খোয়াইয়ের ধারে
– পারমিতা চ্যাটার্জী
খোয়াইয়ের ধারে আজও শনিবারে হাট বসে।
দূর দূর গ্রাম থেকে পসারিরা আসে পসার সাজিয়ে, আবার দিনশেষে, যে যার পসরা গুটিয়ে যাত্রা করে ঘরের দিকে।
খোয়াইয়ের হাট যেখানে বসে, তার একটু আগে একটা রাঙা মাটির পথ নীচের দিকে নেমে গেছে, সেখানেই আমাদের বাড়ী।
সেবার দোল বসন্ত উৎসবের পরের দিন শনিবার ছিল, আর তুমি এসেছিলে হাটে, তোমার সাথে ছিল তোমার কলকাতার বন্ধুরা।
তোমরা বেড়াতে বেড়াতে আমাদের বাড়ীর সামনে চলে এসেছিলে, তখনও আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল, জোৎস্না খেলছিল আমাদের ছোট্ট বাগানটায়।
আমার দু’একজন বন্ধু মিলে, খোলা আকাশের তলায় জোৎস্না মেখে গাইছিলাম গান…
‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো’
গান শুনতে তোমরা দাঁড়িয়ে গেলে,
আর তুমি?
মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে রইলে আমার দিকে,
শুধু আমার দিকে….
– কি যেন এক যাদু ছিল তোমার দৃষ্টিতে, তারপর দিন আবার এলে, তারপরে আবার….
কি তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেললাম তোমায়,
তখন কি বুঝেছিলাম…
– তুমি শহরের বড়লোক আধুনিক পরিবারের শিক্ষিত ছেলে…
আর আমি…? আধা গ্রাম আধা গঞ্জের নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে।হ্যাঁ, তবে আমিও অশিক্ষিত ছিলাম না। আর গান গাইতে পারতাম, শহুরে আধুনিকতা মোটেই ছিলনা। কিন্তু ওই ছোট্ট জায়গায় অনেকেই বলত,-রবীন্দ্রনাথ নাকি আমাকে দেখেই তাঁর গল্পের নায়িকাদের চেহারা আঁকতেন…সে সব ঠাট্টার কথা…
ওই বয়েসে মনে একটু দোলা যে লাগতো না তা বলতে পারি না…
-তোমার বন্ধুরা চলে গেল, তুমি থেকে গেলে।
এসে গেল আর একটি হাটবার। সকাল থেকেই শুরু হল পসারিদের আনাগোণা।একজন বাউল তার ডুগডুগি
বাজিয়ে গাইছিল,
‘গোলেমালে গোলেমালে পিড়িত কইরোনা,
পিড়িতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পড়ে ছাড়বেনা…’
তুমি আমায় ঠেলা দিয়ে বললে,
-বুঝলে এ আঠা লাগলে পড়ে ছাড়বেনা…
সত্যি আমার এখনও ছাড়েনি…পরদিন গাড়ী করে তোমার বাবা মা এসে তোমায় নিয়ে গেলেন। যাবার সময় তোমার চোখে ছিল জল, তাও আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলেছিলে,
-দু’টো বছর অপেক্ষা করো, আমি ঠিক আসব।
আজ বারো বছর হয়ে গেল এখনও অপেক্ষার জানলায় বসে আছি, তুমি আর আসোনি। আমিই বা কি বোকা ছিলাম, সাধারণ বাপমায়ের সাধারণ মেয়ে হয়ে বড়লোকের ছেলের ভালোবাসায় গা ভাসিয়ে দিলাম।
এখনও শনিবারের হাটে এসে খুঁজে বেড়াই, আমার সেই ক্ষণিক পাওয়া ভালোবাসাকে।
মাঝে মাঝে মনে হয় ওইতো!
ছুটে যাই কাছে, গিয়ে দেখি অচেনা অতিথি…।
এইভাবেই একদিন অচেনার মাঝে বহুদিন প্রতিক্ষিত সেই চেনা মানুষটাকে পেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমায় চিনতে পারেনি, তার সাথে ছিল তার বাবা, মা, মনে হল স্ত্রী আর মেয়ে।
আমার আকুল চোখের দিকে তাকিয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে নিল, এটাই তে স্বাভাবিক, দু’দিনের দেখা একটা আধা শহুরে মেয়ের কাছে কথা রাখতে কেউ আসে?
আমি রাঙা মাটির পথ ধরে বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম, বাবা আছেন আমার অপেক্ষায় তাকে খাবার দিতে হবে।