গল্প- স্নেহের দায়

স্নেহের দায়
-রীণা চ্যাটার্জী

“বৌদি মাংসটা দারুণ হয়েছে গো, আরো এক পিস দাও তো, আর কিছুটা ভাত…” মাতৃসমা বৌদির কাছে আব্দারে অভ্যস্ত দেব থালায় হাত রেখে খেতে খেতে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে।
অলকা খানিকটা স্বভাব বিরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, “তাই! ভালো হয়েছে বুঝি! তা ভালোলাগার জিনিস ভালো করে, বেশী করে খেতে গেলে খরচ হয় জানো? তার জন্য রোজগার করতে হয়… শুধু ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটালে হবে? দাদা আর কতোদিন একা সংসার টানবে এইভাবে সেই কথা কোনোদিন ভেবেছো?

অলকার স্বামী রবি স্ত্রীর এই অদ্ভুত ব্যবহারের কোনো কারণ খুঁজে পায় না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে খাওয়া থামিয়ে। আর দেব অনেক কষ্টে চোখের জল সামলে বাকি ভাতটুকু খেতে খেতে পরিবেশ হাল্কা করার জন্য গলায় স্বাভাবিক সুর ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে, “কিছু লাগবে না গো বৌদি, আর পারবো না খেতে। পেট ভরে গেছে… উঠি দাদা, তুমি খেয়ে নাও।” বলে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে মাথা নিচু করে বেসিনের দিকে এগিয়ে যায় হাত ধুয়ে নিতে।
অলকা নির্লিপ্ত মুখে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে হাতা নাড়তে থাকে মাংসের পাত্রে।
রবি বলে অলকাকে, ” কি হয়েছে তোমার আজ?”
অলকা বলে, “কিসের কি হয়েছে! কিছু না তো..”
রবি বলে, ” কিছু না! তোমার জন্য যাকে কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। যার জন্য তুমি নিজের সব স্নেহ অকাতরে দিয়েছো এতোদিন। নিজে মা পর্যন্ত হতে চাও নি, ওর কথা ভেবে। ওর অসুবিধা হবে, ওর অযত্ন হবে এইসব ভেবে কোনো দিন ওকে দু’ দণ্ড কাছছাড়া করো নি… সেই দেবকে তুমি আজ কি বললে?
অলকা বলে, ” ভুল কি বলেছি? লেখাপড়া শিখেছে, বড়ো হয়েছে, সংসারে ভালো-মন্দ, আয়-ব্যয়ের দায়িত্ব নেবে না? দাদার রোজগারের ওপর ভরসা করে কতদিন চলবে? দু’জনে মিলে দায়িত্ব নিলে তো সুরাহা হয়, তাই না..”
রবি বলে, “দেখো অলকা, তোমাকে এইসব কথা কোনদিন বলতে হবে ভাবিনি। তুমি কোনোদিন সেই অবকাশ দাও নি, কোনো অভিযোগ তোমার মুখে কখনো শুনিনি। মা মারা যাওয়ার সময় তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তুমি হাসিমুখে আজ পর্যন্ত সব পালন করে গেছ। তোমার কষ্ট কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? তোমরে অসুবিধা কিসের হচ্ছে? আমি তোমাকে কতোটা কষ্টে রেখেছি? আমাকে বলো, আমি চেষ্টা করবো তোমার সমস্যার সমাধান করতে। আর দেব? ও তো পড়াশোনাও নিজের চেষ্টায় যতোটা পেরেছে টিউশনি, স্কলারশিপের টাকায় পড়েছে। আমি দিতে চাইলেও নিতে চায় নি কখনো। সবাই বলে অলকা যে ভাবে দেবকে মানুষ করেছে সব দিক দিয়ে, ওর মা থাকলেও হয়তো পারতো না। সেই তুমি? কি হয়েছে? বলো আমাকে…”
