গল্প

গল্প- সমর্পণ

সমর্পণ
– শচীদুলাল পাল

 

মেয়েটির নাম বর্ষা। ছেলেটির নাম আকাশ।মেয়েটি বয়স আঠারো, ছেলেটির তেইশ।গ্রামের প্রান্তে ছোট্ট নদী কুল কুল শব্দে বয়ে চলেছে। নদী তীরে এক অশ্বত্থ গাছ। গাছের তলায় তারা মিলিত হতো। অষ্টাদশী মেয়েটি শাড়ি পরে আসত। পূর্ন যৌবনা বর্ষা ছিল অভিমানী। একদিন যদি আকাশ না আসতো পরে যেদিন দেখা হতো সেদিন তার ক্ষোভ উজাড় করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ত। দু’গাল দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তো। আকাশ চোখের জল না মুছালে অভিমান করে বসে থাকত।আজ সে শৃঙ্গার করেনি। বিকালের পড়ন্ত বেলায় সূর্যের অস্তরাগে রক্তিম আভায় গাল দুটি থেকে এক অভূতপূর্ব রশ্মি ঠিকরে পড়ছে। পানপাতার মতো মুখ। ক্ষীণ কটিদেশ গুরু নিতম্ব সুউচ্চ সুডোল পীনোন্নতপয়োধরা। আজানুলম্বিত বাহুযুগল।নিকষ কালো চুলে মোহময়ী লাগছে। উজ্জ্বল চোখে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে এক সরলতা। আকাশ সামনে এসে বললো “তোমার শরীর থেকে পদ্মফুলের সুগন্ধ পাই। তুমি পদ্মিনী নারী। এই সৌগন্ধে আমি মোহিত।” বর্ষা বলল “হবে হয়তো। তুমি অশ্ব পুরুষ।” আকাশ বলল “কী দেখে বললে?”
বর্ষা বললো “তুমি ত লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটো ঘোড়ার মত।”
– “আমি তোমাকে পদ্মিনী বলেছি। আমি কামসূত্র পড়েছি।”
বর্ষা বলল “আমিও পড়েছি।”
-“বাহ্ তাহলে তুমিও নিষিদ্ধ বই পড়ো।” আজ থেকে অন্তত ৩০ বছর আগের কথা। তখন আজকের মত এত খুল্লাম খুল্লা মোবাইল এ হট ফিল্ম দেখার চল ছিল না।এভাবে বসন্তে গ্রীষ্মে বর্ষায় শীতে তারা সচরাচর নদী তীরে আড়ালে আবড়ালে দেখা করতো। এভাবে একদিন দু’জনের ভাললাগা থেকে ভালবাসায় পরিণত হলো। প্রেম গভীর হলো। কতদিন সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে বিনিন্দ্র রজনী কাটালো। সেদিন নদীতীরে কালবৈশাখী ঝড়। বিদ্যুৎ এর ঝলকানি সাথে কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়লো। বর্ষা ভয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরলো দু’জনের শরীরে এক তরঙ্গ খেলে গেল।ৎঅঝোর ঝরে বৃষ্টি এলো। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। সিক্ত বসনে একরাশ ঘন কালো লম্বা খোলা বর্ষার কেশদাম। মোহময়ী চোখে এক আবেদন। শরীরে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অজানা শিহরণ খেলে গেলো। নদীতীরে সূর্য্য অস্ত গেল। আঁধার ঘনিয়ে এলো। কালবৈশাখীর প্রথম আগমনে শিলাবৃষ্টির মত অনাস্বাদিত
আনন্দে দু’জনেই শিহরিত হলো।
কতক্ষণ তারা এভাবে ছিল খেয়াল ছিলনা।সম্বিত ফিরে পেল দূরে টর্চের আলোয়। ধীর পদক্ষেপে বাড়ি ফিরল। বর্ষার বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সামনেই কাকীমা। বলল “ঘরে চল দেখাচ্ছি মজা।”
একান্নবর্তী পরিবারে গোপনে আলোচনা হলো।
