কে সেই মেয়েটি!
-শচীদুলাল পাল
অনিমেশ চৌধুরী। বয়স বছর পঞ্চাশ। মাল গাড়ির গার্ড অর্থাৎ মালগাড়ির ইনচার্জ। সে তার এক রাতের অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা আমার কাছে বলেছিল।সমস্ত চার্জ নিয়ে অন্যান্য দিনের মতো টাটানগর রেল ইয়ার্ড থেকে মালগাড়ী নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম তখন রাত বারোটা। মাল গাড়িতে সামনে ড্রাইভার সবশেষে গার্ডের কেবিন। একাকী দূর পাল্লা সফর করতে হয়।
ওয়াগন ভর্তি বিশাল লম্বা মালগাড়ী। বিভিন্ন ধরনের মাল থাকে। সিগনাল ম্যান, এক্সপ্রেস মেল লোকালকে পাশ করিয়ে যদি দেখে লাইন ক্লিয়ার তবেই মালগাড়িকে সবুজ সংকেত দেয়।
তাই রাত বিরেতে সিগনাল না পেয়ে গাড়ি যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে।আজ কাঁটাডি ও উমরার মাঝে তার গাড়ি সিগনাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। নিশুতি রাত। পাশে ঘন গাছ গাছালি। চাপ চাপ অন্ধকার। ডিসেম্বর মাসে শীতের কুয়াশায় বেশি দূরের কিছু নজরে আসছেনা। বন বাদাড় থেকে নিশাচর প্রাণীর ডানা ঝটপটানির আওয়াজ, শিয়ালের ডাক। সোয়েটার মাফলার টুপি হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরে বাইরে বেরিয়ে এসে গাটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। মাসখানেক আগে এখানেই একটি মৃতদেহ দেখেছিলাম। এক যুবতী- বিবস্ত্র, ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। রেল লাইন ধারে পড়েছিল। টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখেছিলাম। আজও তার স্মৃতি মনে আছে। এ অঞ্চলে লাইনধারে এইরকম লাশ অনেকবার দেখেছি। সেইসব কথা ভাবছিলাম।মার্ডার না আত্মহত্যা! হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম ড্রাইভারের হুইসেলে। গ্রীন সিগনাল। আমি আলোর সংকেত দেখিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে এলাম। ভালো করে দরজা বন্ধ করে বসার আসনে শীতে জুবুথুবু হয়ে বসে আছি।
হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি, কড়্ কড়্ কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো।
দেখলাম সেই মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুদিন আগে লাইনধারে যার লাশ দেখেছিলাম।যুবতি মেয়েটির বয়স প্রায় ২৫-৩০। বিবস্ত্র, খোলা চুল।
নিকষ কালো গায়ের রঙ।আবার একটা বিদ্যুতের ঝলক। সমস্ত কেবিন কাঁপছে। মনে হচ্ছে ট্রেনটা উলটে যাবে। ভয়ে আঁতকে উঠলাম। আমার কন্ঠ রোধ হয়ে গেলো।সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বললাম “কে তুমি? তুমি এখানে এলে কী করে? জানো কী গার্ডের কেবিনে আসা নিয়ম বিরুদ্ধ? তোমার জেল হতে পারে।” হঠাৎ মেয়েটি এক বীভৎস মূর্তি ধারণ করলো। চোখ দু’টি বড়ো বড়ো করে আমাকে গ্রাস করতে আসলো। এবার দেখলাম সে সুন্দর লাল রঙের শাড়ি পরে আছে। কপালে সিন্দুর। বড়ো সিন্দুরের টিপ। বললো “আমার নাম শ্যামলী মাহাতো। আমি নেমে যাব। তার আগে আমার নাম ঠিকানা লিখুন। আমি সুইসাইড করিনি। আমাকে রেপ করে হত্যা করেছে। মেরে লাইন ধারে ফেলে দিয়েছে। আমার ছেলেকেও ওরা হত্যা করেছে।”
আমি বললাম “তুমি এর পরে যেখানে গাড়ি থামবে সেখানে নেমে যাবে। আমি লিখতে পারবনা।” সে তখন জোরে কসে এক চড় মারলো। আমি ভিরমি খেয়ে পড়ে গেলাম। মেয়েটি জোর করে কলম নিয়ে রেলের লগ বুকে নাম ঠিকানা স্বামীর নাম লিখল।
চারজন ধর্ষক ও হত্যাকারীর নাম লিখল। বললো “এদের নাম পুলিশকে জানাবেন।”
বলেই চলন্ত পূর্ণ গতির ট্রেন থেকে এক লাফে নেমে পড়ল। এক প্রবল ঝাঁকুনি। মনে হলো ট্রেনটি উলটে গেছে। আমি ভয়ে আঁতকে গেলাম। সংজ্ঞা হারালাম। জ্ঞান যখন ফিরল তখন আমি হাসপাতালে। সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ, রেলের অফিসার ও আমার কলিগরা। তারা বললো বার্নপুর স্টেশনে গাড়ী দাঁড়ালে আপনার আলোর সংকেত না পেয়ে ড্রাইভার ও রেল স্টাফরা আপনাকে কেবিন থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছিল।
আমি শুধু বললাম “আমার লগ বুক কোথায়। প্লিজ একটু দেখাবেন?” পরের দিন দেখি সেখানে সেই মেয়েটির লেখা নাম ঠিকানা সব আছে। যা যা মেয়েটি লিখেছিল সব জ্বলজ্বল করছে। আমি সব ঘটনা খুলে বললাম। সবাইকে অনুরোধ করলাম তদন্ত করতে।
তদন্তে উঠে এলো সত্য ঘটনা।
আমিও ঠিকানা নিয়ে মেয়েটির স্বামীর কাছে গ্রামে গেলাম। মৃত মেয়েটির লাশ দাহ করা হয়েছে। গ্রামের শতাধিক লোক শ্মশানে সেই অন্ত্যেষ্টিতে উপস্তিত ছিল।পুলিশের ডায়েরিতে ও পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে আত্মহত্যা উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেছে। মেয়েটির স্বামী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলো।!
লেখনী সরলতায় যেন মোহিত হয়ে দৃশ্য দেখলাম💐👌