অলকা কোনো কথা বলে না। চুপ করে টেবিল গোছাতে গোছাতে খানিক পরে খুব মৃদু স্বরে বলে, “আমি যা বলেছি, ঠিক বলেছি, ভেবেই বলেছি..”
“জানি না, তোমার ভাবনা। তুমি কি ভেবেছো, তবে খেতে বসে কথাগুলো না বললেই পারতে।” বলে রবি অর্ধভুক্ত থালা রেখে উঠে যায়।
অলকা চুপ করে পাথর চোখে চেয়ে থাকে চেয়ারে বসে। মনে করতে থাকে অতীতের সব কথা। দশ বছরের ছোট্ট দেব। অলকা বিয়ে হয়ে আসার থেকেই বৌদির ভক্ত। খাওয়া, খেলা, গল্প, ঘুম সব বৌদির সাথে। বৌদিকে পেয়ে মায়ের কাছেও ঘেঁষতো না। অলকাও নতুন সংসারে ক্ষুদে সাথীকে আপন করে নিয়েছিল। নতুন বিয়ের পর বৌদির কাছে ঘুমোনো নিয়ে কতো রসিকতা করেছেন সবাই প্রতিবেশী, আত্মীয়রা। ঘুমিয়ে পড়লে শাশুড়ি মা উঠিয়ে নিয়ে গেলেও রাতে উঠে কেঁদেছে কতোদিন। অলকাও দেবে’র কান্না শুনে বন্ধ ঘরে ছটফট করতো।
শ্বশুর বাড়িতে সবাই অলকার ব্যবহারের জন্য ওকে খুব ভালোবাসতো। মামার সংসারে বড়ো হওয়া মৃদুভাষী মেয়েটা বিয়ের পর সুখের চাবিকাঠি হাতে পেয়েছিল যেন।
কিন্তু বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে শাশুড়ি মা হঠাৎ জ্বরে পাঁচ দিনের মাথায় মারা গেলেন। শেষ বেলায় শুধু চোখ ভর্তি জল নিয়ে সংসারের চাবি, দেবে’র একটা হাত অলকার হাতে দিয়ে মাথায় হাত রেখেছিলেন- কোনো কথা বলে যেতে পারেন নি। শোক স্তব্ধ হয়ে গেছিল সবাই- স্বামী বিকাশ বাবু, পুত্র রবি, পুত্রবধূ অলকা। দেব বুঝতে পেরেছিল কিছু অঘটন হয়েছে। তাই খুব শান্ত হয়ে বৌদির কোলে নির্ভরতার আশ্রয় নিয়েছিল। অলকা পুনরায় মাতৃহীন হয়ে অসহায় বোধ করেছিল। তবুও ভালোবাসা দিয়ে আগলে নিয়েছিল শাশুড়ি মা’র ফেলে যাওয়া সংসার। কাউকে কখনো কোনো অভিযোগের তুলতে দেয় নি। রবি নিশ্চিন্তে বাবা, ভাই, সংসারের দায়িত্ব অলকার হাতে দিয়ে নিজের কর্মজীবনে উন্নতির পথে এগিয়ে গেছে নির্বিঘ্নে।
এদিকে মাস ছয়েকের মাথায় শুভচিন্তক আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলো। দেব’কে বলতে থাকলো নানাজনে নানান কথা নানাভাবে। কখনো মুখের উপর, তো কখনো সামনে থাকলে ইনিয়ে বিনিয়ে- “বৌদির কোল আঁকড়ে আর কতদিন চলবে?”, “বৌদির নিজের ছেলে এলে তো তোর দিকে ফিরেও দেখবে না। তখন কি করবি রে?”, “দু’ বেলা পেট ভরে খেতে দেবার কথা মনে থাকবে না তো আদর-আদিখ্যেতা! তোর কি হবে রে দেব?”, “আহা রে! মা মরা ছেলে.. নতুন করে কষ্টে পড়বে।” “ভাগ্য আর কে খণ্ডাবে… ভগবান যাকে মাতৃহারা করেছেন, তার কপালে কি মাতৃসুখ সয় রে বাবা..” “কপালের ফের নাহলে কি আর শেষ বয়সে ফল ধরে!” দেব কি বুঝতো বোঝা যেত না। মুখটা কালো করে সেইখান থেকে সরে আসতো বৌদির নিরাপদ আশ্রয়ে। অলকা অনেক জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর পেত না, শুধু চুপ করে অলকাকে আঁকড়ে ধরে থাকতো।
