মুখোশ
– রেহানা দেবনাথ
সমাজসেবী রথীন্দ্রনাথ রাযের এলাকায় খুব সুনাম। সবাই বলে খুব ভালো মানুষ গরীব দুঃখীদের সাহায্য করে,বস্তি উন্নয়নের জন্য মিটিং মিছিল করেন। নারীনির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তার জন্য জনৈক রাজনৈতিক দল থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর হবার প্রস্তাবও পেয়েছেন।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ও আশেপাশের সবাই খুব খুশি। একমাত্র তার স্ত্রী সুমিত্রা ছাড়া!
সুমিত্রাই একমাত্ৰ জানে যে লোকটি কত ভয়ঙ্কর আর হিংস্র!তার ভালো মানুষির মুখোশের পিছনে কি কুৎসিত চেহারা লুকিয়ে আছে।
বিয়ের পর থেকেই বন্ধ দরজার ভিতরে যে হিংস্রতার শিকার সুমিত্রাকে হতে হতো তা অনেকের কল্পনার বাইরে! মাঝে মাঝে যেদিন ছাড় পেত সেদিন সুমিত্রাকে রাতে একা ঘরে রেখে বাইরে থেকে আটকে দিত।
এরকম ব্যবহারের উত্তর সুমিত্রা পেয়ে যেত সর্বক্ষণের ঝি মালতীর চোখের জল ও শারীরিক জড়তা দেখে।
মালতীকে সোজাসুজি না হলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু তার দু’চোখে আতঙ্কের ছবি ছাড়া মুখে কোনো উত্তর পায়নি।
মাঝে মাঝে বস্তির কিছু মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়! সুমিত্রার সন্দেহ এর পিছনেও তার স্বামীর হাত আছে।
সুমিত্রা ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তার কোথাও যাবার কেউ নেই। তাই এত বছর সব সহ্য করে এসেছে!
হঠাৎ একদিন ছোট দেওরের বিধবা স্ত্রী রাহী সকালে খুব চেঁচাতে থাকে আর বলতে থাকে যে রথীন্দ্রনাথ এর মুখোশ আমি টেনে খুলে দেব। আমার সর্বনাশ যে করেছে তাকে ছাড়বো না। কিছুক্ষণ পর পুলিশ নিয়ে আসে। ধর্ষণের কেসে রথীন্দ্রনাথকে পুলিশ নিয়ে গেলেও কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দেয় সাধারণ লোকেদের প্রতিবাদে। সবাই ছোটো বউকে ছি!ছি! করতে থাকে।
রথীন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে সবার সামনে ছোট বউয়ের হয়ে ক্ষমা চায় আর এও ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যে আমি চাইনি যে মাত্র দু’মাস আগে যে ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে তার স্ত্রী রাহী দুশচারিত্রা সেটা সবার সামনে আসুক। তাই কাল রাতে অন্য পুরুষকে তার ঘর থেকে বেরোতে দেখলে তাকে সাবধান করে দিই।
এলাকার সব লোক তখন ছোট বউকে বার করে দিতে চাইলো শুধুমাত্র সুমিত্রা তাকে সন্তানের মত আঁকড়ে ধরে বাঁচায় অনেক কষ্টে।
গভীর রাতে রথীন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকে সুমিত্রার সামনে এসে চেঁচিয়ে রাহীকে বলে আমাকে বদনাম করা এবার দেখ তোর কি অবস্থা করি। একটা রাতের জন্য এত কিছু এবার তোর প্রতিটি রাত আরো ভয়ানক বানাবো। কথাটা বলতে বলতেই আট দশ জন লোক ঢুকে রাহীর মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। সুমিত্রা আটকাতে গেলে মাথার উপর জোরে একটা চোট পেয়ে জ্ঞান হারায়।
সকালে যখন সুমিত্রার জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো একটা অন্ধকার ঘরে রয়েছে। রাহীর কথা ভাবতে থাকলো। তার দুরাবস্থার কথা ভেবে কাঁদতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে ঘরের দরজা খুলে রথীন্দ্রনাথ ঢুকে সুমিত্রাকে ধমক দিয়ে বলে কালকের ঘটনা নিয়ে যদি টু শব্দ করো তাহলে তখনই তোমাকে শেষ করে দেব। সুমিত্রা ভয়ে চুপ করে থেকে সম্মতির মাথা নাড়ে।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় রথীন্দ্রনাথ তার বন্ধু ও অনুরাগীদের সাথে বসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ‘”ছোটো বউ রাহী আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারছি না! অন্য পুরুষের সঙ্গে যদি যাওয়ারই ছিল তবে বিয়ের আগেই যেতে পারতো!” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুমিত্রার চোখে চোখ পড়তে চুপ করে যায়।তারপর সুমিত্রাকে উদ্যেশ্য করে বলে আজ রাতে আমি একা থাকবো।
পরের দিন সকালে রথীন্দ্রনাথ আর ঘুম থেকে ওঠে না। পাশে বিষের শিশি পড়ে থাকতে সবাই বলে রথীন্দ্রনাথ আত্মহত্যা করেছে। রাহীর জন্য লজ্জ্বায় এই কান্ড ঘটিয়েছে। খুব ভালো মনের মানুষ ছিল তাই এই অনাচার মানতে পারেন নি।
সুমিত্রা অঝোরে কাঁদতে থাকে। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সুমিত্রা বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু জয়ের হাসি হেসে নেয়। তারপর শোকাহতের মুখোশ পরে নিয়ে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।