এ যেন এক নতুন ইতিহাস
–ইন্দ্রনীল মজুমদার
আমাদের দেশ প্রাচীন দেশগুলির মধ্যে অন্যতম।বহু ইতিহাস ঘিরে রয়েছে এই দেশ। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে চমক দেওয়া সব ঘটনাগুলির সাক্ষী আমাদের দেশও।
আমাদের দেশে যেরকম সাহিত্যচর্চা,বিজ্ঞানচর্চা ও ইত্যাদি চর্চার সাথে যাদুচর্চাও কিন্তু আছে। সবকিছু জিনিসই কোনো না কোনো ঘটনা বা ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে, অদ্ভুতভাবে কিছু সৃষ্টি হয়নি। পাশ্চাত্য পুলিশের সাথে আমাদের পার্থক্য অনেক।জ্ঞানী ব্যক্তিদের সংখ্যা আমাদের দেশে থাকলেও পাশ্চাত্য দেশে আছে অনেক।আমাদের দেশ কুসংস্কারের মতো ঘন অন্ধকার জিনিস থেকে এখনো মুক্তি পায়নি, তার ছাপ আজও অনেক গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরেও লেগে রয়েছে।বলাবাহুল্য, আজও কিছু মানুষ কাউকে জেতানোর জন্য হোম-যজ্ঞ করে, বৃষ্টি না পড়লে দেবদেবীর পূজো আরম্ভ করে, রোগ থেকে নিরোগ হওয়ার বা পরীক্ষায় সাফল্য বা কোনো কর্মে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য নানান তন্ত্র-তুকতাক ইত্যাদি অপকর্ম আরম্ভ করে। এরজন্য মানুষ নানান অ-মানুষের পাল্লায় পড়েছে যা্রা কেউই নয় শ্রেফ ঠকবাজ বা ভণ্ড এবং তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ,সরল মানুষকে ধর্মের নামে ঠকিয়ে পকেট ফাঁক করে মুখ লুকানো।এর কাছে ঠকে যাওয়া লোকেদের দেখেছি, এদের দেখলে মনে হয় এরা নিজেদের পরম ভুল বুঝতে পেরেছে এবং এদের করুণ মুখ ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’-এই বিখ্যাত প্রবাদটির অর্থ-র সত্য প্রতিফলিত করে।নানান বিজ্ঞান ও ধর্মীয় অজুহাত দিয়ে এই ভন্ডগুলো টাকা সংগ্রহ করছে, এরা সভ্যতার অগ্রগতির বাঁধা সৃষ্টি করে এবং সমাজে অন্যায় করা ব্যক্তি বা অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়।যেসব রাজনীতিবিদ বা প্রভাবশালী ব্যক্তি এইসব ভণ্ডদের মদত দেয় তারাও সমান দোষে দুষ্ট সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
বিজ্ঞান বরাবরই কুসংস্কারের পরম শত্রু। যেখানে কুসংস্কার সেখানে বিজ্ঞানের আলো ফেললে দেখা যাবে সব যাকে বলে ‘Nonsense’। তাই বিজ্ঞান হয়ে উঠছে এত শক্তিশালী এবং সভ্যতার পরম বন্ধু।বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে কোন জিনিসের মূলে কোন ঘটনা আর তখনই বোঝা যাবে যে এই ভূত-প্রেত, জীববলি ইত্যাদি কুসংস্কারগুলি কিছুই নয় শ্রেফ গাঁজা। তো এবার, আমরা চলে আসি মূল বক্তব্যের দিকে। ‘জ্ঞান’ একটি মহা মূল্যবান জিনিস।কথায় আছে, ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করি’।আমাদের দেশে জ্ঞানী বা পণ্ডিত ব্যক্তিদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী এবং তাঁদের জ্ঞানকে ‘অলৌকিক বস্তু’ বলে মনে করা হত। পাশ্চাত্য দেশ মধ্যযুগে ‘জ্ঞান’-কে বা জ্ঞানী ব্যক্তিকে ধর্মবিরোধী বলে গণ্য করা হত এবং চার্চের পোপ তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিতেন।