শাস্তি
– বিশ্বদীপ মুখার্জী
বেশ কিছু দিন হলো মোটা অর্থ রোজগার করতে শুরু করেছি। আগে যে কোম্পানীতে কাজ করতাম, তাতে কম বেতনের জন্য বেশি টাকা জমাতে পারিনি। অগত্যা বিরক্ত হয়ে শেষ অবধি চাকরিটা ছাড়তে হলো। প্রায় ছ’ মাস এদিক-ওদিক ঘুরে অবশেষে এই কাজটা পেলাম। সুদিনের মুখ দেখতে পেলাম। আগে প্রয়োজনের থেকে কম অর্থ রোজগার হতো, এখন বেশি হয়। তাই খরচটাও বেড়েছে। এতো দিন আমি ছিলাম একা, কিন্তু একা থাকাটা এখন সম্মানহানির ব্যাপার হয়ে গেল। গার্ল ফ্রেন্ডের প্রয়োজন বোধ হলো। সৌভাগ্যবশত সেই ইচ্ছেটাও পূর্ণ হলো আমার। সপ্তাহের শেষে গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা অথবা কোনো ভালো রেস্তোরাঁতে খেতে যাওয়া নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। টাকার সুখ কি হয় , সেটা জানতে পেরে সর্বদাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে থাকতাম আমি। অল্প হলেও অর্থের অহংকার যে আমার হয়েছিল সেটা বলতে দ্বিধা নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই যেটা অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যায় না, এই ভাবনাটা মনে এবং মস্তিষ্কে নিজের বাসা বেঁধে নিয়েছিল।
সে দিনটা ছিল রবিবার। আমার ছুটির দিন। সকাল-সকাল রিয়ার মানে আমার প্রেয়সীর ফোন এলো। আমায় বলল – ‘আজ সারা দিন আমি কিন্তু তোমার সাথেই কাটাতে চাই।’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। সে আবার বলতে। রণবীর কাপুরের খুব ভালো সিনেমা এসেছে। দেখতে যাবে কী?’ আমি প্রস্তাব রাখলাম।
রিয়া লাফিয়ে উঠল।
ভেবেছিলাম রণবীর কাপুরের সিনেমাটা দুপুরের শো-তে দেখবো। আগে কোনো রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ সেরে তার পর সিনেমা দেখা। কিন্তু যেটা ভাবলাম সেটা হলো না । বর্ষা কালে মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। দুপুরের ঠিক আগে এমন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো, যে সিনেমা দেখার প্রোগ্রামটা স্থগিত করতে হলো। রিয়াকে ফোনে বললাম -‘সন্ধ্যা ছ’টা বেজে তিরিশ মিনিটে একটা শো আছে। সেটা দেখবো। তারপর এক সাথে ডিনার করে ফিরবো।’
রিয়ার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল , সেটা বলাই বাহুল্য। তার সারা দিনটা আমার সাথে কাটানো হলো না।
অপয়া বৃষ্টি থামলে বিকেল চারটে নাগাদ দেখা করার প্ল্যান হলো।
এবার কোনো বাধা সৃষ্টি হলো না। প্রায় তিনটে নাগাদ থেমে গিয়েছিল বৃষ্টি। ঠিক বিকেল চারটে আমরা দেখা করলাম ধর্মতলায়।
রিয়া জিজ্ঞেস করলো- ‘সিনেমা শুরু হতে তো এখন ঢের দেরি। যাবে কোথায় এখন?’
‘কোথাও বসে গল্প করা যাক।’ আমি বললাম।
‘কোথায়?’
খানিক চিন্তা করে বললাম- ‘আশেপাশে বসার জায়গা বলতে একটি আছে, প্রিন্সেপ ঘাট। গঙ্গার ধারে বসে গল্প করতে পারবো।’
‘যদি আবার বৃষ্টি নামে?’
