Site icon আলাপী মন

গল্প -অবুঝ ভালবাসা

অবুঝ ভালবাসা

-রাখী চক্রবর্তী

 

“অভিসারে চলল রাধা,,
মানবে না সে কোন বাধা
শ্যাম যে তার দাঁড়িয়ে আছে
পদ্মা নদীর মাঝে “

—বাহ্ বাহ্ সকাল সকাল কি সুন্দর গান শোনালি দিদিভাই ।
–ও পিসি ঠামমি তুমি আমার দলে আছো তো। বলো না।
— বুঝি না না কি, মন দিয়ে বসে আছো যে। শোন শোন আজ বাড়ির বাইরে এক পা রাখবি না। আমি যা বলব তাই করবি। আমি একটু আসছি দাঁড়া দিদিভাই ।

কোথায় রে সব আর দেরি করিস না। কাজে লেগে যা।
-ও পিসি ঠামমি আজ কি কোন উৎসব?
-মুখ বন্ধ করে থাকো।
-ও পিসি ঠামমি বলো না আজ কি সুন্দর করে বাড়ি সাজানো হচ্ছে। কিছু তো একটা আছে!
– চুপিচুপি বলছি পাঁচ কান করবি না,
– না বলব না বলো, বলো
– মেঘাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। খবরদার বাইরের কেউ যেন জানতে না পারে।
-হুররে..দিভাই এর বিয়ে হবে। রুদ্র তো খুব খুশি।জামাইদাদার সাথে কত গল্প করবে। ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাবে জামাইদাদার সাথে।

মেঘাদের বাড়িতে আজ সবাই ব্যস্ত। এদিক ওদিক সব ছোটাছুটি করছে। কাঁচের জিনিস পত্র যেমন কাঁচের গ্লাস, কাপ প্লেট,ফুলদানি সব লুকিয়ে রাখছে পিসি ঠামমি। কাঁচের জিনিস ভাঙ্গা নাকি অশুভ। রুদ্রর পেপার-ওয়েটটাও উধাও করে দিয়েছে পিসি ঠামমি।

মেঘা যে আজ কি খুশি কি বলব! না না, পাত্র আসছে বলে তার জন্য না। অন্য একটা ব্যাপার আছে। বলব বলব অত তাড়া কিসের বাপু…

– মেঘা ও মেঘা ঠাকুর ঘরে একবার আয় তো মা ।
– বলো মা ।
– নে বাঁ হাতে এই তাগাটা পড়ে নে। গঙ্গা জল দিয়ে ধুয়ে নিয়ে পড়।
-আজ কি পুজো মা?
– এতে ঠাকুরের ফুল আছে। সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে ঠাকুর।
– তুমি তো আছো মা আমার সব বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। আবার ঠাকুর কেন?
– আজ বাদে কাল শ্বশুর বাড়ি যাবি তো। তখন ঠাকুরই ভরসা মা।
– হুম..বললেই হল। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব না। এই বলে দিলাম।

– দাঁড়া দাঁড়া পাগলি মেয়ে একটা।
এই ফাঁকে রুদ্রবাবু চুপিচুপি দিদির ঘরে গিয়ে আয়নাগুলো নিয়ে পিসি ঠামমিকে দিয়ে আসল। মেঘার কাছে তিন চারটে ছোট আয়না আছে। ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার দিকে পেছন ফিরে ছোট আয়না দিয়ে চুল ঠিকঠাক বাঁধা হল কিনা তা দেখে মেঘা। পিসি ঠামমি অনেক দিন তা দেখেছে। আজ তাই আয়না ভেঙ্গে যাবার ভয়ে রুদ্রকে দিয়ে আয়নাগুলো এনে নিজের কাছে রাখল।

দেরাজ থেকে পেতলের বড় বড় ফুলদানিগুলো বের করে পিসি ঠামমি পরিষ্কার করছে। বিয়েতে উপহার স্বরূপ পেয়েছিল। সব উপহার এ বাড়িতেই রয়ে গেল।পিসি ঠামমি শ্বশুর ঘর করতে পারেনি। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলাতে এসে আর শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়নি পিসি ঠামমিকে। পিসাদাদু নদীতে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গেছিল। অষ্ট মঙ্গলার পরের দিনই বিধবা হন পিসি ঠামমি। পিসাদাদু যখন নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিল তখন পিসি ঠামমির হাত থেকে কাঁচের গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে গেছিল। সেই থেকে কাঁচের জিনিস ভাঙ্গা অশুভ মনে করে পিসি ঠামমি।
দাদার সংসার আগলে রেখেছে পিসি ঠামমি দাদার ছেলে নাতি নাতনিদের নিয়ে উনি দিব্য আছেন।

