দৃষ্টি
-দেবস্মিতা ঘোষ
নীল শাড়িতে আর হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়ায় অপরূপ সুন্দরী লাগছে শ্রুতিকে। এত ভিড়ের মধ্যেও বারবার শ্রুতির ওপরেই চোখ চলে যাচ্ছে অনিকের। কি সুন্দর ভাবে সমস্ত সবাইকে সামলে নিচ্ছে শ্রুতি, এটাই ভাবছে অনিক। শ্রুতি অনিকের স্ত্রী। যথার্থ ওর অর্ধাঙ্গিনী, একবছর আগে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা অন্ধ অনিক আজ এই সফলতার চূড়ায় দাঁড়াতে পেরেছে তা শুধুমাত্র শ্রুতির জন্যই।
অনিক একজন শিল্পী। ছবি আঁকা তার পেশা নেশা দুটোই।আজ তার ছবির প্রদর্শনী। সাধারণ মানুষ তো বটেই সমালোচকদের ও প্রশংসা পাচ্ছে সে আজ। অনিক হলের একটা কোনে বসেছিল একটু আর দেখছিল কি অপার দক্ষতার সাথে শ্রুতি মিডিয়ার লোক থেকে শুরু করে সমালোচক দেরও সামলাচ্ছে। মন ভরে গেল অনিকের। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে অনিমেষ এগিয়ে এল তার দিকে।
“এইবারের তোর ছবি গুলো সত্যি দারুণ, খুব জীবন্ত। যেন আস্ত একটা মানুষের জীবন তুই ছবিগুলোর মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিস। তোর হাতের কাজ সত্যি বলতে বরাবরই ভালো, কিন্তু এই ছবি গুলো সত্যি অন্যরকম।” বলল অনিমেষ।
অনিকের খুব কাছের বন্ধু অনিমেষ, সেও একজন চিত্রশিল্পী। বন্ধুর কথার উত্তর দিলো না অনিক শুধু হাসল। “তোর ছবির বিষয়টাই পুরো জিনিসটা বদলে দিয়েছে। আচ্ছা আমি এখন আসি রে।” বলে চলে গেল অনিমেষ। বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে আবার চুপচাপ বসে পড়ল অনিক।
সে ভাবতে লাগল। সত্যিই তো ছবির বিষয়কেই তো সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। শেষ একবছরের ঘটনা সে আবার প্রথম থেকে মনে করতে লাগল সে।
ছবি আঁকবার সরঞ্জাম কিনে ফুটপাত দিয়ে বাড়ি ফিরছিল সে।
হঠাৎই একটি দ্রুত গতিতে আসা মদ্যপ চালকের দ্বারা চালানো বাইকের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে সে। হাসপাতালে ভর্তি হয়। তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু চোখ দু’টিতে কোনোভাবে আঘাত লাগার কারণে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয় তার। কিন্তু মদ্যপ চালকটিকে বাঁচানো যায়নি, তার পরিবারের কাউকে পাওয়াও যায়নি। ছেলেটির নাম জানা গিয়েছিল, তুষার। তুষারের জীবিত অবস্থায় চক্ষুদান করার অনুমতি থাকার কথা জানা যায় তার ব্যাগ থেকে পাওয়া একটি সার্টিফিকেট থেকে। ফলে তুষারের চোখই দান করা হয় অনিককে।
চিত্রশিল্পী হয়ে অন্ধ হয়ে যাবার অভিশাপ থেকে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনিক কৃতজ্ঞ ছিল মনে মনে। এর পর সে তার প্রতিদিনের জীবনে ফেরার চেষ্টা শুরু করলো।
তারপর একদিন ঘটলো এক আজব ঘটনা যার ফলেই আজ অনিক এই জায়গায়। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিল সেইদিন তার তাও সে জোর করে আঁকতে বসে। হঠাৎ তার চোখের সামনে একটি ছবি ভেসে ওঠে। মনে হলো সাদা কাগজে আগে থেকেই যেন সাদা কালিতে ছবি আঁকা এবং সেই ছবি দেখতে পাচ্ছে অনিক। দেখে দেখে সে শুধু পেনসিল বোলালো আর অদ্ভুত জীবন্ত ছবি ফুটে উঠলো। প্রথমে নিজেই বিশ্বাস করতে পারেনি অনিক। ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে বসেছিল সে। প্রথম ছবিটা ছিল একটি হামা দেয়া বাচ্চার।
এই ছিল শুরু। তখনও সে জানত না আর কিকি ঘটতে চলেছে তার সাথে। এরপর একদিন রাত্রে হটাৎ আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। শুয়ে পড়বে ভেবেও কি মনে করে ক্যানভাসের সামনে গিয়ে বসে। ঠিক আগের দিনের আবারও যেন সাদা কাগজে ছবি ফুটে উঠেছে। দারুণ অবাক হয়ে শ্রুতিকে ডাকে অনিক।
“কোনো ছবি দেখতে পাচ্ছ কি!?”
