গেস্ট হাউসের সেই রাত্রি
– বেবী কারফরমা
দু’হাজার চৌদ্দ কি পনেরো সালের ঘটনা। রাঁচিতে আমাদেরই এক পারিবারিক বন্ধুর ছেলের বিয়ে। পারিবারিক বন্ধুর নিজস্ব হসপিটাল ব্যাবসা রাঁচিতেই। বিশাল হসপিটাল তার সংলগ্ন পাঁচতলা গেস্টহাউস।
বিয়ের একদিন আগেই পৌঁছে গেলাম তাদের বাড়ীতে। বিশাল হৈ হৈ ব্যাপার, বাড়ীতে তিল ধারণের জায়গা নেই, একেই বিয়ে বাড়ি তার উপর বাড়ীর কর্তা যেহেতু প্রথম সারির কর্পোরেট তাই আমন্ত্রিত অথিতিগণও সব কর্পোরেট। মনে মনে ভাবছি দিনের বেলা তো কেটেই যাবে কিন্তু রাতে? কার সাথে যে রুম শেয়ার করতে হবে কে জানে, ভোর চারটে থেকে উঠে সব হুলস্থূল লাগালেই ঘুম মাটি, তারপর সারাদিন মাথার যন্ত্রণা উপরি পাওনা।
মেঘ না চাইতেই জল, ভাবী নিজেই বললেন “আভা, তুম গেস্টহাউস মে রহো, আলগ সে এক রুম লে লো, আরাম সে রহো।” আমিও ভাবলাম ব্যাপারটা মন্দ হবে না, রাজি হয়ে গেলাম। কেননা এর আগেও আমি একাধিক বার ওই গেস্ট হাউসে ছিলাম, তবে দোতলা অথবা তিনতলাতে।
যেহেতু বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে আসা, তাই দিনের বেলা বিয়ে বাড়িতেই হইহই করে কেটে গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ গেস্ট হাউসে গিয়ে দেখলাম মোটামুটি তিনটে ফ্লোর মহারাষ্ট্র ও বিহারের মন্ত্রী আর তাদের দেহ রক্ষীদের দখলে, তাঁরাও আমন্ত্রিতদের তালিকায়। কেয়ার টেকারকে বললাম “নিরিবিলি দেখে একেবারে পাঁচতলার কর্নার করে একটা ঘর খুলে দাও, যেখানে গাড়ির আওয়াজ পৌঁছাবে না”। কারন রাস্তার দিকের ঘরগুলোতে ভীষণ গাড়ির আওয়াজ হয়।
যে ঘরটায় আমি উঠলাম তার বাইরের দিকটা পরিত্যক্ত জলাভূমি ও কাঁটা জাতীয় ঝোপে ভর্তি তাছাড়া হসপিটালের একটা অংশ আমার ঘর লাগোয়া। সারাদিনে রাস্তার ধকল, তারপর বিয়ে বাড়ীর হইচই, ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল আর ঘুমও পেয়েছিল। ওই কোনোরকমে হাত মুখ ধুয়ে এসি চালিয়ে চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ বাঁ হাতের যেখানটা ঘড়ি পড়ি অর্থাৎ রিষ্টে কে যেন টোকা মারল। “কে”? বলেই তড়াক করে উঠে বসে পড়লাম, মাথার কাছেই টর্চটা রেখে ছিলাম, জ্বালালাম, দেখলাম কেউ কোথায় নেই। ভাবলাম সারাদিনের ধকল নির্ঘাত উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখেছি তারপর আস্তে আস্তে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে ঘুমিয়েও পড়লাম, আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার একটু ভয় পেলাম, বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালালাম, খাটের তলা, আলমারি খুলে, বাথরুমের দরজা খুলে দেখতে লাগলাম কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে নাকি। দেওয়ালগুলোতে টোকা মেরে মেরে দেখতে লাগলাম কোথাও কোন গুপ্ত দরজা আছে কিনা। কেমন যেন একটু ভয় ভয় করতে লাগল, এবার লাইট জ্বেলেই জেগে রইলাম। বেশ অনেকক্ষণ পর হয়ত একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন পায়ে হাত বোলাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে গেলো, দেখি কেউ কোথাও নেই।
না, এর পর আর ঘুম আসেনি, জেগে জেগেই সকাল হয়ে গেলো। ভোরের দিকে কর্তাই আগে ফোন করলেন ,বললেন নিচে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেড়িয়ে যেতে, কেননা ভোর থেকেই বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু। তাঁকে রাতের ঘটনাটা সব জানালাম, তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, বললেন পাঁচতলার কর্নারের ঘরটা আসলে হসপিটালের মর্গের পাশের ঘর। তাঁকে না জিজ্ঞাসা করে একা একা পাঁচতলায় থাকার জন্য ওই ভোরেই ফোনে ফোনে একতরফা ছোটোখাটো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন।
এবার কানে শুনে রাতের অন্ধকারে যত না ভয় করছিল, ভোরের হাল্কা আলোয় ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ঘরে অনেকগুলো ভূত ঘাপটি মেরে বসে আমায় পিটপিট দেখছে,শুধু আমিই তাদের দেখতে পাচ্ছি না।
না এরপর আর দেরী করিনি, টুকটাক ব্যাগ থেকে যা বের করেছিলাম সব ঢুকিয়ে নিয়ে সোজা লিফটে করে গ্রাউন্ড ফ্লোর।
এবছর মার্চে আবারও রাঁচি যেতে হয়েছিল কাজের জন্য ,তবে থাকার জন্য ঠিক হয়েছিল ওদেরই ইউনিয়নের গেস্ট হাউসে, হসপিটালের গেস্ট হাউসে নয়। যদিও এই গেস্ট হাউসটাও প্রথম সারির গেস্ট হাউসের মধ্যেই পড়ে। তবে এই গেস্ট হাউসের কিছুটা দুরেই কবরখানা। আমি সাথে সাথেই না করে দিয়ে ছিলাম। কেননা ওখানে ‘ওরা’ সংখ্যায় কম ছিল , এখানে যদি ‘তারা’ দল বেঁধে কেউ মাথায় , কেউ হাতে, কেউ পায়ে টোকা মারত, আর সটান মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত তাহলে বোধহয় পৈতৃক প্রাণ নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হতো না।