– মেঘা, ও মেঘা কি শাড়ি পড়বি আজ?
-হলুদ রঙের ঢাকাইটা পড়ব।
– ঋষভ তো বলেছিল, যেদিন আমরা প্রথম দেখা করব সেই দিন আমি যেন হলুদ রঙের শাড়ি পড়ি। পিসি ঠামমি আমি হলুদ রঙের শাড়ি পড়ব আজ।
– হ্যাঁ, ঠিক আছে বললি তো একবার। আর তড় সইছে না যে তোর দিদিভাই!
-:দুর কি যে বলো!
দুপুর বেলায় খাওয়া দাওয়ার পর মেঘার ঘরে ওর মা এল। মেয়ে খুশি কিনা এই সম্বন্ধে তা জানার জন্য।
মেঘা একগাল হেসে বলল, মা তুমি কিন্তু আজ গোলাপি রঙের ঐ শাড়িটা পড়বে যেটা আমি তোমাকে দুর্গা পুজোর সময় কিনে দিয়েছিলাম।

– পাগলী বুড়ি একটা তুই। নে ,নে মা সাজগোজ করে নে। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ওনারা চলে আসবেন।

– ঠিক আছে আমি যখন রেডি হব কেউ দরজা ধাক্কা দেবে না। আমি সময় মতো সেজেগুজে বাইরে আসব।
-ঠিক আছে ,আমি যাই ওই দিকের কি অবস্থা হল দেখি।

মেঘা ফোন নিয়ে ঋষভের ছবি দেখতে লাগল। মুখটা মায়া মায়া ঋষভের চোখদু’টো যেন কথা বলে।ফেসবুকের ছবি হলেও জীবন্ত লাগে। সোশ্যাল মিডিয়াতেই আলাপ ওদের। আজ প্রথম ওরা দেখা করবে। আজ আবার পাত্রপক্ষ আসবে মেঘাকে দেখতে। তবে দু’দিকই সামলে নেবে মেঘা। মেঘা মনে মনে এত ভালবেসে ফেলেছে ঋষভকে। মনে হয় না ও অন্য কারোর সাথে ঘর করতে পারবে। ঋষভের প্রাণ না কি মেঘা! এই সত্যটা মেঘা জেনে গেছে।
বিকেল পাঁচটার সময় গঙ্গার ঘাটে আসবে ঋষভ।তিরিশ মিনিট এর জন্য মেঘা বাড়ির বাইরে থাকবে।
পরিপাটি করে চুল বেঁধে সেজেগুজে হলুদ শাড়ি পড়ে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে মেঘা বেরিয়ে গেল। স্বপ্নের রাজকুমারের সাথে দেখা করতে। সারা রাত ধরে ওর মন চঞ্চল ছিল। কেমন দেখতে হবে ঋষভকে? মানুষ হিসাবে ভালো হবে তো?
মাকে বলবে কি ভাবে ওর কথা? সারারাত ধরে ঋষভের ছবি দেখে গেছে মেঘা।

ঠিক বিকেল পাঁচটা মেঘা গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে।— ঋষভ কি কথা রাখবে না? চিটার না তো ঋষভ। কেউ নেই তো। তাহলে আমাকে বোকা বানালো ও।
নানা প্রশ্ন নিজের মনে নিজেই করে যাচ্ছে মেঘা। পাঁচটা দশ হয়ে গেল। এখনও এল না ঋষভ।
ঐ তো একটা মার্সেডিস এসে থামল। ওটা তে করে…
ক্রেচে ভর দিয়ে গাড়ি থেকে নামছে কে, কে?
মেঘার মনে উথালপাথাল করছে অসংখ্য শঙ্কার ঢেউ।
আগে মুখটা দেখি। হ্যাঁ সেই চোখ সেই চুলের স্টাইল। এ তো ঋষভ।

– ভেরি ভেরি সরি মাই ডিয়ার, মাঝপথে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছিল। অনলি টেন মিনিটস লেট মাই ডিয়ার।
মেঘা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না ওর। এত আনন্দ এত খুশি সব যেন নিমেষে শেষ হয়ে গেল ।
– হায় আমি মেঘা।
– কেমন আছেন?
-হঠাৎ আপনি কেন? বিকেল চারটের সময়ও তুমিতে ছিলে আর এখন আপনি?
– না না প্রথম দেখলাম তো। তোমার পায়ে কি হয়েছে?
– তোমাকে দারুণ দেখতে লাগছে। খুব সাজুগুজু করেছো আমার জন্য বুঝি।

– না, আজ আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে।আমি এখন যাই।
বলেই মেঘা এক নিঃশ্বাসে ছুট লাগালো।

বাড়ি ফিরে মেঘা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করছে এতো রূপ এতো অর্থের প্রাচুর্য সব বিকলাঙ্গ ঋষভের জন্য, না কি আজ ওকে যে দেখতে আসছে তার জন্য?