গ্যালিলিও, ব্রুনো, কপারনিকাস ইত্যাদি বিজ্ঞানী ব্যক্তিদের যে কিভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বলভাবে লেখা আছে।৩৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্রো-ম্যাগনন মানুষ পাথর ঘষে আগুন সৃষ্টি করেছিল এবং এই কৌতূহল থেকেই সৃষ্টি হল বিজ্ঞান।আমাদের দেশের কথায় এবার ফিরে আসা যাক।আমাদের দেশে বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিজ্ঞানচর্চা করা হত।বলাবাহুল্য, আমাদের দেশ প্রাচীন আয়ুর্বেদ,বেদ ও ইত্যাদি নানান শাস্ত্রের উৎসস্থল।আমাদের দেশে আগে অনেক ঋষি,মুণিদের স্থান ছিল।সেসব ঋষি,মুণিরা জঙ্গলে পাহাড়-পর্বতে ইত্যাদি স্থানে যোগ সাধনা করতেন।তাঁরা ছিলেন জ্ঞানী-গুনী মানুষ।তো, এঁরা নানান গাছ-গাছরার উপর পর্যবেক্ষণ করে সৃষ্টি করলেন এদের ভেষজ গুনাবলী যেসব গুন আজও আমাদের চমকে দেয়। তাঁরা নানান যোগ, মুদ্রা, প্রাণায়াম ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করতে লাগলেন এবং তাঁদের চর্চিত জিনিস নানান শাস্ত্রে লিখে রাখতেন।এই বিভিন্ন গাছ-গাছরার, লতা-পাতার, শাকসবজি, মৎস্য ও তৈল-এগুলোর ভেষজগুন হল বর্তমান ঔষধ ঔষধি বা রোগ সারানোর প্রথম পর্ব।কবিরাজেরা এই ভেষজগুণ দিয়ে নানা ওষুধ তৈরি করতেন। আধুনিক ঔষধের মত ভেজাল বা স্টেরয়ড যুক্ত না হয়ে খাঁটি ওষুধ ছিল। শোনা কথা, আগেকার কবিরাজেরা নাড়ি টিপে বলে দিতে পারতেন কারা আয়ু কবে শেষ হয়ে যেতে পারে।এইগুলো এখন কোন বিস্মৃতির জলে তলিয়ে গেছে তার ঠিক নেই। আমাদের দেশে ইংরেজরা আসার পর তারা নানান শাস্ত্র নয় লুট করে চলে গেছে, নয় জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে যার ফলে এই আয়ু মাপার পদ্ধতি আমাদের মন থেকে লোপ পেয়ে গেছে।
আমাদের দেশে আগে বিজ্ঞানীরা বা বলাবাহুল্য দার্শনিকেরা কি করতেন? তাঁরা আকাশের মানচিত্র গঠন করেছিলেন।তাঁরা রাজসভায় সমাদর পেতেন।শোনা যায়, প্রাচীন কালে এই সব বিজ্ঞানীদের কিছু কুসংস্কারী মানুষ ‘তান্ত্রিক’ বলে আখ্যা করেছিলেন তাঁরা নানারকম জিনিস নিয়ে ভাবতেন এবং নানানরকম কাজ করতেন যা সাধারন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ভাবনার বাইরে।তাঁরা রাজসভায় রাজার কাছে থেকে কোনো মৃতদেহ নিয়ে জলে ডুবিয়ে রাখতেন।তার দু-তিনদিন পর যখন শবটি নরম হয়ে যায় তখন তাকে তুলে তার শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন-মানব দেহ কি দিয়ে তৈরি? দেহের মধ্যে কি কি আছে? কোনটার কি কাজ? ইত্যাদি। এটাই হচ্ছে হাল আমলের ‘Anatomy’-র প্রথম ধাপ। ভাবা যায়! অথচ শোনা কথা দেশ নাকি ‘Anatomy’ এসেছে ইংরেজদের হাত ধরে।