অবশ্য শুভচিন্তক মাসী- পিসিরা অলকাকে’ও সংসার জ্ঞান দিতে পেছনে থাকে নি। তরকারি, কূটো দিতে- নিতে আসার ছলে, কখনো বা পূজো বাড়িতে, কিংবা দুপুরের মহিলা অবসরে কানের কাছে এসেছে নানা উপদেশ বাণী। কখনো শুনিয়ে, কখনো কানে কানে- “নিজের কোল কবে আর ভরাবে? নিজের কথা এবার ভাবো..”। ” যাকে বুকে করে বড়ো করছো সে তো নিজের আখের গুছিয়ে ভুলে যাবে, তখন তোমার কথা কি ভাববে?” কখনো বা আদেশের সুরে- “আম গাছের ছাল, আমড়া গাছে লাগে না বৌ। সময় থাকতে নিজের কথা ভাবো।” চুপ করে শুনে যেত অলকা। ওনাদের সম্মান রক্ষার্থে কখনো কিছু বলেনি। সংসারেও কোনো প্রভাব পড়তে দেয় নি, সংসারের চাকা চলেছে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু একদিন দূরসম্পর্কের এক পিসিশাশুড়ির নাতির অন্নপ্রাশনের দিন যখন পিসিমা সবার সামনে অলকাকে দেখিয়ে বললেন- “ও আর এই স্বাদের কি বুঝবে? কোকিল ছানা বড়ো করছে। ডানা শক্ত করে যখন বাসা খালি করে উড়ে যাবে, সেদিন টের পাবে.. সেদিন বুঝবে!” স্তম্ভিত, হতবাক অলকা দেবের হাত ধরে সেদিন বাড়ি ফিরে এসে দেব-কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল আর বলেছিল- ” আমাকে ছেড়ে কোনোদিন যাবি না তো? থাকবি তো আমার কাছে সারাজীবন ওদের সব কথা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে..” চৌদ্দ বছরের দেব সেদিন অলকার সব কষ্ট বুঝতে পেরেছিল। হঠাৎ করেই যেন বড়ো হয়ে গেছিল। অলকার চোখের জল মুছিয়ে বলেছিল- “কোনো দিন যাবো না তোমাকে ছেড়ে, কোনো দিনও না..”
সেদিনের দেব আজ পঁচিশ বছরের যুবক। এম. বি. এ. পাশ করেছে। চাকরির প্রস্তাব অনেক এসেছে, আসছেও। কিন্তু ভালো প্রস্তাব সব রাজ্যের বাইরে, দেশের বাইরে। দেব গোঁ ধরে বসে আছে কলকাতা ছেড়ে যাবে না। আবার রবির ইচ্ছে ভাই একটি ভালো চাকরি দিয়ে জীবন শুরু করুক তার যোগ্যতা অনুযায়ী। সেটা বিদেশে হলেও অসুবিধা নেই। দেব দাদাকে কিছু বলে না, কিন্তু বাইরে যাবার প্রস্তাব একটা একটা করে নাকচ করে দেয়। প্রতিবেশী, আত্মীয়রা আবার মুখর হয়ে উঠলো সমালোচনায়- আলোচনায়। এখনকার আলোচনা আরো মুখরোচক.. ! অলকা শিউড়ে ওঠে সে সব কথায়, নীরবে সহ্য করে যায়। কিন্তু দেবের বাইরে চাকরি না নেওয়ার কারণ অলকার অজানা নয়। আর এটাও বুঝতে পেরেছিল আঘাত দিয়ে সরিয়ে না দিলে দেব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না নিজের জীবনের। সেদিনের কথা রাখার দায় থেকে মুক্তি দিতে ওকে আজ এতোটা নিষ্ঠুর হতে হয়েছে। আর যে উপায় ছিল না।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এই দশ বছরের সব ঘটনার নীরব সাক্ষী রবির বাবা- বিকাশ বাবু। তিনি আজ আর নীরব থাকতে পারলেন না অলকার কষ্ট দেখে। খাবার টেবিলের কাছে যখন এলেন, তখন অলকা ভেজা চোখে অবশিষ্ট মাংস অন্য পাত্রে তুলে রাখছে রাতে দেব খাবে বলে- দুপুর বেলা দেব চাইলেও দেবার পরিস্থিতি ছিল না।
