ইছামতির কান্না
-শক্তি পুরকাইত
‘কানাই, এ কানাই..’
চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কানাই নৌকা বাইতে বাইতে ঘাটে আসে। সবুজ রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে পার্বতী। মাথার দু’পাশে চুল লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি। কানাই নৌকা বেঁধে দিয়ে উপরে ওঠে। সোজা গিয়ে পার্বতীর পিছনে এসে দাঁড়ায়।
-‘বল,কী হয়েছে, অমন চিৎকার করছিস কেন? চল না, আজ নৌকা নিয়ে ঘুরতে যাই। না, আজ যাব না! মাছ ধরতে যাব। ঘরে একটা টাকা-পয়সা নেই। মাছ না ধরলে খাব কি?’
পার্বতী একটু চুপ থাকে। তারপর বলে,
‘তোর কবে সময় হবে? আমি মরে গেলে!’
-‘না রে পার্বতী, অন্য একদিন যাবো।’
-‘তুই তো রোজ বলিস, অন্য একদিন! চল না … ! যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি! জানিস পার্বতী তোকে না আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ঠিক যেন আমার বউ।’
-‘সত্যি বলছিস, কানাই। আর একবার বল। ঠিক তোর বউ।’
পার্বতীর কথায় কেমন যেন হয়ে ওঠে সে। ভাবতে থাকে পার্বতীকে বিয়ে করলে কি করে খাওয়াবে। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে কোন দিন আর বাস্তবে মিলবে না। কানাই সামান্য একজন মাঝি। কোনো রকমে মা’কে নিয়ে সংসার চালায়। তাকে এসব বিয়ে-টিয়ে মানায় না। পার্বতী গা ঠেলা দেয়।
-‘কী রে অমন করে কি দেখছিস?’
– ‘না কিছু,না।’
কানাই নৌকাটা খুলে পার্বতীকে ডাকে,
-‘আয়! নৌকাতে বস। পার্বতী কানাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দেখতে থাকে কানাইয়ের পুরুষালি শরীর। কুঁকড়ানো চুল। কানাইকে যত দেখে পার্বতী বিভোর হয়ে যায়।
-‘কি রে পার্বতী তোর বাড়ির লোক কিছু বলবে না? আমার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিস! বললে কী যায় আসে।সে আমি বুঝে নেবো। তোর কিছু হবে না।’
-‘কানাই, এ কানাই তুই কোনদিন কাউকে ভালবেসেছিস?’
-‘হ্যাঁ, কেন আমার মাকে, আমার গ্রামকে, নদীকে। ধ্যাৎ, ও ভালবাসা নয়।’
-‘তবে কোন ভালবাসা?’
-‘ধর, আমি তোকে ভালবাসি, তুই আমাকে।এই ভালবাসা। আচ্ছা কানাই, আমাকে কেমন লাগে?’
কানাই উত্তর দেয় -‘খুব, খুব ভাল।’
ইছামতির নৌকা বাইতে বাইতে বেলা পড়ে আসে। নদীর বুক চিরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। শুধু শোনা যায় জলের মধ্যে দাঁড় টানার শব্দ। ধীরে ধীরে কানাইয়ের নৌকা ঘরমুখো হয়। নদীর পাড়ে টিম টিম করে আলো জ্বলছে, কানাই নৌকা বাঁধে ঘাটে। পার্বতী চুপ করে থাকে।
-‘ কি রে নৌকা থেকে নামবি না। আয়! নামতে ভয় করছে? আয়, আমার হাতে হাত রাখ।’
পার্বতী নৌকা থেকে এক পা না-এক পা ফেলতে সোজা এসে পড়ে কানাইয়ের বুকে। তার নরম ছোঁয়ায় কানাইয়ের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। কানাই জীবনের প্রথম নারী স্পর্শ অনুভব করে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, দু’জন-দু’জনে।
-‘ওঠ পার্বতী, কি করছিস!’ শাড়িটা ঠিক করে নে!পার্বতী উঠে দাঁড়ায়।
দূরে গ্রামের লোকের হো হো শব্দ ভেসে আসে। ভয়ে সে জড়িয়ে ধরে কানাইকে। অন্ধকারে একটা লাঠি এসে পড়ে কানাইয়ের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে ভিজে যায়, শরীর। পার্বতীকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। ইছামতির জলে তখনও ভাসছে কানাইয়ের শরীর।
পৃথিবীতে এইভাবে কানাইরা অকালে যেন না চলে যায় ।