ঘর ছাড়া বাউল
-পারমিতা চ্যাটার্জী
সেদিন খুব বৃষ্টি পড়েছিল,
শ্রাবণের ঘন আকাশ,
মেঘে থমথম করছে..
মন চাইছিল জানো?
তোমার কাছে যেতে,
কিন্তু- একটা কিন্তু ভাব থেকে
গিয়েছিল মনের কোণে,
আমি তো জানিনা–
তোমার মনে আমার জন্য কি আছে?
আমি তো এক গান পাগল কবিতা পাগল
ছন্নছাড়া ছেলে–
তবুতো প্রাণে ভালেবাসা আছে
আষাঢ়ের নিঝুম সন্ধ্যায়
ভাঙা বাড়ীর গাড়ী বারন্দাটার তলায় তুমি বৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলে– তোমার গোলাপি ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বৃথা চেষ্টা করছিলে বৃষ্টি থেকে বাঁচবার। তোমার সমস্ত শরীর বেয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।
আমি শিল্পী নই,তবু মনে হচ্ছিল হাতে একটা রঙ তুলি আর সাদা ক্যানভাস থাকলে তোমার এই অপরূপ বৃষ্টিস্নাত ছবিটা ফুটিয়ে তুলতাম। কিন্তু আমার মন ক্যানভাসে সে ছবিটা তোমার ছবিটা চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে থাকল, তুমি জানতে পারলেনা।
ঠিক সময় তুমি চলে গেলে আর একটা ঠিক এরকম ভরা শ্রাবণে স্বামীর ঘরে ঘর করতে, সত্যি তো আমার মতন এই ঘরছাড়া বাউলকে কেউ পাত্র হিসাবে ভাবতে পারে?
তাই আমি কোনদিন যাইনি তোমার কাছে ভালোবাসার আবেদন নিয়ে। না পাওয়ার দুঃখ সইতে পারব কিন্তু প্রত্যাখানের বেদনা সইতে পারবনা। তাই নিজেকে আড়ালেই রেখেছিলাম। হয়তো চিরকালই আড়ালেই রাখতাম, সামনে আসতাম না।
কিন্তু জানো তোমার বিয়ের ঠিক একমাসের মাথায়
আমাদের পাড়ার বাবলিটা, তুমি হয়তো চেনোনা। সে এসে আমায় খবর দিল-
দাদা সর্বনাশ হয়ে গেছে!
আমি বললাম কি হয়েছে রে বল?
আমাদের তিন্নি..অনেকদিন পর তোমার নাম শুনে বুকের রক্তটা চলকে উঠল–
তবুও বললম- হ্যাঁ তিন্নির কি হয়েছে?
সে বলল- ও আর স্বামী নিকোপার্কে গিয়েছিল
ওখানে কয়েকজন গুণ্ডা তুলে নিয়ে ওকে,
আমি হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললাম– থাক আর বলতে হবেনা। তিন্নি এখন কোন হসপিটালে আছে? বাইপাসের ধারে, ওর শরীর দিয়ে প্রচুর রক্ত বেড়িয়ে গেছে। এখনি ওকে রক্ত দিতে হবে না হলে বাঁচানো যাবেনা। আমার মনে এক এমুহূর্ত তোমার মুখটা ভেসে উঠল। তারপর সার্টটা গলিয়ে নিয়ে বাবলুকে বললাম চল।
তোমাদের বাড়ী গিয়ে তোমার মাকে তুলে নিলাম
অসহায় মহিলার আর্তনাদ কন্না অনেকদিন আগের এক ঘটনা মনে পরিয়ে দিচ্ছিল। আমার দিদিও কলেজ থেকে ফেরার পথে এরকম একদল ঘাতকের হাতে পরে প্রাণ হারিয়েছিল। মায়ের সেই কান্না এখনও আমার কানে বেজে খানখান হয়ে ভেঙে ঝরে পড়ে। দিদিকে আমরা চিকিৎসা করানোর কোন সুযোগ পাইনি। তার আগেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেছিল।
আজ আমি তিন্নিকে কিছুতেই মরতে দেবোনা। ওকে বাঁচাতেই হবে।
ক দিন আগে এখানে রক্তদানের ক্যাম্প হয়েছিল আমি রক্ত দিয়েছিলাম। ব্লাডগ্রুপটা তাই জানাছিল- ও পসিটিভ।
যাবার পথে মাসীমাকে একটা কথাই শুধু জানতে চাইলাম ওর ব্লাড গ্রুপটা কি? উনি বললেন- ও পসিটিভ.. কি আশ্চর্য ভাবে মিলে গেল।
আমি মনে মনে ভাবলাম কত তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছানো যায়।
ওখানে পৌঁছে দেখলাম, তোমার বাবা কপালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছেন।তোমার মাকে দেখে অসহায় প্রশ্ন করলেন- তুমি কি করে এলে?
