Site icon আলাপী মন

গল্প- চিরকুট

চিরকুট
দেবস্মিতা ঘোষ

 

ঘরের নীল আলোটা জ্বেলে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। মন জুড়ে ভালো খারাপ মিশ্র অনুভূতি। অনেক আশা নিয়ে বসে আছি শেষ চিরকুট-এর জন্য। সবাই ভাবছে আজ আমার জয়ের দিন। কিন্তু সত্যি হলো আমি এই জয়ের একটি অংশ মাত্র। প্রকৃত বিজয়ী আজ আর এই জগতের বাসিন্দা নয়। সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করার সময় এসেছে।

আমি শতদল বসু। পেশায় একজন নাম ডাক হীন উকিল অন্তত দুই মাস আগে অবধি তাই ছিলাম। আমার ভাগ্য একটি দিক থেকে খুবই প্রসন্ন ছিল, কারণ আমি পেয়েছিলাম অরূপ স্যারকে। বিখ্যাত উকিল অরূপরতন রায়ের এসিস্ট্যান্ট হতে পেরেছিলাম। আমার স্যার এর সুখ্যাতি সমন্ধে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। তার সমবয়সী অথচ তাকে ঈর্ষা করেনা এরকম লোক কমই ছিল। স্যারকে অনেক কাছ থেকে দেখে তার প্রতি ভক্তি দ্বিগুণ হয়ে যেত। খুব কম সংখ্যক কেস উনি হাতে নিতেন তবে শেষ ছয় সাত বছরে উনি কটা কেস হেরেছেন সেটাও বলা যায় না।

আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে আমার স্যার মারা যান। খুন হন।

মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে তিনি একটি কেস হাতে নেন। স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষকের সতেরো বছরের মেয়ের ধর্ষণের কেস। অভিযোগ ছিল বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের অধিনায়কের ছেলের বিরুদ্ধে। অনেক পরিশ্রম এর পরেও কোনো প্রমাণ হাতে আসছিল না। উল্টোদিকে একের পর এক প্রাণে মারার হুমকি। পুলিশি প্রোটেকশন এর জন্য রাজি করাতে পারিনি স্যারকে। মানুষটা চিরদিনই নিজের ব্যাপারে কম ভাবত।

দিনটা ছিল শনিবার। ঝড় বৃষ্টির রাতে হঠাৎ স্যারের ফোন পাই। উৎফুল্ল গলায় স্যার বলেছিলেন যে প্রমাণ পেয়ে গেছেন। কি প্রমাণ কিভাবে পেলেন বলার আগেই ফোন কেটে গিয়েছিল। আরও দু’বার ট্রাই করেও পাইনি। আমি পুলিশকে জানাই তৎক্ষণাৎ। তবে স্যার অবধি পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেছিল। স্যার শুয়েছিলেন তার বাড়ি থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে একটি রাস্তার ধারে, মৃত অবস্থায়। রোড এক্সিডেন্ট প্রমাণ করতে অসুবিধা হয়নি। তবে ভেতরে ভেতরে উপলব্ধি করেছিলাম যে স্যারের প্রতিপক্ষ এবার একটু বেশি শক্তিশালী ছিল স্যার বুঝে উঠতে পারেননি। ফোনে উল্লিখিত প্রমাণের ব্যাপারটা আমি কাউকে বলিনি কারণ মৃতদেহের সাথে কোনো জিনিস পাওয়া যায়নি। নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিভাবে দিন কেটে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি।

স্যার চলে যাওয়ার তিন দিন পর রাত বারোটা নাগাদ আমার বাড়ির দরজায় হঠাৎ ঠকঠক আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি কেউ কোথাও নেই। নীচের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। একটি চিরকুট। কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে চিরকুট রেখে কেউ পালাবে কিভাবে। চিরকুটটা তুলে নিলাম। সাদা কাগজের ওপর কালো কালি দিয়ে লেখা। লেখা পড়ার আগেই আমার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। লেখার প্রথমেই লেখা “শত” আর হাতের লেখাটাও স্যারের। “শত” বলেও শুধু এক জনই ডাকত আমায়। চিরকুট এর বাকি লেখাটা পড়তে গেলাম আমি…

চিরকুটের মধ্যে আমার ডাকনামের নীচে শুধু একটা বাড়ির ঠিকানা দেওয়া। আর লেখা “কাল সকালেই একবার চলে যাস। আর ফিরতি পথে রমার থেকে গীতাবিতানটা নিয়ে আসিস।” এই হাতের লেখা আমি ভালো ভাবে চিনি। ভুল হবার কোন জায়গা নেই তাও চিরকুটটা ঘরে এনে আমার একটি পুরোনো খাতায় থাকা স্যারের লেখার সাথে মিলিয়ে দেখলাম। হুবহু এক।

ঘরে বসে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় রাত কেটে গেল কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। সকাল হতেই আর থাকতে না পেরে ঠিকানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িটার সামনে এসে বুঝতে পারলাম যে এটা তো মাস্টারমশায়ের বাড়ি। আগে না আসলেও ঘটনাটি ঘটার পর থেকে এই এলাকার নাম টিভির পর্দায় প্রায় আসছে। অথচ আমি কিনা কাল থেকে বোকার মতো ভেবে চলেছি। যাই হোক, ভিতরে গিয়ে মাস্টারমশায়ের সাথে কথা বলে বোঝা গেল যে স্যার মারা যাওয়ার পর কেস এর ভবিষ্যৎ সমন্ধে তিনি আর কোনো আশা রাখছেন না। আর কোনো উকিল রাজিও নন এই কেসের দায়িত্ব নিতে। বড় অংকের টাকা দিলেও নয়। মনে মনে ভাবলাম জীবনের দাম টাকার থেকে বড় সেটা ওরা বুঝে গিয়েছে। এবার উপলব্ধি করলাম এই ঠিকানায় আমাকে পাঠানোর মানে।

