মধুচন্দ্রিমা
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
চলো রানী, অনেক তো সংসার করলে, আর কেন?চলো সংসার ছেড়ে পালাই। আগেকার দিনে বয়স বাড়লে বাণপ্রস্থে যেতো, চলো আমরাও এবার যাই, বলে সুশান্তবাবু তাকালেন রানীর দিকে। আজ চল্লিশ বছর ধরে সংসার করলে…ছেলেমেয়ে মানুষ করলে, বিয়ে দিলে…এমনকি নাতি নাতনিদেরও বড় করলে। কিন্তু বদলে কি পেলে রানী? যাদের জন্য করলে তারা তো ফিরেও তাকায় না তোমার দিকে…শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। তোমার ওই আদরের ছেলে বছরে একবার নানা উপঢৌকন নিয়ে দেখা করতে আসে…আর তুমি তাতেই আহ্লাদিত। ঘরদোর গুছিয়ে, ওদের পছন্দের রান্নাবান্না করে, ওদের সেবাযত্নেই ব্যস্ত হয়ে যাও।
আর তোমার মেয়েটি তো আরো স্বার্থপর। নিজের সাজগোজ, বেড়ানো আর সংসার নিয়েই মহাব্যস্ত।মাসে একবার পদধূলি দিয়ে আমাদের ধন্য করে।কোথায় একটু আয়, বোস, গল্প কর…তা’না এসেই কতক্ষণে যাবে সেই চিন্তা। আধঘণ্টা বসেই উঠি উঠি।এখন সাথী হয়েছে আবার মোবাইল ফোন। এসে ওটার দিকেই তাকিয়ে থাকে। আর কথা মানে তো নিজের দুঃখের সাতকাহন…তোমার মাথাটা খারাপ করে দেয়। এই বুড়ো বয়সে যত্ত টেনশন! দূর দূর ছেলেমেয়ে না শত্রুরের দল!
তোমার এত রাগ কেনো বলো তো? মাতৃসুলভ স্নেহ নিয়েই বলে ওঠে রানী।
কেন আমরা করি নি? আমরা সামলাই নি সব? চাকরী, ঘর সংসার, সন্তান পালন, বাবা-মায়ের দেখাশোনা। আর এরা দেখো নিজেরটা হলো… ব্যাস।
ভেতরে ভেতরে একটা ক্ষোভ ছিলোই সংসার জীবনে ক্লান্ত এই মানুষটার। এখনো এই বয়সে দোকানবাজার, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, ট্যাক্স জমা, বাড়ি সারানো -হাজারো কাজ সামলাতে আর চিন্তা করতে আর ভালো লাগে না। তারপর এই বাজারে জমা টাকার সামান্য সুদে সংসার চালানোও ঝক্কি।
রানী অবশ্য সংসারের খুঁটিনাটি কাজ নিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত। শুধু শরীরটা খারাপ হলেই সমস্যা, নয়তো একা হাতে সব করতে ভালোবাসে রানী।
সেদিন বাইরে থেকে ফিরে সুশান্তবাবু বললেন- চলো রানী, আমরা তপোবনে চলে যাই। গঙ্গার তীরে সাজানো গোছানো বৃদ্ধাশ্রম।
নিজের বাড়ি থাকতে, সংসার থাকতে বৃদ্ধাশ্রমে যাবো আমরা? কেন?
আর মায়ায় জড়িয়ো না রানী, চলো চলে যাই। দেখবে চিন্তাহীন জীবন ভালোই কাটবে। আমাদের যা গহনা, বাড়ি সম্পত্তি আছে, সব বেচে পাকাপাকি ভাবে চলে যাবো।
পরের দিন রানীকে প্রায় জোর করেই দেখাতে নিয়ে গেলেন তপোবন। ওখানে সুশান্তের এক বন্ধুও আছেন…বিপত্নীক… একসময়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন তাপসবাবু।
তাপসবাবুই ঘুরিয়ে দেখালেন এই বৃদ্ধাশ্রমটি…বিরাট কেয়ারী করা বাগান, দেবদারু, পলাশ, শিমূল, কৃষ্ণচূড়া, নারকেল, আম ও আরো নানা ফলের গাছে ঘেরা কম্পাউন্ড। গঙ্গার ঠিক পাশে বেঞ্চ পাতা। এখানেই আবাসিকরা বসে হাওয়া খান, গল্পগুজব করেন। ভেতরে একটা মন্দির আর ধ্যান কক্ষ আছে। সকাল-সন্ধ্যা পূজা অর্চনা হয়। রানীর বেশ পছন্দই হলো।
এখানকার ব্যবস্থা বেশ ভালো। আবাসিকদের দেখাশোনা করার জন্য অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের ব্যবহারও খুব সুন্দর। ডাক্তার আছেন. নিয়মিত পরীক্ষা করেন আবাসিকদের। এছাড়া এদের নিজস্ব হাসপাতালও আছে একটু দূরে।
রানী দেখলো এখানে অনেক স্বামী-স্ত্রী’ও থাকেন।তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। একটা গোটা বাড়ি শুধু বয়স্ক দম্পতিদের জন্য রয়েছে। ঘর, খাট, আলমারী, ফ্রিজ, টিভি, আসবাব দিয়ে সাজানো…ঠিক নিজের ঘরের মতই…তাই দক্ষিণাটাও একটু বেশী।