তোমার মা আমাদের দেখিয়ে দিলেন- তোমার মা কাতর হয়ে বললেন শ্বশুরবাড়ী থেকে কেউ আসেনি? না দেখতেই তো পাচ্ছ..
জামাই কোথায়? সে ও চলে গেছে তার বাবা মায়ের সাথে — ধর্ষিতা মেয়ের কোনো দায় ওরা নেবেনা। এখন ওসব কথা থাক এখন আমার মেয়েকে বাঁচাতে যে রক্তের প্রয়োজন ও পসিটিভ..
আমায় নিয়ে চলুন কাকু কোথায় রক্ত দিতে হবে?
তুমি? তেমার ব্লাড..
– ও পসিটিভ–
চল বাবা চল কি উপকার যে করলে-আমি মনে মনে ভাবলাম আমি কারও উপকার করিনি, যা করেছি আমার ভালোবাসার জন্য করেছি।
দু তিন দিনের মাথায় তুমি বাড়ী এলে- আমি আর যাইনি তোমার কাছে। দলে দলে লোক এসে তোমায় সান্ত্বনা বাক্য আর সহানুভূতিতে তোমরা অস্থির হয়ে উঠছিলে। আর তুমি? যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলে এক সত্ত্বাহীন অস্তিত্বে পরিণত হয়েছিলে। সাহস করে কাকুকে গিয়ে বললাম এত সহানুভূতিতে তো আরও অসুস্থ হয়ে পরছে। ওকে একজন সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার। ভালোই ছিলে ওষুধপাতি খেয়ে কিন্তু যেদিন তোমার শ্বশুরঘর থেকে তোমার কাছ থেকে ডিভোর্স নিতে এলো, সেদিন তুমি একদম ভেঙে পরলে। আমায় বললে- একদিন অসহায় চোখে চেয়ে আমায় বাঁচালেন কেন? এতো অপমানের চেয়ে তো মৃত্যুও ভালো ছিল।
আমি এই প্রথম তোমার এলোমেলো মাথাটা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি তো আছি অত চিন্তা করেনা। তুমি আমার হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কেঁদে বললে আমায় কেনদিন ঘেন্না করবে না তো? ঘেন্না তোমায় কেন করব? তুমি মাথা উচু করে বাঁচার মতন করে বাঁচবে। ঘেন্না তো নিজেদের ওপর হয়, এই অসামাজিক সমাজ ব্যবস্থায় একটা মেয়ের লজ্জা রক্ষা করতে পারলাম না। এর আগেও পারিনি এবারও পারলাম না।
তোমরা বল তো মেয়েটার কি দোষ? ওর বর ওকে বেড়াতে নিয়ে,গেছে সেখানে এই ঘটনা ঘটেছে ওর চোখের সামনে। অথচ বাধা দেবার চেষ্টা করেনি কেন? তাতে ওর প্রণটা শুধু যেত নাকি? আরে বাবা আড়ালে দাঁড়িয়ে একটা পুলিশ কল তো করতে পারতিস? তা নয় মেয়েটাকে ওভাবে ফেলে রেখে পালিয়ে চলে এলো- এ কেমন স্বামী?
আমি তখন অসীম সাহসে ভর করে বলেই ফেললাম যে আপনাদের কোনো অমত না থাকলে আমি ওর হাত ধরতে চাই। তুমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বললে আমি মরতে চাই কারুর দয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইনা।
এই প্রথম তোমার কাছে এসে বললাম- যদি বলি ভালোবাসা- বিশ্বাস করবে?
আজ থেকে পাঁচবছর আগে থেকেই তেমায় ভালোবেসে গেছি শুধু। বিনিময়ে কিছু চাইনি কিন্তু আজ আমি একটা ভালো চাকরি পেয়েছি মানে এবার আর আমি সেই ঘরছড়া বাউল নই, দেখে চিনতে পারেনা?
সবই কি বলতে হবে? কিছুুই কি বুঝে নেওয়া যায়না?
হ্যাঁ যা বোঝার বুঝেছি।
– তুমি বললে এমন মানুষ আজও আছে?
– আমি বললাম, সবই কি আর অন্ধকার থাকে! কোথাও কোথাও আলো নিশ্চয়ই জ্বলে- সেই আলোর রেখাটুকু ধরেই তো পথটা পার হই আমরা।।
ঘর ছাড়া বাউল ভালো লাগলো