আমাদের আগে এবং এখনও পাওয়া যায় অনেক মাদারী।এরা রাস্তাঘাটে এবং রাজসভায় নানা মায়াজালের খেল দেখাতেন। মানুষকে শূন্যে ভাসানো, একটা দড়িকে খাড়া করে দেওয়া ও তারউপর মানুষকে শোয়ানো,শূন্য থেকে জিনিস আনা-কোনো কিছুকে অদৃশ্য করে দেওয়া ইত্যাদি কত কি।অথচ বিদেশীরা এসব খেলা তাদের দেশের বলে যুগ যুগ ধরে প্রচার করে এসেছে।বিজ্ঞান নাকি তাদের,আমাদের দেশ কুসংস্কারী- মানতে বাধ্য নই। বহু যুগ আগে আর্যভট্ট নানান পরীক্ষা করে বলেছিলেন, ‘সূর্য স্থির এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে’। তাই আমরা সূর্যকে পূর্ব দিকে উদিত হতে দেখি এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যেতে দেখি।‘শূন্য’-র ধারণা তাঁর থেকেই আসে।এই শূন্য ছাড়া গণিত এগোত না,কম্পিউটার আবিস্কার হত না, দুনিয়াটাই ফ্যাকাশে হয়ে যেত।ইউরোপীয়দের কয়েক হাজার বছর আগে, কণাদ মুনি বলেছিলেন কোনো বস্তুকে খন্ডিত করতে করতে এমন একটা জায়গায় আসবে যখন সেটাকে আর খন্ডন করা সম্ভব হবে না, সেই অবস্থাটির নাম দিয়েছিলেন ‘পরমাণু’।নাগার্জুনকে ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’-র আদিপিতা বলা যায় কারন তিনি আপেক্ষিকতার ধারণাটি বলেছিলেন। শ্রীধর আচার্য,লীলাবতী,ব্রহ্মগুপ্ত ইত্যাদি সবাই প্রাচীনকালের নামকরা গণিতজ্ঞ ছিলেন।স্থাপত্যে এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কুতুব মিনার, যেখানের লোহায় এতো হাজার বছরেও মরচে ধরেনি।জন্তর মন্তর জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।এগুলি সারা বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীদের কৌতুহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোনা যায়, পিথাগোরাসও নাকি ভারতে এসেছিলেন-কে জানি সত্যি না মিথ্যা।সে যাই হোক, বিজ্ঞানের জগতে, আমাদের অবদান ছিল,আছে এবং থাকবে।হাল আমলের ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস সবাই জানেন,আমি শুধু প্রাচীনকালের ভারতীয় বিজ্ঞানের কথা অল্প কথায় শোনালাম।
মেহেরগড় সভ্যতা থেকেই আমাদের সভ্যতার সেইসাথে বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু এবং আমরা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, কুসংস্কার নই,বুঝেছেন।কুসংস্কার যব জাতির মধ্যেই কম-বেশি আছে বিজ্ঞানের আলো যতোই বেশী ছড়াবে ততোই কুসংস্কার উবে যাবে।
গল্পে উপন্যাসে “কি জানি, শোনা কথা” এই জাতীয় শব্দ প্রয়োগ করা যায়। প্রবন্ধে কী তা শোভনীয়.? প্রবন্ধ তো যুক্তির জালে লিখতে হয় বলে জানি। হয়তো আগামী তে আরোও ভালো পাবো আপনার থেকে।
না দেখুন প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে হলপ করে বা জোর দিয়ে কিছুই বলা যায় না। তাই ওই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে।
হ্যাঁ অবশ্যই চেষ্টা করব দেওয়ার।ধন্যবাদ,ভালো থাকবেন।