Site icon আলাপী মন

গল্প- ভক্তের ভগবান

ভক্তের ভগবান
-বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

 

গতবার লে লাদাখে ঘুরতে যাবার পথে কার্গীলের কাছে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল টিফিন করার জন্য। পাশেই একটা চা’য়ের দোকানে চা অর্ডার দিয়ে কেউ কেউ বসে আছে, কেউবা ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির মজা নিচ্ছে আর ছবি তুলছে। আমি দোকানের বেঞ্চে বসে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম দোকান ঘরে একটি মক্কা মদীনার ছবি ঝোলানো আছে। ঠিক তাঁর নীচে শ্রী রাম এর একটি ছবি ঝুলানো আছে। আমি অবাক হয়ে ওনার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। 
– আপনার নাম কি?
উনি বললেন- একবাল রহমান।
আমি বললাম- মুসলমান হয়ে শ্রী রামের ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন? মুসলমানদের এমন কাজ করতে দেখিনি তো কখনো, এর পিছনে কোনো সত্য ঘটনা লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই?
উনি বললেন- হ্যাঁ বাবু, গতবারের ঘটনা আমার ছেলে প্রচণ্ড অসুখে পড়ে মরার যোগাড় হয়েছিল। কবিরাজ টবিরাজ দেখিয়ে কিচ্ছুই হয় নি। বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তখন এক ভারতীয় সৈনিক চা খেতে খেতে আমার কষ্টের কথা শুনে মিলিটারি হসপিটালে ভর্তি করার কথা বললেন। উনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু চা’য়ের দোকান বন্ধ থাকার দরুন সংসার প্রায় অচল তাঁর উপর ছেলের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকার দরকার ছিলো। কোনো উপায় না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। একদিন ছেলেকে হসপিটালে দেখতে গিয়ে দেখি ওই ঘরে একটি ছবির উপর মালা দেওয়া ছিলো, ছবিটি কার আমি চিনতাম না। নার্সকে জিজ্ঞাসা করাতে উনি বললেন হিন্দুদের উপাস্য ভগবান শ্রী রাম। উনি সকলের মনস্কামনা পূরণ করেন। 

আমি মনে মনে এই সংকট থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করলাম। বাড়িতে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও অর্থের যোগাড় করতে পারলাম না। অগত্যা পাহাড়ের উপরের যে দোকান ছিলো যেটা কিনা বরফ পড়ার সময় বন্ধ থাকে সেখানে কিছু সামান ছিলো সেইগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত করলাম। ঘণ্টা দুই তিন বরফের রাস্তা ভেঙ্গে পাহাড় চূড়ার দোকানে পৌঁছলাম। একি দোকান ঘরের তালা ভাঙ্গা কেন! সব চুরি হয়ে গেছে হায় আল্লা…. হায় আল্লা … আমি কান্না করতে করতে দোকান ঘরে ঢুকে দেখি সব সামান ঠিকঠাক আছে। খুঁজতে খুঁজতে চা’য়ের কেটলির তলে একটি দু’হাজারের নোট খুঁজে পেলাম। তখনি ভাবলাম শ্রী রাম আমার মনস্কামনা পূরণ করেছেন। সেই দিন থেকেই এই ছবিটি ঝুলিয়ে রেখেছি আর মনে মনে পূজা করি। এই নিয়ে কট্টর মুসলিমরা আমাকে অনেক হেনস্থা করেছে। তবে ওরা ফরমান জারি করে বলেছে মক্কা মদীনার ছবির নীচে টাঙ্গাবে। আমি তাতেই রাজি হয়ে গেছি বাবু, কারণ আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি আমার ঠাকুর দাদা কাশ্মিরী পন্ডিত ছিলেন । বাবাই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। সে এক করুন কাহিনী পরে শুনাবো।

বাসের হর্নে আমাদের কথোপকথন আর শেষ হলো না, ওনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলামা না ওখানে টাকাটা কে রাখল! পরের দিন কার্গিল সেনা নিবাস দেখতে চললাম সবাই মিলে। সেনা নিবাসে নেমে আমরা একজন সিপাই এর তত্বাবধানে সব ঘুরে ঘুরে দেখছি আর উনি আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। দেখা প্রায় শেষ তখন আমি ওনাকে বললাম স্যার প্রচণ্ড বরফের মধ্যে ডিউটি করার কিছু স্মরণীয় ঘটনা যদি বলেন আমাদের। উনি একটু চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন।

একবার আমাদের সতেরো ব্যাটেলিয়ানের ডিউটি পড়ল সাদা বরফের টিলায় ওখানে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। আমরা কিছু দূর হাঁটার পর সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সবাই বলল একটু গরম চা হলে মন্দ হতো না। সকলে চা’য়ের কথা ভাবতে ভাবতে উপরে হেটে চলেছি। হঠাৎ দেখি একটা দোকান তাও আবার তালা দেওয়া। সকলের অনুরোধে তালা ভেঙ্গে আমরা চা বানিয়ে খেয়ে তরতাজা হয়ে রওনা দিলাম। কিন্তু আমাদের মেজর একটি দু হাজার টাকার নোট কেটলির তলে চাপা দিয়ে রাখলেন। যাতে মালিক এসে কিছু মনে না করে। পরে আমরা ডিউটি শেষ করে ফেরার পথে চায়ের দোকান খোলা পেয়ে সবাই মিলে ওখান থেকে চা খেলাম আর দু’ হাজার টাকার গল্প শুনলাম। মেজরের ইশারায় আমরা সব চেপে গেলাম। সেই দিন ভক্ত ও ভগবানের মিলন দেখেছিলাম। বাসের হর্ণে সবাই হই হই করে দৌড়ে বাসে উঠে পড়ল নতুন কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ।

Exit mobile version