একদিন প্রতিদিন
– রাখী চক্রবর্তী
রাত বারোটা, বাড়ির মেয়ে বা বাড়ির বৌ বাড়ির বাইরে- একান্নবর্তী পরিবার হলে আত্মীয় স্বজন, তা না হলে পড়শী এনাদের বিকৃত মুখে একটাই কথা ‘স্বভাব চরিত্রটা গেছে,দেখো রাতবিরেতে কি করছে?’এনারা বোঝার চেষ্টা করেন না বিপদ কত রকমের হতে পারে।
অন্য দিকে ভালোবাসার মানুষটি যখন মন জুড়ে থাকে তখন তার চরিত্রটি নিষ্পাপ থাকে। ভালোবাসার বাঁধন আলগা হলো কি প্রিয় মানুষের চরিত্রে দাগ লাগতে শুরু করল।
“সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে রাজপুত্তুর আসছে। তোকে বে করে নিয়ে যাবে। কত্ত সুখে থাকবি। স্বামীর সংসারে যখন রাজরানী হয়ে থাকবি তখন আমার কথা ভাববি”।
টিং টং
দরজা খুলেই রণমূর্তি ধারণ করল পিয়ালি “রোজ রাত করে বাড়ি ফেরো, কোথায় যাও অফিস ছুটির পর? আজ আবার রাত্রি আটটার সময় শাড়ির দোকানে কি করেছিলে? ভেবেছিলে চুপিচুপি কাজ সারবে। ভাগ্যিস শেফালি তখন দোকানের খুব কাছেই ছিল তাই তো সব জানতে পারলাম। চরিত্রটা একটু ভালো করো। বৌ থাকতে কার জন্য শাড়ি কিনছিলে। কোথায় গেল শাড়ির প্যাকেটটা? ওও একেবারে দিয়ে বাড়ি ফিরলে?”
শমিত কোন কথা না বলে ঘরে গিয়ে শোফায় বসে বলল, “সন্দেহটা তাড়াও নিজে ভালো থাকো অন্যকেও ভালো থাকতে দাও।”
“ঠিক বলত মা, আমি যে কেন তখন মার কথা শুনলাম না। জীবনটা নরক হয়ে গেল। না আছে অর্থর প্রাচুর্য আর না আছে মনের আনন্দ।”
“তুমি সব জেনে শুনে আমাকে বিয়ে করেছিলে, টাকা পয়সা থাকলেই বুঝি রাজপুত্তর হওয়া যায়?”
“থাক হয়েছে, এত রাতে বাড়ি ফিরে আর ভালো মানুষ সাজতে হবে না। আগে নিজের চরিত্র ঠিক করো।তারপর কথা বলো।”
শমিত গত দু’মাস ধরে রাত করে বাড়ি ফিরছে। পিয়ালির বান্ধবীরা ফোন করে বলে আজ এখানে দেখলাম শমিতকে কাল ওখানে দেখলাম। এই নিয়ে সন্দেহর আর শেষ নেই পিয়ালির।
পিয়ালি কখনওই শমিতকে ঠকাতে পারবে না। মাকে বলে দিয়েছিল পিয়ালি, “তোমরা আর পাত্রের খোঁজ করো না। আমি কাউকে ঠকাতে পারব না।”
শমিতকে পিয়ালির মা, দাদারা কেউ পছন্দ করত না। কারণ শমিত সামান্য একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত। কিন্তু পিয়ালিও সব নিয়ে ভাবত না। তাই বাড়ির অমতেই ওরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল।
একবছর তো ওরা ভালোই ছিল। পিয়ালির তো কোনো অভিযোগ ছিল না শমিতের বিরুদ্ধে।
শমিত তো খুব ভালো ছেলে। তাহলে কি এমন হল যাতে পিয়ালির মনে এত সন্দেহ শুরু হল?