কাউকে এখনই বলার দরকার নেই। যা করবো চুপিচুপি। কারো মতামত নেবার প্রয়োজন নেই বললেন সুশান্তবাবু।
আস্তে আস্তে সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে উঠলেন তপোবনে। এখন থেকে খাওয়া-থাকা-চিকিৎসা নিশ্চিন্ত। মাঝেমাঝে এরা বেড়াতেও নিয়ে যায় কাছেপিঠে।
এদের কাছে ছেলেমেয়ের ফোন নাম্বার দিতে হয়েছে… যাতে এরা দরকারে যোগাযোগ করতে পারে।
ছেলেমেয়ে শুনে রীতিমত বিরক্ত। এমনটা ওরা ভাবেই নি। রানী ওদের বুঝিয়ে বললো- থাক মানুষটা একটু নিশ্চিন্ত। তোরা এখানে এসেই দেখা করে যাস।
বানপ্রস্থে ভালোই কাটছে রানী-সুশান্তের। অন্য আবাসিকদের সাথে পরিচয়ও হয়েছে। সকালে বিকেলে মন্দিরে যান রানী। এককালের নাস্তিক সুশান্তবাবুও যেন এখন ঈশ্বরপ্রেমী হয়েছেন।সন্ধ্যারতির সময় চুপ করে ধ্যানকক্ষে গিয়ে বসেন তিনি। বেশ ভালোই লাগে তার।
সময়মত খাওয়া-বিশ্রাম, খোলা আকাশ, গঙ্গার হাওয়া, গল্পগুজব, তারপর মন্দিরে গিয়ে বসা….এইভাবে দিব্যি চলছিলো নিশ্চিন্ত জীবন। হঠাৎ একদিন সুশান্তবাবুর খেয়াল চাপলো বেড়াতে যাবেন। সঙ্গীসাথীও জুটিয়ে নিলেন কয়েকজনকে। ফোন করে সরকার ট্রাভেলসের অয়নকে ডেকে নিলেন। ওরা বুড়োবুড়িদের ট্যুরের ব্যবস্থা করেন। বেশ যত্ন সহকারে নিয়ে যান। সাথে ডক্টরও থাকেন।
কিন্তু এক্ষেত্রে তপোবনের অনুমতি লাগবে। কিন্তু তপোবন কর্তৃপক্ষ সব শুনে অরাজী হলেন আর বললেন বাড়ীর লোকের অনুমতি লাগবে।
সুশান্তবাবু রেগে গিয়ে বললেন- আমরা কি বাচ্চা যে আমরা বেড়াতে গেলে আমাদের বাচ্চার অনুমতি লাগবে? শুনে সবাই হাসলেন। সত্যিই বাচ্চারাই এখন অভিভাবক!
অবশেষে ঠিক হলো সব। কিন্তু ট্যুর অপারেটর পাহাড় ছাড়া সমতলে বা সমুদ্রে নিয়ে যেতে রাজী। কিন্তু সুশান্তবাবু পাহাড়েই যাবেন। ওনার বহুদিনের ইচ্ছে…বউকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় যাবেন পাহাড়ে। কিন্তু সে তো আর হয়নি। এখন তো বিয়ের আগেই হাফ হানিমুন হয়ে যায়। আর তারা তখন বিয়ের পরেও গুরুজনদের বলতে পারেননি লজ্জায়। রানীকে তো প্রথমেই শাশুড়ি শুনিয়ে রেখেছিলেন- আমরা বাড়ির গুরুজনদের সামনে বরের সাথে কথাই বলতাম না…মানে হাবেভাবে বুঝিয়েছিলেন তোমরাও তাই করো।
একটুআধটু একসাথে কোথাও বেড়োলেই ওনাদের মুখভার হতো…অশান্তি হতো। পরে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে গেলেও… দু’জনে একলা কোথাও কোনদিন যাওয়া হয়নি। সে যাক্…সেদিন আর নেই। চেষ্টা করলেও সেই বয়স আর সেই সময়টা আজ আর ফিরবে না।
তারপর সেই দিন…অয়ন ওদের অযোধ্যা পাহাড়ে নিয়ে যাবে ঠিক হলো…”রাজ হিল কটেজে “ওরা থাকবেন।আনন্দে আগের রাতে ঘুমোতেই পারলেন না সুশান্তবাবু।
পরেরদিন খুব সকালে গাড়ি ছাড়লো। অয়ন মজা করে বললো–এটা “হানিমুন কাপল স্পেশাল”। সবাই মজা করে হেসে উঠলো।
বড় চমৎকার জায়গা এই হিল রিসর্ট। গাছগাছালিতে ভরা…পলাশের লাল রঙে আগুন লেগেছে। পাহাড়ের পিছনে অস্ত যাচ্ছে দিবাকর। আর অস্তরাগের লালিমা রানীর গালে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন সুশান্ত। রানী বোধহয় লজ্জা পেলো- মুখটা আরক্ত হলো। যেন সেই পাশে বসে থাকা নতুন বধূর লজ্জাবনত মুখ। হাত ধরলেন সুশান্ত, বললেন- এ আমার অনেকদিনের শখ…শুধু তোমাকে নিয়ে…তুমি আর আমি।
রানী হাসলো…বললো, এবার খুশীতো আমার রাজাবাবু?
দিবাকর এবার ওদের একা থাকতে দিয়ে অস্তাচলে গেলো। কটেজের বারান্দায় তখন যেন নব্য দুই তরুণ-তরুণী আর তাদের প্রথম মধুচন্দ্রিমা যাপন।
অসাধারণ।মন ছুঁয়ে গেল।এই রানীর কাহিনী হয়তো অনেকেরই জীবন কাহিনী। তবে ঐ তপোবনটা আমার একান্তই প্রিয়।
অনেক ভালোলাগা,দাদা।এই শান্তির তপোবন সত্যিই বড় শান্তির।
Khub bhalo