– দরজা খোল মা।
– মেঘা দরজা খুলে বলল,চলো মা

– একি সেজেছিস! হলুদ শাড়ি পড়বি বললি! গলার হার,কানের দুল হাতের চুরি কিচ্ছু পড়িস নি তো। সব পড়ে নে। তাড়াতাড়ি কর। ওনারা আর কতক্ষণ ওয়েট করবেন?

মেঘাকে নিয়ে ওর মা এল।

–  এই আমার মেঘা মা।
মেঘা মাথা নিচু করে বসে আছে। হঠাৎ চোখ গেল ওর ক্রাচের দিকে। সেই ক্রাচটাই তো,ঋষভের। এক ঝলক
ভালো করে দেখে নিল মেঘা সবাইকে।
তবে ঋষভ কি পাত্র?
মেঘার বাবা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পাত্র ওর বাবা, মা ছোট ভাই ঋষভ।
– তোমার নাম কি মা?
– আমার নাম মেঘা
-বলো
– বললাম তো। মেঘা
-তুমি কথা বলতে পারো না?
– হ্যাঁ, পারি।
মেঘার মা মেঘার কানে কানে বলল

– ওনাদের কথার উত্তর দাও।
-আমার নাম মেঘা। আমি কথা বলছি তো। আর কতো চিৎকার করব।
মেঘার বাবা, মা মেঘাকে জড়িয়ে ধরে বলছে কি হল মা মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করছিস না কেন? শুধু ঠোঁট নড়ছে তোর। বল মা কথা বল।

মেঘার দু’চোখে জলের ধারা বইছে। আর কেউ বুঝুক, আর না বুঝুক ঋষভ জানে মেঘার চোখের জল অভিমানের। মেঘা কেন কথা বলতে পারছে না।
ঋষভ তা জানে।
সব নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ঋষভ বলল, মেঘাকে আমি ভালবাসি। আমি মেঘাকে বিয়ে করতে চাই।
মেঘা সলাজ দৃষ্টিতে ঋষভের দিকে তাকিয়ে
ডুকরে কেঁদে উঠল।

ঋষভের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা ঋষভ বলতে লাগল। সেই রাতে নিজেই ড্রাইভ করে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল ঋষভ। হঠাৎ করে সামনে চলে আসে একটা যাত্রী সহ টাটাাসুমো। তাদের বাঁচাতেই একটি ব্রেক মারে ঋষভ। ব্যস, দেখতে দেখতে ঋষভের গাড়িটা উল্টে গেল। টাটাসুমোতে যারা ছিলেন তারাই নার্সিং হোমে নিয়ে গেলেন ঋষভকে। ঋষভের একটা পা বাদ দিতে হল। সে রাতে টাটাসুমোতে মেঘার বাবা,মা, পিসি ঠামমি ছিল। সেই থেকেই পরিচয় মেঘার বাবা মার সাথে।
ঋষভ কিছুটা দম নিল। মেঘা পাথরের মতো বসে আছে।
– আমার দাদার সঙ্গে মেঘার বিয়ে ঠিক হল। আমি জানতাম না যে এই সেই মেঘা যাকে আমি ভালবাসি।
মেঘা ঋষভের সব কথা শুনে দৌড়িয়ে ঘরে চলে গেল।
সব অভিমান সব অভিযোগ ভুলে মেঘা ওর মাকে বলল,

-ঋষভকে ও ভালবাসে। বিয়ে করলে ঋষভকেই করবে
আবার আনন্দ উৎসবে ভরে উঠল মেঘাদের বাড়ি।সামনের লগ্নতে মেঘা আর ঋষভের বিয়ে ঠিক হল।আপনাদের সবার উপস্থিতিতে ওদের বিয়ে সুসম্পূর্ণ হবে। মধুরেণ সমাপন

Exit mobile version