Site icon আলাপী মন

গল্প- সংযোগ

সংযোগ
-বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

 

বি.এ. পাস করার পরে প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে আমার দিনগুলি কাটছিল। কোনো মতে একটা চাকরি যোগাড় করতেই হবে নইলে যে আমার ভালোবাসা হাতছাড়া হয়ে যাবে। সব সময় এই ভাবনা আমার মনে কাজ করত, আমার বন্ধুরা সকলেই ব্যপারটা জানত তাই তো মাঝে মধ্যে ব্যঙ্গের সুরে সত্যি কথাগুলি বলে দিতো। “তোর মতো ছেলের চাকরি কোনদিনও হবে না, কানে কাটা বি.এ.পাস তাঁর উপরে ইংরেজি বলতে গেলে দাঁত ভেঙ্গে যায়।” কথাগুলি শুনে আমার কোনদিন কষ্ট লাগেনি কারন কথাগুলি বাস্তব সত্য তবে আমি মনেপ্রাণে চেষ্ট করতাম আর আমার পরমপিতা ভগবানকে ডাকতাম, যদি কোনো সঠিক পথ দেখান। আমরা ছয় বন্ধু গ্রাজুয়েট হবার পরে, গ্রামের আমবাগানে মাদুর পেতে রাতদিন চাকরির পড়াশুনা করতাম। লেখাপড়ায় আমি সবথেকে কমা ছিলাম তাই সমস্ত ঝুট ঝামেলা ফাইফরমাস নির্দ্বিধায় করে দিতাম, তবুও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের হাত থেকে নিস্তার পেতাম না ।

“বিভূতি তোর পড়াশুনা করে লাভ নেই মাঠে মুণিস দে গে যা” হ্যাঁ আমার বন্ধুর কথা শুনে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। আমি বললাম কি করলে তোরা আমার পিছনে লাগা ছাড়বি?
ওদের মধ্যে একজন বলল “তুই যে কোনো একটা বা দু’টো প্রশ্ন আমাদের ধরবি, আর আমরা যদি না পারি তা হলে তোর পিছনে আর লাগব না। কোনো কিছু না ভেবেই ‘হ্যাঁঁ’ বলে দিলাম। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেলো, কিছু্ই খুঁজে পাচ্ছি না, হঠাৎ একদিন আমার বাবা প্রশ্ন করলেন খোকা আমাদের চার নম্বর প্রধান মন্ত্রীর নাম কি?
আমি তো হাঁ করে রইলাম এই চার নম্বর তার পরে পাঁচ নম্বর তার পরে ছয় নম্বর জিজ্ঞাসা করবে বাবাকে আমি ভালো করেই চিনি বিদঘুটে প্রশ্ন করাতে বাবা সিদ্ধহস্ত ….. কি মুশকিল ।
বাবা বললেন —- “খোকা এই রকম পড়াশুনায় চাকরি হবে না।”

মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে, সঙ্গে সঙ্গে বইপত্র ঘাঁটতে শুরু করলাম। এখনকার মতো, তখন তো আর গুগল ছিলো না যে জিজ্ঞাসা করে বলে দেবো। অবশেষে প্রধান মন্ত্রীর সিরিয়াল খুঁজে পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখস্ত করে ফেললাম কিন্তু যতবারই না দেখে বলতে যাই, সবগুলি আগে পরে হয়ে যায় অবশেষে একটা সুত্র বের করে মুখস্ত করে ফেলাম, আর ভাবলাম এই প্রশ্নটা যদি ওদের ধরি তা হলে কাজ হবে। যথারীতি একদিন প্রশ্নটা বন্ধুদের করে ফেললাম। আমাদের প্রধান মন্ত্রীর সিরিয়াল পরপর বলতে হবে কে পারবে?  সবাই বলল কিন্তু আগে পরে হয়ে গেলো কারোর উত্তরই ঠিক হলো না । সেই দিন থেকে ওরা আর আমার পিছনে লাগত না বরং আমার প্রতিটি কথার গুরূত্ব দিতো। এতে আমার মনটা সব সময় ফুরফুরে থাকত। এক দিন “ও” আমাকে বলল কি ব্যপার তুমি আজকাল বেশ চনমনে থাকো ব্যপারটা কি? আমি উত্তর দিতে পরিনি কারণ রাস্তা দিয়ে চলার পথে কথাটা বলে পালিয়ে গেলো পাছে কেউ দেখে ফেলে। আমিও আর তাগাদা করিনি পাছে ওর দুর্নাম রটে।

প্রায় এক বছর পর ষ্টেশন মাষ্টার পদের লেখা পরীক্ষায় আমরা তিন বন্ধু পাস করলাম, মৌখিক পরীক্ষা দিতে পাটনার মহেন্দ্রঘাটে গিয়ে উঠলাম। প্রথম বন্ধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পথে আমাকে বলে গেলো বিভূতি তোর চাকরি এখানেই হবে। কথাটা শুনে দুঃখও পেলাম আর আনন্দও পেলাম। দুঃখ পেলাম কারণ মৌখিক পরীক্ষা এখনো হলনা, ও কি করে বুঝল আমার চাকরি হবে? দ্বিতীয় বন্ধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে বেরোবার পথে আমাকে আস্তে করে বলল তুই-ই পারবি । অবশেষে সেই চরম মুহূর্ত এসে গেলো মৌখিক হলের মধ্যে এক পা যেই দিয়েছি ভিতর থেকে ইংরেজিতে প্রশ্ন ভেসে এলো আমার কানে, ভারতের প্রধান মন্ত্রীর সিরিয়াল বলুন? আমি এক পা ভিতরে এক পা বাইরে দিয়ে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম JGLG IMCI RVCP বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল সকলে। পরের প্রশ্ন ভেসে এলো ভিতরে আসুন ও বসুন। ভিতরে গিয়ে বসতেই পরবর্তী প্রশ্ন, আমার উত্তরটা বিস্তারিত ভাবে বলতে বলা হলো। আমি বললাম উত্তরটা হলো আমাদের প্রধামন্ত্রীদের নামের প্রথম অক্ষর স্যার। মুহূর্তেই সকলে হো হো করে হেসে উঠলেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন পি.ভি. নরসিংহ রাও তখন শেষ প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। আমাদের তিনজনের মধ্যেই কেবল আমারই চাকরিটা হয়েছিলো এখনও ওই চাকরিটাই করছি। ওঃ হো “ওর” কথা বলা হলো না, হ্যাঁ ও ধৈর্য্য ধরতে না পেরে অন্য একজনের হয়ে সুখে সংসার করছে।

Exit mobile version