মন নিয়ে খেলা
– রাখী চক্রবর্তী
হরি ওঁ..হরি ওঁ
গুরুদেব, আপনি এসেছেন। আপনার জন্য পথ চেয়ে বসে বসে আছি বাবা।
– কিসের এত উদ্বেগ মা। কি হয়েছে মা?
– গুরুদেব, আপনি তো অন্তর্যামী সবই জানেন। আমার একমাত্র পুত্র কি বাবা ডাক শুনতে পাবে না? আমি কি এমন পাপ করেছি যে নাতি নাতনিদের মুখ এখনও দেখতে পেলাম না।গুরুদেব, আমার বৌমা বড়ই বিচলিত ওকে আশ্বাস দিন বাবা..
– দেখো মা এই জগতে কোন কিছুর অভাব নেই তো। তাহলে এত উতলা হচ্ছো কেন।
কত শিশু অনাদরে বড় হচ্ছে তাদেরকে বুকে টেনে নাও মা। বঞ্চিত যে ওরা ভালবাসার থেকে ।
– না গুরুদেব তা হয় না। আমি আমার বংশের প্রদীপের মুখ দেখতে চাই।
– সব সন্তানই প্রদীপের শিখার মতো ঘর উজ্বলিত করে মা। আমার আমার করো না।আমি পাঁচ বছর আগে যা বলেছি এখনও তাই বলছি বৌমা সন্তান ধারণ করতে অক্ষম।
গুরুদেবের কথা শুনে বারবার নিরাশ হয়ে যান অমলাদেবী।
– চিন্তা করো না বৌমা, ডাক্তার বৈদ্য সব তো হল। আশার আলো কেউ দেখাতে পারল না।এখন ভগবানই ভরসা।
সব মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠুকছেন অমলাদেবী। একটাই প্রার্থনা বংশের প্রদীপের মুখ দেখতে যেন আমি স্বর্গে যেতে পারি।
অলখ নিরঞ্জন….অলখ নিরঞ্জন..
এত চিন্তা কেন করছিস
– বাবা আপনি অন্তর্যামী সবই তো জানেন।
– নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাস তাই তো?পাবি, পাবি সব পাবি।
হরি ওঁম..হরি ওঁম..হরি ওঁম..
যোগীবাবা আপনি অন্তর্যামী
-বৌমাকে নিয়ে এসো।
অমলাদেবী বৌমা সুচেতাকে নিয়ে বারান্দায় বসালেন
– দেখি মা তোমার হাতখানা
এই তো যোগ আছে সন্তানের। শুধু শুধু হাহুতাশ করো কেন মা?
সুচেতা বলল, আমি তো হাহুতাশ করি না বাবা। আমি জানি কোনদিন আমি মা হতে পারব না।
– নিশ্চয়ই মা হতে পারবে তুমি। শুধু একটা যজ্ঞ করতে লাগবে।
অমলাদেবী বললেন, হ্যাঁ যোগীবাবা যজ্ঞ করাবো। আপনি সব ব্যবস্থা করে দিন। কি কি লাগবে বলুন বাবা?
– শোন মা যজ্ঞ করতে যা উপাচার লাগবে তা তোমরা জোগাড় করতে পারবে না। মূল্য ধরে দিও আমাকে আমি সব উপাচার নিয়ে সামনের অমাবস্যাতে নিমতলা শ্মশানে যজ্ঞ করতে বসবো। খেয়াল রেখো মা, বৌমা শুধু যজ্ঞে সামিল হবে তোমরা কিন্তু কেউ যাবে না ওখানে। রাত বারোটা চল্লিশে অমাবস্যা লাগছে। তখনই যজ্ঞ শুরু করব ।
অমলাদেবী কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললেন ঠিক আছে বাবা তাই হবে।
অলখ নিরঞ্জন.. ভিক্ষাপাত্রতে কিছু দাও মা
সুচেতা চাল, আলু, একশো এক টাকা দিয়ে প্রণাম করল যোগীবাবাকে।
অমলাদেবী বললেন বাবা যজ্ঞ বাবদ কত দক্ষিণা দিতে হবে?
– মা জননী সব মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজার দিও মা। আমি আসি। অমাবস্যার দিন,মনে রেখো কিন্তু। ঠাকুমা হলে আরও নেব প্রণামী, হা হা হা..