পরদিন যা হবার তাই হল। বর্ষার বাইরে যাওয়া বন্ধ হলো, কলেজে যাওয়া বন্ধ হলো।বিয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু করলো। বর্ষা প্রতিবাদ করলো। বললো “আমি আকাশকেই বিয়ে করব।” বাবা বলল “না, আকাশ ভিনজাতি সমাজ মানবে না। গরীবের ছেলে।” বর্ষা বাবাকে বলল “ও গরীব হতে পারে কিন্তু শিক্ষিত। ইঞ্জিনিয়ার। একটা চাকরি পেয়ে যাবে।” বাড়ির একজনও বর্ষাকে সমর্থন করলনা। এদিকে আকাশ নিয়মিত নদী তীরে অশ্বত্থ গাছ তলায় আসতো আর ফিরে চলে যেত। ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে যেত।
একদিন বর্ষা এল ক্ষণিকের জন্য বললো “আকাশ চলো দু’জনাই পালাই। অন্য কোনো দেশে অন্য কোথাও।” তা নাহলে আমার বিয়ে অন্যত্র দিয়ে দেবে। আকাশ বলল “তা হয় না আমি বেকার। আয় নেই উপায় নেই।অসম্ভব। অবাস্তব।” অজানা আতঙ্কে বর্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
আকাশ আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁঁচবো না। কিংকর্ব্যবিমূঢ় আকাশ শুধু বর্ষার পানে চেয়ে রইলো। দু’জনে দু’জনের দিকে চেয়ে রইলো। বর্ষার দু’চোখে বৃষ্টি নামলো। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে বর্ষা দৌড় দিল। ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে। আকাশও ছুটছে।বলছে “দাঁড়াও, দাঁড়াও কিছু দিন সময় দাও।”
বর্ষা এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে গেল।
এক ধনী পরিবারে বিয়ে ঠিক হলো। অনেক বরপণ সোনাদানা আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিতে হবে।
বিয়ের সন্ধ্যায় অপরূপ সাজে সজ্জিত বর্ষা।মহা সমারোহে বর ও বরযাত্রী এলো। সবাই যখন বর দেখায় ব্যস্ত সেইসময় হঠাৎ দেখল জানালায় একজোড়া চোখ। তার হৃদয় আলোড়িত হলো। বর্ষা আকাশের কাছে নিভৃতে মিলিত হলো। বর্ষা আকাশকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল “চলো পালাই।”
আকাশ বলল “তা হয়না। নিয়তির বিধান, মেনে নাও।” আকাশ বর্ষার কপালে এক দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বর্ষা অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে এলো। মহাধুমধামে বিয়ে হলো।
শ্বশুর বাড়ি এল। অবস্থাপন্ন বাড়ি। শ্বশুর শাশুড়ি ডিভোর্সি ননদ ও তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভরপুর সংসার।
ফুলসজ্জার রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ভোর রাতে বর এলো। প্রচুর মদ্যপান করে ঘরে ঢুকে টলমল পায়ে বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন এক পড়শী কাকীমা গোপনে ছেলের বর্ণনা যা বলল তা শুনে মনটা ব্যাথায় ভরে গেলো। ছেলের এর আগে দু’বার বিয়ে হয়েছিল। তারা কেউ সংসার করতে পারেনি।ছেলেটা মাতাল। কম বয়স থেকে চরিত্রহীন।
অনেকগুলি রাত কেটে গেলো। বর তার ঘরে আসত না। দিন কয়েক পর একরাতে এলো। মদ্যপ স্বামী তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। বিকট গন্ধে ও ঘৃণায় বর্ষা তার বরকে একধাক্কা দিল। ও বিছানা থেকে পড়ে গেল।সামনে টেবিলে ধাক্কা লেগে রক্তাক্ত হলো। বর চীৎকার করে লোক জড়ো করল। শাশুড়ী ননদ এসে বর্ষাকে মারধর করলো। বর্ষা অশ্রু জলে বিনিদ্র রাত্রি কাটালো।