“তুমি খাবে না কিছু? সব তুলে রাখলে?” শ্বশুর মশাইয়ের আচমকা কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে অলকা। তারপর ঘাড় নেড়ে ‘না’ জানিয়ে খুব মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে, ” আমি ঠিক করে পালন করেছি তো বাবা?.. আমার দায়িত্ব! আমাকে দেওয়া কথা আর দেবে’র পথে কাঁটা হবে না তো?”
বিকাশ বাবু কোনো উত্তর দিতে পারেন না প্রথমে, পরে দুই হাত জোড় করে বলেন, ” আমরা তোমার কাছে ঋণী মা…”
গলা ধরে আসে তাঁর।
সন্ধ্যা বেলায় দেব ফিরে আসে বাড়ি। অলকা তখন সন্ধ্যা প্রদীপ দিয়ে প্রণাম করছে। দেবের এক হাতে মিষ্টির বাক্স, অন্য হাতে একটা খাম। অলকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে- “খেয়ে নাও আগে, জানি সারাদিন খাও নি কিছু। আর আপাতত তোমাকে যাতে কারোর কাছে কিছু শুনতে না হয়, তারজন্য পুনের চাকরিটা নিলাম। এর থেকে বেশী দূরে যেতে বলো না।”
অলকা বুঝতে পারে না কি বলবে! চোখে জলের ধারায় আনন্দ আর বেদনা একসাথে নেমে আসে। দেবের দেওয়া খাম আর মিষ্টির বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দেব এগিয়ে এসে একটা মিষ্টি নিয়ে অলকার মুখে দিয়ে বলে, “রাতে ভাত কিন্তু বেশি করে করবে। জানি তুমি মাংস রেখে দিয়েছ। একসাথে সবাই বসে খাবো”
রবিও সন্ধ্যা বেলায় মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে দুপুরের ঘটনার রেশ মনে রেখে। বাড়িতে ঢুকে পেছন থেকে স্ত্রী আর ভাইয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। দেব দাদাকে দেখতে পেয়ে বলে, “এসো দাদা, মিষ্টি খাও। আমি পুনের চাকরিতে জয়েন করছি আগামী মাসে…”
রবি অলকা’র দিকে ফিরে বলে, “তোমার স্নেহ, দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে যে অন্যায় করেছি, তারজন্য ক্ষমা করতে পারবে?”
অলকা বলে, “ধুর, কি যে বলো! সব তো আমাদের দেবে’র জন্য। চলো সবাই মা’র ছবিতে প্রণাম করি আজ একসাথে।”
শাশুড়ির ছবির সামনে প্রণাম করে অলকা প্রশ্ন করে মনে মনে, “মা আমি পেরেছি তো, তোমার দেবকে তোমার মনের মত করে মানুষ করতে? আর আমার মনে শক্তিটুকু দিও ওকে ছেড়ে থাকবার… আমার সামনে যে আবার একটা বড়ো পরীক্ষা মা! আর্শীবাদ করো মা…”

Loading

7 thoughts on “গল্প- স্নেহের দায়

  1. পড়তে পড়তে চোখে জল এসে গেলো।
    হৃদয়গ্রাহী।

    1. অনুভূতিটুকু স্পর্শ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ

  2. এমন মুধুর সম্পর্কের গল্প অনেক দিন পর পড়লাম, হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো

    1. অনেক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা অশেষ

  3. অশ্রু জলই সাক্ষী থাক,স্নেহ অতি বিষম দায়।
    অসাধারণ।
    আগামী কলমের অপেক্ষায় রইলাম।

    1. খুব ভালো লাগলো কলমের খুরধার এডাবে চলুক আগামী দিনে আরও বেশি কিছু পাওয়া হোক ঐ কলমে।

Leave A Comment