আমি আকাশের দিকে তাকালাম। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হলো না। দুপুরে যে আকাশে কালো ঘন মেঘ জমেছিল,সেটা কেটে গিয়ে এখন নীল স্বচ্ছ আকাশ দেখা দিয়েছে। পশ্চিম প্রান্ত থেকে সূর্যের রক্তিম আভা দেখে যেন মন জুড়িয়ে যায়।
‘আকাশের অবস্থা দেখে তোমার কি মনে হয় যে বৃষ্টি হতে পারে? আমার তো মনে হয় না।’ আমি বললাম।
‘কি জানি, বাবা। বর্ষা কালে কিছু বলা যায় না।’
যাই হোক, অবশেষে আমার যুক্তিটাই কাজে এলো। আমরা প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে এগোলাম। ধর্মতলার মোড় থেকেই একটা ট্যাক্সি নিলাম। হেঁটে যাওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু দু’টো কারণে হেঁটে গেলাম না। প্রথমত, একটু সময় লাগতো বেশি এবং দ্বিতীয় কারণ হলো বেশি হাঁটা রিয়ার অভ্যেস নেই। খানিক পরেই প্রিন্সেপ ঘাটের গেটের সামনে আমাদের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো।
ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে আমরা পার্কের দিকে এগোবো ঠিক এমন সময় এক ভিখারী আমাদের পথ আটকে দাঁড়ালো। ভিখারীটি মহিলা, বেশ বয়স হয়েছে বলে মনে হলো। গায়ে ময়লা শতছিন্ন কাপড়। গায়ের রং বেশ কালো, এক মাথা রুক্ষ চুল। শরীরটা বেশ ভালোই কুঁজো। ভিক্ষা চাইবার জন্য হাতে কোনো বাটিও নেই তার। কাঁপা-কাঁপা গলায় আমাদের বলল- ‘কিছু দে বাবা, কিছু দে। খাইনি রে, কিছু দে।’
তাকে দেখেই একরাশ বিরক্তির কন্ঠে রিয়া বলল- ‘ওহ মাই গড! কি নোংরা। যা এখানে থেকে, দূর হো। ইস …. আমার পুরো ড্রেস খারাপ করে দেবে । গায়ে কি বিশ্রী গন্ধ।’
ঠিক মনে হলো রিয়ার সামনে কোনো মানুষ নয়, কুকুর জাতীয় কোনো পশু দাঁড়িয়ে আছে, যার স্পর্শমাত্র সে সম্পূর্ণ অস্পৃশ্য হয়ে উঠবে। এহেন জাতির মানুষেরাই রাস্তার ধারে, নালী-নর্দমাতে শুয়ে-বসে থাকা কোনো ছোটো কুকুরের সন্তানকে কোলে উঠিয়ে আদিখ্যেতা করতে ছাড়ে না। দোষ শুধু রিয়াকে দিলে অবিচার করা হবে। সেই ভিক্ষুককে দেখে আমারও গা টা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল। একরাশ ঘৃণা মেশানো কন্ঠে আমিও তাকে বললাম- ‘অন্য জায়গায় যান। আমার কাছে নেই কিছু।’
কথা শেষে করে আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায়নি আমি। রিয়ার হাত ধরে হনহনিয়ে পার্কের দিকে ছুটলাম। ভিখারীটা কিছুক্ষণ আমাদের পেছনে এলো। তার মুখ দিয়ে ক্রমাগত একই কথা বেরোচ্ছে- ‘কিছু দে বাবা। খাইনি, কিছু দে।’
পার্কে গঙ্গার ধারে বসে বেশ অনেকক্ষণ আমরা একে অপরের হাতে হাত রেখে গল্প করলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা। আইসক্রিম থেকে আরম্ভ করে চিপস, ঝালমুড়ি, কোল্ডড্রিংক্স সব কিছুই গলাদ্ধকরণ করলাম আমরা। এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি যে আমি রিয়ার জন্য এক চলমান এ.টি.এম. কার্ড। কিন্তু তাও নির্দ্বিধায় খরচা করে যাচ্ছি আমি। মনে তখন থেকেই কিসের যেন এক খটকা লাগতে শুরু করলো। নিজের মায়ের বলা একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল আমার। আমার মা বলতো- ‘প্রকৃত নারায়ণ তো দীন দুঃখীর মধ্যেই থাকে রে। তাদের কোনো দিন দুঃখ দিস না। তাদের দুঃখ দেওয়া মানে নারায়ণকে দুঃখ দেওয়া।’