আমি ওনার মেয়ের কেসের দায়িত্ব নেব শুনে স্বাভাবিক ভাবেই উনি অবাক হলেন। মুখে শুধু বললেন ”আমার মেয়ে যেন সুবিচার পায় বাবা। আর তুমি সাবধানে থেকো।” আমি ওনাকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। আরও একটা কাজ বাকি। সোজা চলে গেলাম স্যারের বাড়ি। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুললেন রোমিতা কাকিমা। ইনিই হলেন স্যারের রমা। “জানতাম তুই আসবি” বলেই একটি চাবি এগিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। কাকিমা বিষণ্ণ মুখে স্মিত হেসে বললেন “পুরো বইটা নিয়ে যেতে তোরই বেশি কষ্ট।” আর কিছু না বলে চুপচাপ চাবিটা নিয়ে চলে এলাম। স্যারের বা কাকিমার আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ ছিল না। তাই স্যারের মৃত্যুর পর কাকিমাকে এরকম ভাবে একা থাকতে দেখে ভীষণ খারাপ লাগল।

কিন্তু চাবিটা কিসের!? উত্তরটা পেলাম পরবর্তী চিরকুটে। শুধু 15D লেখা ছিল তাতে। যথারীতি স্যারের অফিসের 15D লেখা কাগজের বাক্স থেকে স্যারের হাতে লেখা ডায়রি উদ্ধার করলাম পরদিন গিয়ে। তাতে শুধু এই কেস সম্পর্কে তথ্য ছিল।

প্রথম চিরকুট পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে কেস আবার চালু হলো। আমার কেসের দায়িত্ব নেয়া যে চূড়ান্ত বোকামির কাজ সে সম্বন্ধে এলাকার সমস্ত মানুষ বোধকরি নিশ্চিত ছিলেন। উপদেশ পেয়েছিলাম “আবেগের বশে” বা “নামকেনার” জন্য এসব যেন না করি। তবে চিরকুট আসা কিন্তু বন্ধ হয়নি। ওই চিরকুটের বলে দেওয়া সূত্র ধরেই ধীরে ধীরে কেসোটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু স্যারের বলে দেওয়া শেষ প্রমাণটার কোনো হদিস নেই। এরকম ভাবে দেড় মাস কেটে যায়। জামিন পেয়ে বাইরে আসে রিতম, এই কেসের আসামী। রিতম বাইরে আসার পরের দিন আসা চিরকুটে লেখা ঠিকানাটা আমার খুব চেনা লাগছিল। ঠিকানার নীচে লেখা ছিল “এই মুহূর্তে চলে আয়। দেরী করিস না। একা আসিস”
চিরকুটে বলা জায়গাতে গিয়ে যা দেখেছিলাম তা আজও মনে থাকবে। স্যার এর মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেই জায়গাতেই পরে আছে অন্য একটি ছেলের মৃতদেহ, তার হাতে ধরা একটি রেকর্ডার। আমি চুপচাপ রেকর্ডারটা নিয়ে বাগে ঢোকালাম তারপর পুলিশকে জানালাম “বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পাওয়া” মৃতদেহের কথা।

পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হলো। ভিডিও রেকর্ডারটা দেখতেই সমস্ত ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। স্যারের মৃত্যুর আগে স্যার কোনোভাবে রিতমের কোনো বন্ধুর সাথে আলাপ জমান। তারপর তার সাহায্যে কোনোভাবে মাতাল রিতমের থেকে সমস্ত সত্য ঘটনা জানেন এবং ভিডিও রেকর্ডারে রেকর্ড করেন। তখনও রিতম জামিনে ছিল। এই রেকর্ডার এ শুধু আসামীর বলা ঘটনাটুকুই আছে। কেস এর ফয়সালার জন্য যদিও ওটাই যথেষ্ট ছিল।

এর পরের ঘটনা বিশেষ কিছু না। রেকর্ডার কোর্টে পেশ করার পর রিতমের শাস্তি হয়। জেরার মুখে সে স্বীকারও করে যে রেকর্ডিংয়ের কথা জানতে পেরে সেই লোক দিয়ে স্যারকে খুন করায়। ধর্ষণের দোষ তো প্রমাণিত হয়েই গেছে। দ্বিতীয় বার জামিন পাওয়ার পর সে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলে যে রেকর্ডারটা তাকে দিয়ে যেতে। যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। তার কাছ থেকেই রেকর্ডার উদ্ধার হয়। আজ রিতমের শাস্তি ঘোষণা হয়।

তাই এখন আমি বসে আছি শেষ চিরকুটের আশায়। গত দু’মাস প্রতিদিন পেয়েছি যা। কোনোদিন আমি দেখার চেষ্টাও করিনি যে কে দিয়ে যায় ওই চিরকুট। আর করবই বা কেন! আমি তো জানি ওটা কে পাঠায়। কিভাবে পাঠায় সেটা নয় অজানাই থাকলো…..

হটাৎ দরজার ঠকঠক। চিরকুটটা নিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। ভিতরে লেখা “এই জগতে আমার কাজ শেষ এবার আমাকে যেতে হবে। সাবধানে থাকিস শত, রমার খেয়াল রাখিস”…

Exit mobile version