজের শাস্তি পাচ্ছে। রবি ওর মার ফটোর সামনে ঘুঙুরটা রেখে দিয়ে বলল, মিলিকে আর শাস্তি দিও না মা। তুমি আমার ঘরে জন্ম নিয়ে এসো মা। মাতৃত্বের বন্ধনে এখনও বাধা পড়ে নি মিলি।তাই ও জানে না মা কি,সন্তান কি। সন্তান কতটা দুঃখ পায় মার কষ্টে। সেটা ও বুঝবে যেদিন ও মা হবে। তোমাকে ছেড়ে আর কোনদিন কোথায় যাব না আমি। যতই কাজ থাকুক ।
মিলি ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।
শাশুড়ির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মিলি বলল, মা আমাকে মাতৃত্বের বন্ধনে তুমি বাঁধো, আমার কোলে তুমি এসো। সন্তান সুখ তুমিই আমকে দিতে পার। আমাকে মাতৃত্বের সুখ দাও মা।
এই ঘটনার একমাস পর মিলি জানতে পারল ও মা হতে চলেছে। রাতে ঘুমের মধ্যে মাতৃ সুখের স্বপ্নতে মিলি দেখল ওর শাশুড়ি মা হাসি হাসি মুখে ছোট্ট দুটো ঘুঙুর নিয়ে ওর ঘরের দিকে আসছে।
সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment