গল্প- একটি চোরের কাহিনী

একটি চোরের কাহিনী
– শুভায়ন বসু

 

সকাল থেকে হুলুস্থুলু।চোর ধরা পড়েছে ভটচাজবাবুর বাড়িতে। কুয়োতলায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল ।চাকর পঞ্চাই প্রথম দেখেছিল। তারপর আর যায় কোথায়? ভটচাজবাবুর বাড়িকে বাড়ি না বলে, প্রাসাদ বলাই ভাল। তিনতলা অট্টালিকা, অসংখ্য ঘর। যেমন পেল্লায় বাড়ী,তেমনই জমকালো তার ভেতরটাও।চাকরবাকরও কম নয়, দারোয়ান খানদুয়েক, তাছাড়া ড্রাইভার, মালি, ম্যানেজার সব নিয়ে একটা এলাহি ব্যাপার। সেই বাড়িতে চুরি! দুই দারোয়ান তো একেবারে হামলে পড়েছে। সঙ্গে চাকর, মালি, ড্রাইভার। সবাই মিলে ঘিরে ধরে যা তা কান্ড! চোর বেচারা পালাবার পথ পায়নি। তারপরেই শুরু হয়েছে হাটুরে মার, এখনো চলছে। ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা হয়েছে হাড়জিরজিরে ভিখিরিপানা মানুষটাকে, খালি হাত জোড় করে বলছে, সে নাকি চুরি করেনি। কিন্তু কার কি?
ভটচাজবাবুর বিশাল ব্যবসা, প্রচুর টাকা। নিন্দুকেরা বলে তার নাকি সবই ব্ল্যাকমানি। তিনি দু’তিনজন ইনকাম ট্যাক্স লইয়ার আর চাটার্ড একাউন্টেন্ট পুষেছেন মোটা টাকা দিয়ে। তারাই ট্যাক্স ফাঁকি আর ব্যালেন্সশীটের ফিকিরগুলো দেখে। ভটচাজবাবু নিজে নেমে এসে অবশ্য বলেছিলেন,চোরটাকে ছেড়ে দিতে। তবে সে কথার টানে একটা গূঢ় অর্থ ছিল বোধহয়,যে বোঝার সেই বোঝে।
চোরটা ধরা পড়ে মার খাওয়ার সময়, রাগের বশে অবশ্য বেজায় গাল পাড়ছিল। ভটচাজবাবুর দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে, জ্বলন্ত চাওনি ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিএ,”তুই ধরবি চোর! শালা চোরাই সোনার দোকানে এত রমরমা না? তাই মুখে বড় বড় কথা! নিজের যত বেআইনি কারবার আর আমাকে বলিস চোর?” ভটচাজবাবু দ্রুত গেটের ভেতরে ঢুকে গটগট করে ভেতরে চলে গেলেন, গেট বন্ধ হয়ে গেল।
চোরটাকে এসে মেরে গেল বাজার করতে, অফিস করতে আসা কত মানুষজন। সবচেয়ে রোগা,সবচেয়ে দুর্বল এমনকি সবচেয়ে থুথ্থুরে বুড়োটারও চোর পেটানোর সময় হাতের জোর দেখে কে! এদিকে চোরটাও সমানে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হাত পা বাঁধা হলেও মুখটা একমাত্র খোলা। সে নাকি চুরি করেনি। কিন্তু পাবলিকের মারের ভয়ে সবাই তো এমন বলে,সেসব কথা কেউ বিশ্বাস করে নাকি? চুরির মাল অবশ্য বাজেয়াপ্ত হয়নি কিছুই, কোথায় লুকিয়েছে দু’ চার ঘা দিলেই বেরিয়ে আসবে। তার মধ্যে অবশ্য ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হরেন সান্যালকে কথা শুনতে হল চোরটার কাছে। “কত টাকার কারেন্ট জালি করে চুরি করেছিস রে, তোর বেআইনি তিনঘরার কারখানায়? মজুরদের তো ন্যায্য টাকা কিছুই দিস না, বারোঘন্টা অমানুষিক খাটাস। তুই আবার এসেছিস আমাকে মারতে?” হরেন বাবু পালিয়ে বাঁচেন, ভিড়ে গা ঢাকা দেন।পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সুদখোর মানিক দাস। তাক করে দু’ চারটে মোক্ষম মার তিনিও মেরেছিলেন। চোরটা কঁকিয়ে উঠে বলে “চোরকে মারতে এসেছে, শালা সুদখোর! হাজার টাকার এক বছরের সুদও হাজার টাকা? শালা।” আবার দু’চারটে মার পড়ে, তবে এবার জোরটা একটু যেন কম। চোরটা মানিককে ছেড়ে, রেগে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো ফিটফাট রবীন পাকড়াশির চোখে চোখ রেখে বলে “জাল ওষুধের কারবারটা কেমন চলছে রে রবীন? আর জাল বেবিফুডটাও চালিয়ে যাচ্ছিস ভালোই, নারে?” রবীন আর মানিকবাবু একটু সরে গেলেন আড়ালে। দূর থেকে দেখে নিলেন চোরটাকে। চেনা লোক নয়তো, এত কথা জানলো কি করে?
এসি গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে পাশে এসে থামল। কাঁচ নামিয়ে মুখ বার করলেন পাড়ার সম্মানীয় নেতা অতুল লাহিড়ী। “কিরে, এখানে কি চলছে এসব?” সবাই নালিশ জানিয়ে গেল তার কাছে, পাড়ায় চোরের উপদ্রব বেড়েছে। তাই চোর ধরে পেটানো চলছে। “ও, ভালো করেছিস। মার শালাকে। কেলিয়ে বিন্দাবন দেখিয়ে দে।” চোরটা মুখ তুলে দেখে। কোথা থেকে এত গলায় জোর পায় কে জানে? আসলে ওর তো আর কিছু হারানোর নেই, হেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকেই গেছে। চেঁচিয়ে বলে “এই তো এসে গেছ বাবা দাপুটে নেতা। শালা, ভালোমানুষী দেখাচ্ছ? কটা বেনামে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছ, কটা জমি দখল করেছ, কোথায় কোথায় তোলাবাজির টাকা লাগিয়েছ জানি না ভাবছ? শালা ঘুষখোর।” অতুলবাবুর গাড়ির কাঁচটা একটু উঠে যায় ,মুখটা বার করে হাজিমস্তানকে বলেন, “এই, এটা কে রে? বিরোধী দলের মনে হচ্ছে। শালা মাওবাদী নয়তো?” চোরটার গলা এবার সপ্তমে “হ্যাঁ ,তা তো বটেই। তুমি মহান নেতা আর আমি চোর, তাই না? তা বাবা,বল দেখি ,অনি-বুড়ো আর স্বপ্নার লাশগুলো কি করেছ? স্বপ্নার সঙ্গে কি করেছিলে বলে দেব নাকি? নিমেষে কাঁচটা পুরো উঠে যায়। নেতার গাড়ি হাওয়া হয়ে যায়।
পাড়ার সব ছুটকো মস্তানদের রাগ এবার গিয়ে পড়ে এবার চোরটার উপর, যত মুখ নয় তত বড় কথা! অতুলদার বেইজ্জতি! বেধড়ক মার শুরু হয়। চোরটা আরো ঝিমিয়ে পড়ে। ওদিকে মন্ত্রীর নীলবাতি লাগানো গাড়ি ভীড়ে আটকে যায়। চুপিচুপি কাকে ডেকে মন্ত্রী কি সব জানতে চান। চোরটা গজরাতে থাকে “ওই এলেন মন্ত্রী সাহেব। সমবায় ব্যাঙ্ক দেউলিয়াকান্ডের কান্ডারী। কত সোনা জমিয়েছ বাবা বাড়িতে? কত টাকার হাওয়ালায় ফেললে আজ সুইস ব্যাঙ্কে? এই না হলে মন্ত্রী!” মন্ত্রীর গাড়ি কিছু না শুনতে পাবার ভান করে চলে যায়।
