গল্প- নদীর জীবনে জোয়ার ভাঁটা

নদীর জীবনে জোয়ার ভাঁটা
-রেহানা দেবনাথ

 

নদী খুব গরীব পরিবারের মেয়ে ছোটো থেকে খুব অভাব অনটনের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। লেখাপড়া শিখে পাঁচ ভাইবোন যখন বিভিন্ন কাজ করে আয় করতে থাকে তখন তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা দেখা দেয়। মাটির বাড়ি ধীরে ধীরে পাকা বাড়িতে পরিণত হয়। সংসারে অর্থে যখন ভাটা পড়ে ছিল তখন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্কেও ভাটা পড়ে গিয়েছিল। কেউ আসতো না! কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করতো না! নদীর মনে আছে ছোটো বেলায় যখন ওর বাবা চাকরি করতো, দোতলা পাকা বাড়িতে থাকত তখন প্রতিদিন বাড়িতে লোকজনের জোয়ার বইতো। বাবার বন্ধুদের এই বাড়িতেই আড্ডা ছিল। ওর বাবার একসিডেন্টর পরে চাকরি চলে যায়। আর তখন থেকেই বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়িতে আসায় ভাটা পড়ে।

আবার যেই ধীরে ধীরে অর্থের জোয়ার ওদের সংসারের ঢুকতে লাগলো তখন থেকে আবার বন্ধুবান্ধব, চেনা অচেনা আত্মীয়স্বজনদেরও জোয়ার বইতে লাগলো!

সময়ের বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নদীরও শরীরে যৌবনের জোয়ার এল। সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়ে গেল এক ধনী পরিবারে।স্বামী সাগর খুব ভালো গায়ক ও প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ।তার ব্যবসায়ের দিকে মন নেই। সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়,জঙ্গল,সমুদ্রে ঘুরতে বেরিয়ে যায়। খুব কম বাড়িতে থাকে।
একান্নবর্তী স্বচ্ছল পরিবারে কিছু অসুবিধা থাকলেও খুব ভালোভাবেই নদীর জীবন কাটছিল। তিন বছর পর নদী মা হতে চলেছে শুনে দুই বাড়িতেই খুশির জোয়ার বইতে লাগলো। সাগরও কথা দিলো এবারের হিমালয় অভিযান সেরে এসে আর অন্তত বছর পাঁচেক আর কোথাও বেরোবে না। সন্তানের সঙ্গে কাটাবে।
নদীর সুখের জোয়ার ভরা সংসারে ভাটার টান পড়লো সাগরের মৃত্যুর খবর আসার পরই। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর শোক নদীর শ্বশুর সহ্য করতে পারেনি হার্টফেল করে মারা যায়। শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ে।সেই সুযোগে খুড়তুতো শ্বশুরের ছেলেরা সব সম্পত্তি হস্তগত করে ওদের বার করে দেয়।
নদী শাশুড়ীকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে কিন্তু সেখানেও কিছুদিন পর অশান্তি শুরু হয়ে যায়! দাদারা সবাই বিবাহিত প্রত্যেকের আলাদা সংসার কেউ আর ওদের দায়িত্ব বেশিদিন নিতে চায় না।দু’জনের খাওয়ার খরচ, ডাক্তারের খরচ তার উপর সম্পত্তির জন্য কেস করার খরচ!
বোনের দায়িত্ব নিলেও শাশুড়ির নিতে চায় না। নদী বয়স্ক শাশুড়িকে ছেড়ে দেবে না। তার উপর দাদাদের বক্তব্য বাচ্চাটা এবরশন করিয়ে দিয়ে পরে আবার ভালো ঘরে নদীর বিয়ে দেবে।
নদী কিছুতেই তাদের প্রস্তাবে রাজি হয় না।শুরু হয়ে যায় মনমালিন্য। নদী সম্পত্তির ভাগ চায় তাতে আরও সমস্যা বেড়ে যায়।
অবশেষে কিছু টাকার বিনিময়ে নিজের অংশীদারীত্ব দাদাদের হস্তান্তর করে দিয়ে নদী শাশুড়িকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে চলে যায়।
সেখানে গিয়ে বাচ্ছাদের পড়ানো ও একটা ছোট ঘরোয়া খাবারের দোকান খোলে। রান্নার হাত ভালো হওয়ায় কাস্টমার বাড়তে থাকে। কিছু অফিসের লোকজন খেতে এসে তাদের পার্সলের অর্ডার দিতে শুরু করে এইভাবেই ব্যবসায় উন্নতির জোয়ার লাগে। তারমধ্যে শাশুড়ি শোক কাটিয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে। সারাদিন নাতনীকে আদর যত্ন ও তার সাথে খেলা করেই সারাদিন কাটিয়ে দেন।
নদী পাঁচজন কর্মচারী নিয়েও রেস্টুরেন্টে সামলাতে হিমসিম খায় তার সাথে হোম ডেলিভারীর অর্ডার দিন দিন বাড়ছে তাই সে রাস্তার ধারে জমি কিনে তাতে একটা বড় হোটেল তৈরী করেছে।
এখন নদীর জীবনে দুঃখ, কষ্ট আর অর্থের ভাটায় আনন্দ ও উন্নতির জোয়ার ঢুকেছে।
সে তার ছোট্ট মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে সুখের জোয়ারে ভেসে চলেছে।

Loading

Leave A Comment