নিত্যদিনের অশান্তি আর ভালো লাগে না ওর। তাই পিয়ালি মন ভালো করার জন্য বাপের বাড়ি গেল। কিছু দিন থাকবে বলে।
এদিকে পিয়ালির মা ওর মাসির বাড়ি বেড়াতে গেছে। অগত্যা কিছু করার নেই। মাকেই তো বলবে মনের দুঃখের কথা। দু’দিন থেকে শমিতের কাছেই ফিরে এল পিয়ালি।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা গুম ধরে আছে। যেন কোন বড় ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। শমিত আজ অফিসে যাবে না। শরীর খুব খারাপ। বেলা দশটা নাগাদ একটা ফোন এল। আড়ি পেতে পিয়ালি শুনলো। কার যেন খুব শরীর খারাপ। শমিতকে এক্ষুনি যেতে হবে।
পিয়ালি ঢাল হয়ে দাঁড়াল শমিতের সামনেএ,”অনেক সহ্য করেছি আর নয়। কে অসুস্থ না বললে কিছুতেই এই ঘরের চৌকাট তুমি পার হতে পারবে না।”
শমিত কিছু না বলে এক ধাক্কা দিয়ে পিয়ালিকে সরিয়ে বেরিয়ে গেল। পিয়ালি আজ এর শেষ দেখেই ছাড়বে।ও পিছু নিল শমিতের। আজ এসপার নয় উসপার একটা করেই ছাড়বে পিয়ালি।
শমিতের রিক্সা অনুসরণ করে পিয়ালি পৌছে গেল একটা অর্ধ নির্মিত বাড়ির কাছে। সেখানে অনেক লোকজন জমায়েত হয়েছে।
শমিতকে দেখে সবাই বলতে লাগলো, “আপনার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
“শমিতের মা তো দু’বছর হল মারা গেছেন। তাহলে ওরা শমিতের মা বলছে কেন? ভেতরে গিয়ে দেখি তো।” পিয়ালি ভেতরে গিয়ে দেখে শমিতের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে পিয়ালির মা।
“বাবা পিয়ালিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একটিবার নিয়ে এসে ওকে। অনেক কথা বলার আছে ওকে।”
এমন সময় পিয়ালি ওর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”কি হচ্ছে এ সব মা? তুমি তো মাসীর বাড়ি গেছিলে তাহলে এখানে কেন?”
ওর মা বলল, “যেদিন তোর দাদা বৌদিরা আমাকে বাড়ির থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। গঙ্গার ঘাটে আমি সকাল থেকে বসেছিলাম। বিকেল বেলায় শমিত ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে ও আমার সব কথা জানতে চাইলো। আমি কিছু লুকাইনি, সব বললাম শমিতকে। আমি ভুল ভাবতাম রে মা। তুই হীরেকে পছন্দ করেছিলি মা। আমি শমিতকে কাঁচ ভাবতাম। এতটুকু অবহেলা করেনি শমিত আমাকে।রোজ অফিস থেকে ফিরে আমার দেখাশুনো করে তবে ও বাড়ি যেত। নিয়মের নড়চড় আজও হয়নি। আমার শরীর খারাপ শুনে, অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে এসেছে।”
পিয়ালি শমিতের দিকে তাকাতেই শমিত বলল, “মা তুমি সব কিছু গোপন করতে বলেছিলে বলে পিয়ালিকে আমি কিছু বলিনি। এখন তো সব জেনে গেল। এবার তোমার মেয়ের কাছে থাকতে কোন অসুবিধা নেই তো।”
পিয়ালি মরমে মরছে, “মার জন্য শাড়ি কিনত শমিত আর, আমি ছি ছি, সন্দেহ করে কত কিই না বলেছি শমিতকে”
মাকে কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগছে পিয়ালির। সত্যি সে রাজপুত্তুরকে পেয়েছে। নাই বা থাকল অর্থের প্রাচুর্য। শুধু গল্প কথাতে না বাস্তবেও কত মনের মানুষকে চরিত্রের দোষ দিয়ে বা শুধুমাত্র সন্দেহের জেরে রোজ আইনি দাড়িপাল্লাতে তোলা হয়। বিশ্বাসের বড়ই অভাব। একদিন প্রতিদিন এই রকম কত ঘটনাই ঘটে, প্রতোক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আমরা সেই সব ঘটনাগুলোর বর্ণনা পাই। সব শেষে বলি, উন্মুক্ত নির্মল আকাশের মতো যেদিন আমাদের মন অপার বিশ্বাস ও ভালবাসায় ভরে উঠবে সেই দিন থেকে সব চরিত্র হয়ে উঠবে মুক্তর মতো উজ্জ্বল, হীরের মতো স্বচ্ছ।
গল্প ভালো লাগলো , কিন্তু নিজেই গল্পের সারমর্ম বলে দিচ্ছেন ? তাহলে গল্পের পাঠক ভাববেন কী ?