“সাদা কাগজে আবার ছবি কিভাবে দেখব, কি সব বলছ তুমি!! বেশি চিন্তার ফলে ভুলভ্রান্তি হচ্ছে তোমার, যাও গিয়ে শুয়ে পড়।” শ্রুতি চলে গেল।
অনিক পরেও নানা কৌশলে অনেককে জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু কেউ দেখতে পায় না। সাদা কাগজের ছবি শুধু অনিকের চোখেই ধরা পড়ে।
সে যখন সেই ছবির ওপর পেনসিল বুলিয়ে তাকে দৃশ্যমান করে তোলে তখন সবাই অনিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়।
অনিকের মন কিন্তু অন্য জায়গায়। তার বারবার মনে হয় এই ছবিগুলো কাকতলীয় নয়। পরস্পর সামঞ্জস্য রেখে এগুলি তাকে দিয়ে কেউ যেন আঁকিয়ে নিচ্ছে। যেমন প্রথম ছবিটি একটি বাচ্চার। দ্বিতীয়টিতে সেই বাচ্চাকে একটি মহিলা অন্য একটি পুরুষের কোলে দিচ্ছে। তৃতীয় ছবিতে অন্য একটি বাচ্চা বয়সে বড় কিশোর বলা যেতে পারে, একা বসে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে। এরকম প্রায় দশটা ছবি আঁকার পর অনিকের মনে হয় যে সে একটি মানুষেরই জীবন কাহিনীর টুকরো টুকরো ছবি আঁকছে। বলা যেতে পারে তাকে দিয়ে আঁকানো হচ্ছে। এই ছবির নেশায় পাগল হয়ে উঠে সে। সব কটা ছবি শেষ না করলে গল্পটা যেন সে পুরো জানতে পারবে না।
সে এটুকু বুঝতে পারে যে একটি ছেলের জীবনের ছবি সে আঁকছে। ছেলেটি কখনও মাউথ অর্গান বজায় কখনও বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে। ছবির মাধ্যমে অনিক জানতে পারে ছেলেটির বাকি তিনটে বন্ধুও গান বাজনা নিয়ে মত্ত। এক একটি ছবি টুকরো টুকরো কথা হয়ে ধরা দেয় অনিকের কাছে। একটি ছবিতে দেখা যায় এক মহিলার অত্যাচার ছেলেটি নীরবে সহ্য করছে, গায়ে তার কালসিটের দাগ। আবার দেখা ছেলেটি বড় হয়ে গেছে, বাইশ তেইশ বছর। সেই পুরোনো বন্ধুদের সাথেই গান বাজনা প্র্যাক্টিস করছে। এরপর হঠাৎ ছেলেটাকে নেশা করতে দেখা যায়। বন্ধুদের সাথে বচসাও। এতটা ঘটনা জানার জন্য এখন অব্দি অনিক সাতাশটি ছবি এঁকেছে। শেষ ছবিটি আঁকার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল অনিক যদিও সে জানত না ওটাই তার শেষ অদ্ভুত ছবি হবে।
অবশেষে আঠাশ নং ছবিটি শেষ হল। এটি একটি বাইক সংঘর্ষ এর ছবি। সেই ছেলেটি বাইক নিয়ে গিয়ে একজনকে ধাক্কা মেরেছে। কিন্তু আহত ব্যাক্তির মুখ বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটিকেও মৃত মনে হচ্ছে। অনিক বুঝল তার এবার ছুটি ছেলেটির জীবন এখানেই অবসান।
কিন্তু ছেলেটিকে আর কেনই বা অনিক এইসব আঁকছিল!?