জয় মা, জয় মা, মা কালী, মা দূর্গা আমার মনের কথা এতদিনে শুনলে মা।
সুচেতা আজকালকার যুগের মেয়ে। লেখাপড়াতেও মন্দ না। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে এম.এ. পাস করেছে। সুজয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে সুচেতার দশ বছর হল। পাঁচ বছরের প্রেম ভালবাসা তারপর বিয়ে।পনেরো বছর ধরে সুজয়কে চেনে সুচেতা। অসম্ভব ভালো মানুষ সুজয়। বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই সুচেতা জেনে গেছে ও আর কোন দিন মা হতে পারবে না। সুজয়ও জানে। কিন্তু শাশুড়ি মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
এসব সাধু, সন্ন্যাসী, তান্ত্রিকরা প্রায় সবাই ভণ্ড। কি করে বোঝাবেন ওনাকে! সবার বিশ্বাস নিয়ে খেলাই ওদের কাজ। সুচেতা কোন রাস্তা খুঁজে পারছে না। কি করে শাশুড়ি মাকে ভণ্ড লোকটার হাত থেকে বাঁচাবে এই চিন্তাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে সুচেতা।
সুজয় অফিস থেকে ফেরার পর অমলাদেবী যোগীবাবার সব কথা বললেন সুজয়কে।
সুজয় বলল, পাগল নাকি অত রাতে সুচেতাকে একা একা শ্মশানে কিছুতেই আমি যেতে দেব না। আর পঞ্চাশ হাজার টাকা তো একদম না। আমার সন্তানের দরকার নেই।দত্তক নেব ঠিক করেছি।
অমলাদেবী ফোঁস করে উঠলেন অজাত কুজাতের সন্তানের ঠাকুমা আমি হতে চাই না।
অমাবস্যার ঠিক আগের দিন অলখ নিরঞ্জন.. ধ্বনি দিয়ে যোগীবাবা অমলাদেবীর বাড়ি এলেন।
এবার আর সুচেতাকে ডাকলেন না।অমলাদেবীর সাথে চুপিচুপি কিছু কথা বলে দান নিয়ে চলে গেলেন যোগীবাবা।
পরের দিন সকাল সকাল অমলাদেবী ঘুম থেকে উঠে সুজয়কে বলল, তুই আজ অফিস যাস না বাবা।
সুজয় বলল, চারদিনের জন্য বিহার যাচ্ছি, যেতেই হবে।
আজ বৌমার নামে যজ্ঞ হবে আর তুই থাকবি না?
আমাদের তো যাওয়া বারণ। সুচেতাই তো একা যাবে। তুমি ও তো যেতে পারবে না।
– না, ধর চুপিচুপি আমরা যদি যাই।
– তাহলে তো তুমি আর ঠাকুমা হতে পারবে না। যাইহোক, পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক রেখে দিলাম। যোগীবাবাকে দিয়ে দিও।
রাত বারোটা নিস্তব্ধ নির্জন গঙ্গার ঘাটে সুচেতা একা দাঁড়িয়ে আছে।
অলখ নিরঞ্জন..অলখ নিরঞ্জন ধ্বনি শুনে চমকে গেল সুচেতা। আসলে সাত জন একসঙ্গে বলে উঠল তো তাই সুচেতা চমকে গেছিল।
যজ্ঞ শুরু হল যথা সময়ে আসলে ভদ্র লোকের কথা তো। কথার নড়চড় এনারা করেন না।
যজ্ঞের আগুনের লেলিহান শিখাতে একটু একটু করে পুড়ছে, সুচেতার মাতৃত্বের সুখ। হঠাৎ পেছন থেকে তিন চার জন্য সুচেতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই পুলিশের বাঁশি বাজল।
যোগীবাবা বলল, ঘোর অন্যায় মহা পাপ..
সুচেতা বলল, কৃষ্ণ ঠাকুর বাঁশি বাজাল যোগীবাবার দল। চলো বৈকুণ্ঠপুর।
যোগীবাবার চোখ লাল রক্ত জবার মতো।পুলিশ ভণ্ডগুলোকে পুলিশ ভ্যানে তুলল।সুজয় আর সুচেতা আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
অমলাদেবী মা কালীর আরাধনা করে যাচ্ছেন রাতভর। কি ঘটনা ঘটলো শ্মশান ঘাটে তার খবর অনেক পরে তিনি পেলেন।
গ্রামে গঞ্জে এমনকি শহরেও ভণ্ড তান্ত্রিকের নোংরা খেলায় মেতে উঠে ঘর বাড়ি ইজ্জত সব খোয়াচ্ছে ঘরের বৌ, মা,জননীরা। সরকারি চাকরি পাওয়ার আসায় কত যুবক এই নোংরা খেলায় শিকার হচ্ছে। এসব বিশ্বাস এরই ফল। কুসংস্কারের ফল।অতিরিক্ত ঠাকুরের ওপর বিশ্বাস করলেও এক এক সময় আমরা ভাবি ঠাকুর নিজে না এসে ওনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের সাহায্য করার জন্য। এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ডগুলো খেলা করে আমাদের মন নিয়ে।
আমাদের মতো নিরীহ মানুষগুলোর মন নিয়ে খেলেই চলেছে ভণ্ড সাধুগুলো। এদের একটাই শাস্তি বিচুটি পাতা চোখে দিয়ে অন্ধ করে দেওয়া। যাতে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা সাধু তান্ত্রিকগুলো ভয়ে পেয়ে আর কোন নিরীহ মানুষের মন নিয়ে না খেলা করতে পারে।