অনুশোচনা
– রাখী চক্রবর্তী
না..ভুলিনি, পুরানো সেই দিনের কথা। এখনও ক্ষতটা দগদগ হয়ে আছে। অতীত আমাদের পিছু কিছুতেই ছাড়ে না। যতই ভোলার চেষ্টা করি না কেন।
তখন আমি পঁচিশ বছরের যুবক। রাস্তার মোড়ে দিনরাত আড্ডা মারতাম ক্লাবের ছেলেদের সাথে। তাই মেয়েদের মায়েদের কাছে আমরা ছিলাম লম্পট। অবশ্য কেউ যদি বিপদে পড়ত তখন আমরাই হয়ে যেতাম ভালো ছেলে।
যাই হোক তখন আমার সেই দিনগুলোতে একটাই কাজ ছিল কলেজ যাওয়ার পথে কলেজ থেকে ফেরার পথে চম্পাকে দু’ চোখ ভরে দেখা। মানে চম্পা ছিল আমার বাঁচার খোরাক। আমার পারিবারিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল তখন। তুলনায় চম্পা বেশ বড় ঘরের মেয়ে ছিল। রূপের কথা কি বলব, চম্পা ছিল ডানা কাটা পরী।
আমরা সব নাকি লম্পট গোছের ছেলে চম্পার দাদা বলত।
একদিন চম্পাকে ডেকে বললাম ,”তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি আমি। আর কতটা ভালবাসি সেটা না হয় বুঝে নাও। একটা কাজ কর্ম জুটিয়ে নেব। ঠিক সংসার চালিয়ে নেব আমি দেখে নিও।”
আমার সব কথা শুনে চম্পা সপাটে এক থাপ্পর মারল আমার গালে। সেদিন বুঝেছিলাম লম্পট ছেলেদের ভালবাসতে নেই, কারোর ভালবাসা পেতেও নেই।
আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না বলে, চম্পা বলল, হাভাতে ঘরের ছেলেদের ও পাত্তা দেয় না।
কিন্তু মন মানে না সে তো সব কিছু ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
দু’দিন মন মরা হয়ে বাড়িতেই ছিলাম।তারপর ভাবতে থাকলাম চম্পার দেওয়া থাপ্পরের প্রতিশোধ নিতে হবে।
যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। চম্পাকে পাত্র দেখতে আসছে এই খবরটা পাওয়া মাত্রই মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
“চম্পার স্বভাব চরিত্র ভালো না। অনেক ছেলেকে ও ঠকিয়েছে, “এই বলে ফেরত পাঠাতাম আগত অতিথিদের। মনের জ্বালা অনেকটা মিটল।”
এইভাবে চলতে থাকল চম্পার বিয়ের ভাঙচি। মাস যায় দিন যায় এক এক করে, আমি কিন্তু থামেনি। হয়তো চম্পা এখন বুঝতে পেরেছে অতি দম্ভ করলে কি পরিণতি হয়।
এরপর আমি আমার মামার বাড়ি চলে এলাম মুম্বাইতে বিধাতার বোধ হয় আমার ওপর দয়া হয়েছিল। হঠাৎই মামা ব্যবসার ভার আমার হাতে তুলে দিল। দিন যায়, বছর যায় হাজার পতি থেকে লাখ পতি হলাম তবুও কারোর পতি হতে পারলাম না।
এরপর মামা দেখাশুনো করে আমার বিয়ে দিল সুন্দরী রমণী নীলার সাথে। এই তো ভালো সুযোগ চম্পাকে মোক্ষম জবাব দেওয়ার। না, আর দেরি না।
নীলাকে নিয়ে ফ্লাইটে করে কোলকাতায় এলাম। কিন্তু তিনদিন হয়ে গেল চম্পার পাত্তা নেই তো। বাড়ি তো ওদের ঠিক আছে। তবে শুনলাম চম্পার মা বাবা আর বেঁচে নেই। তিন বছর পর আমি কোলকাতায় এলাম।তাই কোন খবর পাইনি। সব বন্ধুরা যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। যাই হোক চম্পাকে যদি নীলার রূপ দেখাতে পারতাম তবেই শান্তি পেতাম। কিন্তু..
চম্পা..চম্পা ওইতো কেমন নির্জীব দেখাচ্ছে ওকে। কোথায় গেল ওর রূপের অহংকার।কি চেহারা হয়েছে ওর।
-চম্পা চিনতে পারছো আমাকে? আমি অমিত রায়
-কেমন আছো?
-সব পাত্রপক্ষরাই তোমার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলেছে… সামনা সামনি লড়তে পারতে, পেছন থেকে কাপুরুষরা লড়ে।
আমি আর কথা বাড়াইনি। চলে এলাম বাড়ি।
প্রায় কুড়ি বছর পর আবার এলাম কোলকাতায়। চম্পা এখন নিভন্তা যৌবনা।শুনলাম ওর দাদা বৌদিরা ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এক বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পেয়েছে চম্পা। এখন আমার ভাবতেই ঘেন্না করে যে আমি খুব কাছের মানুষের সর্বনাশ করেছি।
আমার একমাত্র মেয়ে ঝুমুর এখন কলেজে পড়ে। একটা লম্পট ছেলের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে ও। শুধু একটাই প্রার্থনা ভগবান আমার কুকর্মের ফল আমার সন্তানকে দিও না। শাস্তি যা দেওয়ার আমাকে দাও। আর দেখো কোন মেয়ে চম্পার মতো যেন শাস্তি না পায়।