আমি আজ কী করলাম? যা করলাম সেটা ঠিক করলাম না ভুল? অফুরন্ত অর্থ ব্যয় করে চলেছি আমি। যদি দশ টাকা সেই গরীবকে দিয়েই দিতাম, তো কি এমন অনর্থ হয়ে যেত? সেই দশ টাকাটাই তার জন্য হয়তো মূল্যবান হতো। তার জন্য হয়তো রিয়ার নজরে আমি ছোটো হয়ে যেতাম। কিন্তু সে সময় রিয়ার নজরে আমি ছোটো হতে চাইনি। যে প্রিয়তমাকে নিয়ে নানাবিধ স্বপ্ন নিজের মনের ক্যানভাসে এঁকেছি, তার সামনে ছোটো হয়ে যাওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। কিন্তু হৃদয়হীন প্রিয়তমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতেও কী লাভ? যার দুঃখীদের প্রতি কোনো মায়া নেই, সে কি আদৌ মানুষ হওয়ার যোগ্য? তাহলে কি আমি নিজেও মানুষ, না মানুষের রূপে পশু তে পরিণত হয়েছি? মায়ের দেওয়া শিক্ষাকে মাটিতে মিশিয়ে তার ওপর অট্টালিকা গড়তে চেয়েছি আমি। রিয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ আছে আমার মধ্যেই। এক রমণীর রমণীয়তাতে মুগ্ধ হয়ে আমি পথভ্রষ্ট হয়েছি, আমি হয়েছি ধর্মচ্যুত।
সিনেমা দেখে, রেস্তোরাঁতে ডিনার সের, রিয়াকে তার হোস্টেল পৌঁছে আমার নিজের ফিরতে প্রায় রাত বারোটা বাজলো। আনন্দ ফুর্তি মেশানো এক সুন্দর পরিবেশেও আমার মন কেমন যেন বিষাদের এক কালো মেঘে ঢেকে রইল। নিজের মনের ভাবনাকে আমি প্রকাশ্যে আনতে চাইলাম না। বলতে গেলে সারা রাত ঘুম হলো না আমার। দেয়ালে ঝুলছিল আমার মৃত মায়ের ছবি। সে দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না আমি। ঠিক মনে হলো, আমি যেন এই পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট প্রাণী। টাকার অহংকার করা এবং নিম্নশ্রেণীর লোকেদের ওপর পাশবিক ব্যবহার করা, এটাই কি আমি শিক্ষা পেয়েছি? শুয়ে-শুয়ে ভাবলাম, আগামী সকালেই আমি পুনরায় যাবো সেই স্থানে যেখানে দেখা হয়েছিল সেই ভিখারীটার সাথে। কিন্তু এবার যাবো একলা। নিয়ে যাবো কিছু খাবার, কিছু টাকা, হয়তো তার লজ্জা নিবারণ হেতু দু’টো সাদা ধুতিও নিয়ে যাবো। কিন্তু সেখানে আর পাবো কি আমি তাকে? তাদের তো নেই কোনো ঠিকানা। এক ধরনের যাযাবর তারা। আজ এখানে তো কাল অন্যত্র। যদি সেখানে তাকে না পাই, তাহলে এই বৃহৎ শহরে কোথায় খুঁজবো তাকে? তাহলে কোনো অন্য দরিদ্রকে সে সব জিনিস দিয়ে শান্ত করবো নিজের মনের জ্বালা ।
পর দিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েই এক কাপড়ের দোকানে গিয়ে কিনলাম দু’টো ধুতি। খাবারের দোকানে গিয়ে কিছু খাবার কিনলাম। অফিসে আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে পৌঁছাতে কিছু দেরি হবে আজকে। সব জিনিস নিয়ে আমি রওনা দিলাম প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে। ট্যাক্সি থেকে নেমে সেখানেই দাঁড়ালাম যেখানে গতকাল বিকেলে দেখা হয়েছিল সেই বুড়ি ভিখারির সাথে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু দেখা পেলাম না তার। অচিরেই চঞ্চল হয়ে উঠল মনটা । পাশে দাঁড়ানো সাদা উর্দি পরা এক পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম তার বিষয়। ফুটপাথের এক প্রান্তে আঙ্গুলের ইশারা করে সে আমায় বলল – ‘ওদিকে দেখুন গিয়ে।’
আমি ছুট দিলাম সে দিকে। যেখানে ফুটপাথ শেষ হয়েছে সেখানে বেশ কিছু লোকের ভিড় দেখলাম, সাথে দু’টো পুলিশের লোক। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখলাম মাটিতে পড়ে আছে এক জনের মৃতদেহ। চাদর দিয়ে সেই দেহটাকে ঢাকবার পূর্বে দেখতে পেলাম তার মুখ। অজান্তেই দু’পা পেছনে সরে গেলাম আমি। হৃদয়ে যে ধাক্কাটা পেলাম, সেটা বর্ণনার ঊর্ধ্বে। সেই মৃত ভিখারীটার মুখে নিজের মায়ের মুখ দেখতে পেলাম আমি। মা যেন চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসছে। আমি করতে পারলাম না প্রায়শ্চিত্ত। আমি চাইলে হয়তো সেই ভিখারীর প্রাণ বাঁচাতে পারতাম। তার ক্ষুধার্ত প্রাণকে আমি চাইলে শান্তি দিতে পারতাম। তার মৃত্যুর কারণ হলাম আমি । এই পাপবোধ, এই গ্লানি নিয়ে এবার সারা জীবন আমায় বেঁচে থাকতে হবে। এটাই আমার প্রকৃত শাস্তি ।
সমাপ্ত ।