মারধোর চলছেই, বিরাম নেই। পাশের পাড়ার উকিল প্রশান্তবাবু অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সেজেগুজে চোর পেটাতে এসেছিলেন। চোরটার কথাবার্তা শুনে তার মতিগতি ভাল ঠেকল না। তিনি চুপচাপ চলে যেতেই চেয়েছিলেন। চোরটার চোখে পড়ে গেল। আর যায় কোথায়?গোঙাতে গোঙাতেই অস্ফুটে বলে, “আরে পালাচ্ছেন কোথায়? আসুন,আসুন,মারবেন না আমাকে?” প্রশান্তবাবু দ্রুত একটা চলন্ত বাসে উঠে হাওয়া হয়ে গেলেন। এদিকে ভীড় বাড়তে শুরু করেছে, কোথাকার কোন চোর এসে বুলি কপচাচ্ছে আর সবার সব গোপন কথার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিচ্ছে। ওদিকে টোটো করে মাইকে প্রচার শুরু হয়- ‘সবাই আসুন, মণ্ডলপাড়ায় চোর ধরা পড়েছে। অগণতান্ত্রিক, অরাজনৈতিক, অসামাজিক এবং অধার্মিক এক বিশুদ্ধ চোর। গণধোলাই দিয়ে হাত পাকিয়ে যান।
চোরটা নেতিয়ে পড়েছে। তাই দেখে লোকজনের জমায়েতের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। চোরটা কে, কোথা থেকে এল? এত কথা জানলোই বা কি করে? নেতা-মন্ত্রীর বাপান্ত করছে। গণ্যমান্য লোককে খিস্তি করছে।যার বাড়ি চুরি হয়েছে সে তো নিজেই বেপাত্তা। পাড়ার যত হোমরাচোমরা মুখ লুকোতে ব্যস্ত, কেউ পালিয়ে পথ পাচ্ছে না, সবার গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। চোরটা কি ঠিক কথা বলছে? সবার সব অপকর্ম ও জানলোই বা কি করে? কেউ কেউ বলে উঠলো ঠিকই তো বলেছে। ওই নেতা অতুল লাহিড়ি, ওই ব্যাবসাদার সমীর ভটচাজ আর ওই মন্ত্রী সত্যব্রত সাধুখাঁ, ওদের তো সত্যিই অনেক ব্ল্যাকমানি, স্মাগলিং আর বেআইনি ব্যবসা আছে। গরীবের কত টাকা মেরেছে চিটফান্ডে। কানাঘুষো অনেকদিন ধরে শোনা যায়। কে যেন বলে উঠল, ও পাড়ার সুনীলবাবুরও তো ভুয়ো কোম্পানি আর কটা এনজিও খুলে সরকারি টাকা মেরে দিয়েছে। কে বলে ওঠে ওপাশের গলিতে একটা বেআইনি বাড়ি উঠছে। কার যেন মার্সিডিজ গাড়ি আছে ড্রাগের ব্যবসার টাকায়, কার জাল নোটের কারবার, কোন বালি মাফিয়া ডাম্পারপিছু পুলিশ আর পার্টিকে কত যেন মাসোহারা দেয়, কোন নামকরা ডাক্তারের নার্সিংহোমে কিডনি পাচার আর কন্যাভ্রুণ হত্যার মত ঘৃণ্য কাজ হয়। কে যেন চাকরি দেওয়ার নামে কত লোকের টাকা মেরেছে। কোন সরকারি বড়কর্তা দূষণ নিয়ন্ত্রণের গাড়ি নিয়ে এসে কত ঘুষ নিয়ে যায়। চারিদিকে ফিসফাস গুঞ্জন ওঠে। কোন গুন্ডার নামে কটা রেপ, নারীপাচার আর কটা মার্ডারের কেস চলছে, অথচ তাদের পুলিশ খুঁজেই পাচ্ছে না। সব ফাঁস হয়ে যায়। পলিটিক্সের নোংরামো,মন্দিরের নামে ধর্মের ব্যবসামাফিয়া আর তোলাবাজদের কীর্তিকলাপ, এইসব বেআইনি কাজকর্মের গল্প-আলোচনাই চললো মুখে মুখে।
গণধোলাইয়ের আসরের ভিড়টা পাতলা হতে শুরু করে, চোরটার দিকে আর কারো কোন নজর নেই। এদিকে চোরটার ততক্ষণে হয়ে এসেছে। রক্ত ঝরছে সারা শরীর থেকে। চোখ থেকে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখ থেকে লালা সিকনি সব মিশে ছেঁড়া গেঞ্জি ভিজে গেছে। অর্ধনগ্ন মানুষটার আর জ্ঞান নেই, মুখে আর কথাও নেই কোন। আর হয়তো কোন কথা ও কোনদিনই বলবে না, আর বললেই বা শুনছে কি কেউ? নাকি শুনছে??

Loading

Leave A Comment