এতদিন ছবির নেশায় ছিল সে। আঁকার ঘোর কেটে গেছে তার। জাগতিক সবকিছু থেকে যেন কিছু দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল সে। তখনি সে শ্রুতিকে ঘরে ডেকে এনে প্রতিটা ছবি দেখাল।
শিল্পী স্বামীর পাগলামির সাথে যথেষ্ট পরিচিত শ্রুতি । কিন্তু প্রতিটা ছবি দেখে খুব অবাক হলো সে।
“এত জীবন্ত ছবি, ছবি তো নয় যেন গল্প।”
কিন্তু কিন্তু ভাব করেও প্রথম থেকে সব খুলে বলল অনিক। ছবিগুলো দেখতে দেখতে ই পুরো ঘটনাটা শুনল শ্রুতি। সে বলল,”অন্য সময় হলে হয়ত তোমাকে অবিশ্বাস করতাম তবে শেষ ছবিটা দেখার পর আর নয়। ভালো করে দেখ এটা সেই রাস্তা যেখানে তোমার এক্সিডেন্ট হয়।” তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এ ছেলে আর কেউ নয় সেই বাইক আরোহী, তার চোখেই তুমি এইসব দেখছ।”
শ্রুতির কথা শুনে পুরোটা জলের মতো সোজা হয়ে যায়। কিন্তু কৌতুহল কমে না অনিকের। ছেলেটির জীবন সম্মন্ধে আরও জানার ইচ্ছে হয় তার। নানা কষ্টে সে আর শ্রুতি শেষ অবধি তুষারের ব্যাপারে খবর জোগাড় করে। তুষারের ছবি পোস্টারে দেখে সেই তিন বন্ধু যাদের কথা ছবির মাধ্যমে অনিক জানত, তারা যোগাযোগ করে। তাদের থেকেই তুষারের সমগ্র জীবন কাহিনী শোনে সে।
খুব ছোটবেলায় নিজের মা’ই নাকি তুষারকে বিক্রি করে দেয় এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। তুষার তাদের কাছে আসার কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সন্তান হয়। ফলে তুষারের আদর জোটেনি। অত্যাচার সহ্য করেও সে ছিল, দু’মুঠো খাবারের আশ্রয় ত্যাগ করতে চায়নি। অনেক কষ্ট হলে সে চুপচাপ মাউথ অর্গান বাজাত। ছোটবেলা থেকেই তারা চারবন্ধু খুব কাছাকাছি ছিল। গরিব সকলেই তবে তুষারের অবস্থার জন্য সবাই ওকে একটি বেশি ভালোবাস। ছেলেটি ভালোবাসার যোগ্য ছিল, সবার বিপদে আপদে এগিয়ে যেত। সমস্ত কষ্ট সহ্য করেও হাসিমুখ বজায় রাখত। সেই তুষার হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করে। তার নকল বাবা তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত করেন। নেশার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে সে। বন্ধুরা আটকাবার চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি, দুরত্ব বেড়েছিল শুধু। স্বপ্ন ছিল চারবন্ধুর ব্যান্ড হবে, শেষ অবধি তুষার আলাদা হয়ে গেল। ও কারুর খবরই রাখত না। তারপর এই একসিডেন্ট। তুষারের মৃত্যুর ঠিকঠাক খবরও বন্ধুরা পাইনি। এত কিছু বলে সমিক, অগ্নি আর রিসভ চলে গেল।
হঠাৎ ভিড় থেকে সামনে এগিয়ে এল শ্রুতি। অতীতের ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে এসে পড়ল অনিক। শ্রুতির পরিকল্পনা অনুযায়ী ছবিগুলো দিয়ে প্রদর্শনী করছে অনিক। “সমীকরা তোমার অপেক্ষায় রয়েছে। আর অনেক রাত হয়েছে, প্রধান অতিথিরাও চলে গেছে। এবার তুমি আসো, বাকিটা দলের লোকজন সামলে নেবে।” শ্রুতি বলল।
অনিক ধীর পায়ে শ্রুতির পিছু নিল। আজকের এই প্রদর্শনী অনিকের ক্যারিয়ারের এক চূড়ান্ত সাফল্য। তার স্থান চিত্রশিল্পী হিসাবে অনেক উঁচু হল। সমিক অগ্নিদের দিকে এগিয়ে গেল সে। আজকের ছবিগুলো বিক্রি হওয়ার ফলে পাওয়া সমস্ত টাকার অর্ধেক ওদের হাতে তুলে দিয়ে সে বলল, “ব্যান্ড বানানোর স্বপ্নটা সফল করার চেষ্টা করো। ওটাই তুষারের শেষ ইচ্ছা ছিল বলে ধরে নাও।”
অনিকের বুকটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হল। সে জানে এত ভালো ছবি সে দ্বিতীয়বার আর আঁকতে পারবে না । তার সুখ্যাতি ও কমে যাবে কিছুদিন পর। তাও আজ সে খুব সুখী। আজ রাতে ঘুমানোর সময় কোথা থেকে একটা মাউথ অর্গানের সুর তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বড়োই বিষণ্ন সে সুর তবুও শান্তি মেশানো..