গল্প – শাশুড়িষষ্ঠী

শাশুড়িষষ্ঠী
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)

 

সুসজ্জিত আসনে বসে আছেন রিমঝিম সেন। জামাই তাকে পাখায় বাতাস করছেন। যদিও বৈদুতিক পাখা আছে,তবুও লাল জড়ির লেস লাগানো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে নীলাভর খুব ভালো লাগছে। রিমঝিমের চোখে আবেগাশ্রু। যা যা তিনি ভালোবাসেন সবকিছু আজ রান্না করা হয়েছে। সুসজ্জিত থালার চারদিকে অনেক বাটিতে অনেক উপাচার সাজানো। রিমঝিম সেনের মেয়ে সিঞ্জিনি আজ খুব ব্যস্ত। সিঞ্জিনির বয়স যখন মাত্র দুই বছর ,তখন তাঁর বাবার ব্যবসায় হঠাৎ করে অবনতি হতে শুরু করে , একসময় ব্যবসায় তাদের যথেষ্ট রমরমা ছিল। খুবই স্বচ্ছল ছিল তাদের অবস্থা। হঠাৎ করে ব্যবসা র অবস্থা খারাপ হয়ে ,আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন টা মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেন নি সিঞ্জিনির বাবা। মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন তিনি। সিঞ্জিনির যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন তাঁর মৃত্যু হয়। শুরু হয় রিমঝিমের জীবনসংগ্রাম। সেলাই করা,এবং গৃহশিক্ষতা করা শুরু করেন তিনি। তাঁর নিজের জন্য কোনো সময় ই ছিল না। একমাত্র লক্ষ ছিল মেয়েকে ভালভাবে মানুষ করে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। নিজের সমস্ত গয়না বিক্রি করে দিয়ে,ব্যবসাটাকে ধীরে ধীরে আবার দাঁড় করান। ভোর চারটের সময় উঠে তিনি রান্না করতেন, তারপর বৃদ্ধা শাশুরীর পরিচর্চা করতেন,সংসারের খুঁটিনাটি কাজ সেরে সকাল সাতটায় গৃহশিক্ষতা করা শুরু করতেন, মাঝে ছোট্ট মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসা,নিয়ে আসা। তারপর সেলাইয়ের কাজ। কখনও কখনও তাকে ব্যবসার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলতে বড়বাজার যেতে হ‘ত। কোনো কোনো দিন ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়াও করতে পারতেন না। অথচ মেয়ে বা শাশুড়ি যা খেতে ভালবাসে তার খাওয়ানর চেষ্টা করতেন। সিঞ্জিনির জন্মদিনের আগে আরো বেশী করে সেলাই এর কাজ নিতেন,যাতে জন্মদিনের দিন মেয়ের প্রিয় সব খাবার দিতে পারেন। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো, পড়ার খরচ আরো বাড়লো। মাধ্যমিকের পর মেয়ে যখন বিজ্ঞান শাখায় পড়তে চাইলো,অনেকেই বললো,“ অত খরচ তুমি সামলাতে পারবে না”। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছা তিনি পূরণ করলেন। ব্যবসার অবস্থাও আবার ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠলো,সিঞ্জিনি ও স্কুলে চাকরি পেল। কিন্তু জীবনের যে সময়টা তিনি একটু আরাম আনন্দ করতে পারতেন, তার অনেকটাই তিনি সংসারকে দিয়ে দিলেন। সিঞ্জিনির জীবনে যখন নীলাভ এল,তাকে সিঞ্জিনি সব কিছু জানালো। প্রথম জামাইষষ্ঠী টা শাশুড়ির নিমন্ত্রণে নীলাভ গিয়েছিলেন,খুবই আদর যত্ন পেয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বার নীলাভ সিঞ্জিনিকে বলেন,সারা জীবন তো উনি দিয়েই গেলেন, এবার আমরা ষষ্ঠীর দিন ওনাকে ওনার প্রিয় সব খাবার নিজে পরিবেশন করে খাওয়াবো। রিমঝিম বেশ আপত্তি করেছিলেন, নীলাভ বলেন,“আমাকে যদি সত্যিই ছেলে ভাবো,আমার এই আব্দারটা রাখতেই হবে”। সকাল বেলায় শাশুড়ির মঙ্গল কামনায় পুজো করা হয়েছে। স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে খুব সুন্দর লাগছে আজ রিমঝিমকে। মেয়ে তাঁর হাতে বেঁধে দিয়েছে তেল হলুদ মাখানো মাঙ্গলিক সুতো। আর তাঁকে প্রণাম করলো মেয়ে জামাই । সবুজ দূর্বা র আঁটি আর ধান দিয়ে তাঁদের আশীর্বাদ করলেন রিমঝিম। তিনজনেই কপালে দইয়ের টিপ পড়লেন। অনেক রকম ফলের গন্ধে ম ম করছে বাড়ি। হ্যাঁ খাবারের প্রথম গ্রাস টা মুখে তুলে দিলেন নীলাভ । তারপর মেয়ে।
ও হ্যাঁ আনন্দের কথা হ‘ল নীলাভর বোন ও ভগ্নীপতি একই ভাবে আজ ওদের বাড়িতে নীলাভ র মা নীনার শাশুড়ি ষষ্ঠী করছেন। আনন্দের এই অনুষ্ঠান যেন প্রতীকী হয়ে রইলো,মায়েরা মেয়েরা সারাজীবন অনেক অনেক ত্যাগ করেন কিন্তু তাদের হয়তো পরিবেশন করে কেউ খাওয়ায় না। তাঁদের প্রিয় খাবার অনেক ক্ষেত্রেই তাদের খাওয়ার সময় থাকে না। আর নীলাভ সেদিন তাঁর শাশুড়ি মা যা যা ভালবাসে তা উপহার হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন। পুরো বাড়ি আনন্দে আর মঙ্গল ধ্বনি তে মুখর হয়ে উঠেছিল।
রিমঝিম ভাবছেন তাঁর সন্তান সত্যিই সুসন্তান হয়েছে এবং সঠিক জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছে

Loading

Leave A Comment