এরপর বর্ষা ঠিক করল সবকিছু মেনে নেবে।
কয়েক দিন পর আবার মদ খেয়ে বর এলো। অসহ্য বিকট গন্ধ। এসেই সে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরল। এবার সে বাধা দিল না। হঠাৎ বর ক্ষণিক পর নিস্তেজ হয়ে বর্ষাকে ছেড়ে দিল। এরকম ঘটনা বেশ কয়েক রাতে পুনরাবৃত্তি ঘটলো। বর্ষা জানতে পারলো বর তার পুরুষত্বহীন।
একদিন রাতে যখন সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন বর্ষা ঘর থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লো।নিশুতি রাত। রাস্তা জনমানবহীন। স্টেশন যখন পৌছাল তখন স্টেশনের ঘড়িতে রাত তিনটে।
বাপের বাড়িতে এসে মাকে সব বললো। পরদিন আকাশের খোঁজ নিল। ও এখন গ্রামে থাকে না। চাকরি পেয়ে হায়দ্রাবাদ চলে গেছে।
দীর্ঘ দিন কেটে গেলো। তারপর আর বৃষ্টি হয়নি। খরার কবলে ধরিত্রীর সব রুক্ষ শুক্ষ।প্রচন্ড গরম। বেদনা ক্লিষ্ট বর্ষা আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে দিন কাটাতে লাগলো। আকাশ কবে আসবে? কতদিন দেখিনি। ওকি অন্য মেয়েকে ভালবাসবে! আকাশের বিরহে সদা সর্বদা মন ভারাক্রান্ত হয়ে দিন কাটাতে লাগলো।
পুজা এলো। একদিন পুজামন্ডপে দেখলো।ওই ত আকাশ। ইশারায় ডাকল। আজ আকাশে মেঘের ঘনঘটা।
আবার সেই নদী কুল অশ্বত্থ গাছতল।দীর্ঘ বিরহের পর মিলন।
দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুম্বনে ভরিয়ে দিল। অভিমানী বর্ষার দু’চোখে জলের ধারা।আজ আকাশ থেকেও অঝোর ধারায় মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি। রুক্ষ ধরনী সিক্ত হলো।
বর্ষা তার কাহিনী সবিস্তারে বর্ননা করল।”বলল আমার হৃদয়ে তুমি ছাড়া কেউ নেই। যদি বুকটা চিরে দেখাতে পারতাম।সেখানে তুমি ছাড়া কেউ নেই। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁঁচবোনা।”
আকাশ বলল” আমি এতদিন তোমার বিরহে পাগলপ্রায়।ভগবানকে কত ডেকেছি। ভাবতাম ভগবান কানা না হয় কালা। এখন দেখছি ভগবান কানাও নয়, কালাও নয়।”
বর্ষা এক হাতে দড়ি অন্যহাতে সিঁদুর কৌটো নিয়ে আকাশের দিকে প্রসারিত করে বললো ” তুমি আমাকে যেকোনো একটা দাও”।
আকাশ দড়িটা প্রথমে নিয়ে বহমান নদীর জলে জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
অন্য হাতের সিঁদুর কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে বর্ষার সিঁথিতে পরিয়ে দিল। আকাশে তখন মেঘের আড়ালে নবমীর চাঁদ। দূরে পুজামন্ডপে আরতির শঙ্খ ধনি, ঢাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা বাজছে।

আকাশ থেকে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ আর বর্ষায় দশ দিক এক্কাকার হয়ে গেলো।
বর্ষা আকাশের বুকে মাথা রেখে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করলো।

Loading

2 Comments

Leave A Comment

You cannot copy content of this page